তাঁর সঙ্গে আগের মতো আর নিয়মিত যোগাযোগ হতো না বললেই চলে। নাগরিক ব্যস্ততা, যানজটের কোলাহল, শারীরিক অসুস্থতা, করোনাকাল মিলিয়ে না চাইলেও একটা দূরত্ব গড়ে ওঠে। সর্বোপরি এক অপরের সঙ্গে ব্যবধান বাড়িয়ে দেয় ফেসবুক। সামাজিক এই যোগাযোগ মাধ্যমটা বড্ড অদ্ভুত কিসিমের। পার্থিব আর অপার্থিবের মধ্যে পার্থক্যটা ঘুচিয়ে দিতে চায়। সম্পর্কের মধ্যে কেমন একটা ক্যামোফ্লাজ তৈরি করে দেয়। সামাজিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত থাকলে শারীরিক উপস্থিতি না থাকলেও মনে হয় পরস্পরের কাছাকাছিই আছি। হাত বাড়ালেই স্পর্শ করা যাবে। তিনি ফেসবুকে বেশ সক্রিয় থাকতেন। প্রতিনিয়তই তাঁর স্পন্দন অনুভব করতে পারতাম। যে কারণে মনে হতো, তিনি খুব নিকটেই আছেন। প্রকৃতঅর্থে নিকটে না থাকলেও তাঁর সঙ্গে বরাবরই নৈকট্য ছিল।
‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে যোগ দেওয়ার সময় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব ছিলেন এ এস এম আলী কবীর। বিধিবদ্ধ চাকরির প্রতি আমার এক ধরনের অনীহা ছিল। যাহোক, চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর সেই অনীহাটুকু কাটিয়ে উঠতে মোটেও অসুবিধা হয় নি। এর কারণ, খুব সহজেই তিনি আমাকে আপন করে নেন। তিনি হয়ে উঠেন পরম নির্ভরতা। কোনও সমস্যাই কাছে ঘেঁষতে দেন নি। ছাতা হয়ে ছিলেন মাথার ওপর। প্রাতিষ্ঠানিকতার সঙ্গে সৃজনশীল কাজের যে বিরোধ, তা তিনি কখনই বুঝতে দেন নি। যখনই যা করতে চেয়েছি, তিনি বাড়িয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত। প্রচলিত ধারার বসদের মতো তিনি ছিলেন না। যে কোনও কাজ যাতে সাবলীলভাবে সম্পন্ন হয়, বুদ্ধি বা পরামর্শ দিয়ে তিনি সহায়ক ভূমিকা পালন করতেন। সৃজনশীল কাজের প্রতি তাঁর যথেষ্ট অনুরাগ ছিল। ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিজেও জড়িয়ে ছিলেন সৃজনশীল কাজে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। কাব্যচর্চা করতেন। বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করতেন। রচনা করেছেন একাধিক গ্রন্থ। এই ঘরানার মানুষদের সঙ্গে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।
দীর্ঘ চাকরি জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। অনেকের সঙ্গে মিশেছেন। তবে ক্রীড়াঙ্গনের প্রতি তাঁর আলাদা একটা মমত্ববোধ গড়ে ওঠে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে দুই দফায় সচিব থাকাকালে ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে নিজেকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ফেলেন। এই জগতের মানুষগুলোর সঙ্গে তাঁর ছিল আত্মিক এক বন্ধন। গুরুত্বপূর্ণ অনেক দায়িত্বে থাকলেও ক্রীড়াঙ্গন থেকে কখনও দূরে সরে থাকেন নি। মোটামুটিভাবে ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে সুখে-দুঃখে, হাসি-কান্নায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সভাপতি হওয়ার পর ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে যোগাযোগের পরিধি বৃদ্ধি পায়। সামাজিক, পেশাগত পরিমণ্ডলে তো বটেই, ক্রীড়াঙ্গনে তাঁর ছিল অসম্ভব জনপ্রিয়তা। তিনি নিজেও ছিলেন মজলিশী স্বভাবের মানুষ। পছন্দ করতেন খানাপিনা, আড্ডা। সর্বদা প্রাণোচ্ছ্বল বাতাবরণে থাকতে ভালোবাসতেন। জোছনা, পাহাড়, নদী তাঁকে অসম্ভব টানতো।
তাঁর স্নেহ, ভালোবাসা থেকে কখনই বঞ্চিত হই নি। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে কর্মরত থাকলেও বরাবরই যোগাযোগটা ছিল। আমার খোঁজ-খবর নিতেন। তাঁর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগটা অনিয়মিত হলেও একটা বিশ্বাস অটুট ছিল, একজন অভিভাবক হয়ে তিনি আছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান। টেলিফোনে যখন শেষবার কথা হয়, তখন তিনি জানিয়েছিলেন, এই জানুয়ারিতে বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশনের কার্যালয় এনএসসি টাওয়ারে স্থানান্তর করা হচ্ছে। টাওয়ারে অফিস নেওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, ক্রীড়াঙ্গনের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থান করা। যাতে ক্রীড়াঙ্গনের সবার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সহজ হয়। শুনে খুশি হয়েছিলাম। বলেছিলাম, যাক, এখন থেকে আপনার সঙ্গে নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ হবে। নিয়মিত তো দূরে থাক, আর কোনও দিনই তাঁর সঙ্গে দেখা হবে না।
১১ জানুয়ারি ২০২২
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন