পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

বৃহস্পতিবার, ৬ জানুয়ারী, ২০২২

সাগর সৈকতে

 


সাগরের তীর থেকে মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে 

তোমার কপালে ছোঁয়াবো গো

ভাবি মনে মনে

আকাশের নীল থেকে তারার কান্তি এনে

তোমার নয়নে ছড়াবো গো 

ভাবি মনে মনে

সাগরের তীর থেকে...

প্রাণ-মন উজাড় করে কে গাইছে এই গান? যেন কেউ একজন আমাকে মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছে প্রিয় এই গানটি। অদ্ভুত এক ভালো লাগায় বুকের মধ্যে উথালপাথাল করতে থাকে। খালি গলায় গাইলেও কেমন একটা সম্মোহন সৃষ্টি করেছে কণ্ঠমাধুর্য। এমন পরিবেশে এই গান বোধকরি বুকের গভীর থেকে সহজাতভাবেই উঠে এসেছে। পূর্ণিমার প্রভাবে সাগরে যেমন প্রবলভাবে জোয়ার আসে, তেমনিভাবে কণ্ঠে সুর থাকলে গান তো সহজাতভাবে গাইতে ইচ্ছে করবেই। চারপাশটা কী মায়াময়। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে চাঁদের আলো। সমুদ্রের ঢেউয়ে ঝিকমিক করছে আলোর রোশনাই। আলো আর আঁধারের সমন্বয়ে অলৌকিক এক আবহ। গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেন সংগত করে চলেছে সাগরের ঢেউ। সবুজ জলরাশির গম্ভীর সুরেলা কলধ্বনি। 

ক্রমান্বয়ে রাতের গভীরতা বেড়ে চলেছে। লোক চলাচল হ্রাস পেলেও পুরোপুরিভাবে নিরিবিলি বলা যাবে না। সমুদ্রের নির্জনতা একান্তভাবে অনুভব করার জন্য অনেকেই এসেছেন। সত্যি সত্যি মিষ্টি মিষ্টি হাওয়া এসে জুড়িয়ে দিতে থাকে অন্তঃকরণ। কেউ কেউ ছাতার নিচে আরামচেয়ারে বসে আছেন। সেখান থেকেই ভেসে আসছে সুরেলা গান। কোলাহলমুক্ত পরিবেশে গানটা অনেকটা দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। পষ্ট শোনা যেতে থাকে গানের কলি। কেমন আচ্ছন্ন করে দেয়। 

গানের কণ্ঠ খুবই পরিচিত মনে হতে থাকে। অবশ্য এই গান শাহনাজ রহমতুল্লাহর কণ্ঠে জনপ্রিয়তা পেলেও অনেকেই গেয়েছেন। সে কারণে চেনা চেনা মনে হতেই পারে। তারপরও কেন যেন অনেক বছর আগে একজনের কণ্ঠে এই গান শোনার স্মৃতি মনে পড়ে যায়। সেই গানের স্রোতা ছিলাম একমাত্র আমি। অবশ্য আরও ছিল গাছপালা, পাখপাখালি, ঝিরিঝিরি বাতাস আর বছিলা ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা নদী। নদীতে চলাচল করছিল যাত্রীবাহী নৌকা। হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পাওয়া যায় মালামাল বহনকারী বার্জ বা কন্টেইনার। বিকেল গড়িয়ে গেলে ডুবতে থাকা সূর্য ছড়িয়ে দেয় তার অপরূপ মাধুর্য। পরিপার্শ্বটাকে মাখিয়ে দেয় সোনা রঙে। কী যে অদ্ভুত লাগে। 

ঢাকার সন্নিহিত গ্রামীণ এক দৃশ্যপট। আমার আর সুরভির পছন্দের একটা জায়গা। সুযোগ পেলেই সেখানে আমরা ছুটে যেতাম। সেদিন আমরা নৌকায় করে নদীর ওপারের দ্বীপের মতো এলাকায় অবস্থিত বিশাল ইটের ভাটায় যাই। জনবিরল সেই দ্বীপে আমরা প্রজাপতির মতো ইচ্ছেপাখি হয়ে ছোটাছুটি করি। তখন তো যা কিছু করি, তাই লাগে ভালো। কোনও ভয়ডর কাজ করতো না। আশেপাশে তেমন কেউ ছিল না। তারপরও আমার কানে কানে লাজুককণ্ঠে সুরভি বলে, তার খুব হিসি পেয়েছে। সেখানে তো আর ওয়াশরুম থাকার প্রশ্নই আসে না। কী করা যায়? 

এরআগে কখনও এমন সমস্যায় পড়ি নি। তাকিয়ে দেখি, চারপাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য ইটের পাঁজা। ভাবলাম, এরচেয়ে ভালো আড়াল হয় না। সুরভিকে তা বলতেই কিছুতেই রাজি হতে চায় না। কিন্তু এছাড়া তো উপায় নেই। গরজ বড় বালাই। অগত্যা সেই প্রাকৃতিক পরিবেশে ঠেকার কাজ চালাতে হয়। গার্ড হিসেবে আমাকে রাখতে হয় তীক্ষ্ণ নজরদারি। কল্লোলিত ঝর্ণাধারা ইউরিয়া সার হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। 


চাপমুক্তির একটা আলাদা আনন্দ আছে। নৌকায় ফেরার সময় আমার কাঁধে মাথা রেখে আপন মনে গান গাইতে থাকে সুরভি। সাগরের তীর থেকে...। নিবিড় সেই মুহূর্তে নদীটাকেই আমার কাছে সাগর মনে হতে থাকে। সেদিন মনে হয়েছিল, স্বর্গসুখ কি এমন হয়? তখন নেমে এসেছে অন্ধকার। জোনাকি হয়ে জ্বলতে থাকে দূরের আলো। আকাশে তারার মেলা। নিস্তব্ধতার মাঝে বৈঠা বাওয়ার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। কেমন যেন মাদকতাময় পরিবেশ। সব মিলিয়ে মনে হতে থাকে, যেন নন্দনকাননে কিন্নরীকণ্ঠে কেউ গান গাইছে। সেই থেকে গানটা আমার বুকের ভিতর চিরদিনের মতো স্থায়ী হয়ে যায়। 

সুরভির সঙ্গে আমার ছিল গভীর গোপন প্রেম। তার সবচেয়ে যা ভালো লাগতো, আমার পছন্দ-অপছন্দকে সে যথেষ্ট গুরুত্ব দিত। জীবনে যা কখনও করে নি, আমার কারণে তা করতে মোটেও কার্পণ্য করতো না। সেই সময় মূলত আমাকে ঘিরেই আবর্তিত হয় তার জীবন। গানের প্রতি আমার আকর্ষণের কারণে গানের চর্চা শুরু করে। লালমাটিয়া গার্লস কলেজে রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সংগীতের স্কুল 'সুরের ধারা'য় ভর্তি হয়। যত সহজে বলা হলো, ব্যাপারটা তত সহজ ছিল না। পারিবারিক বিধিনিষেধ ছিল। কিন্তু আমার জন্য সে কোনো কিছুই পরোয়া করতো না। 'সুরের ধারা'য় কোর্স কমপ্লিট না করেই তালিম নেয় আধুনিক গানের। এর কারণ, আমি তা পছন্দ করতাম। কিন্তু সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তার সংগীতশিল্পী হয়ে ওঠা হয় নি। 

তার মধ্যে ছিল একটা খামখেয়ালিপনা। কখন কী সিদ্ধান্ত নেবে, তা আগের মুহূর্তেও বুঝতে পারা যেত না। পথ চলতে চলতে হঠাৎ হারিয়ে যেত। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা মোটেও সহজ ছিল না। আমি তাকে অসম্ভব ভালোবাসতাম। এ কারণে তার বায়নাক্কা মেনে নিতাম। তারপরও তার মন রক্ষা করা যায় নি। গান যেমন হুট করে ছেড়ে দিতে একটুও ভাবে নি, তেমনিভাবেই আমার সঙ্গে সম্পর্কটা কাট অফ করতে একদমই দ্বিধা হয় নি। কেন সম্পর্ক অটুট রাখে নি, তার কোনও কার্যকারণ জানি না। সেদিন উপলব্দি হয়, বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলিয়া দেয়।

একটা পর্যায়ে তার হয়তো ইচ্ছে হয়, আমার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দেওয়ার। তার ইচ্ছে হবে, সেটা বাস্তবায়িত হবে না, তা তো হতে পারে না। ওয়ান ফাইন মর্নিং আমি আবিষ্কার করি, তার নামের পাশে সবুজ বাতি আর তো জ্বলে না। জ্বললেও আমি তা দেখতে পাই না। তার জীবন থেকে আমি একদমই নেই হয়ে যাই। কেন, কী কারণে আমাকে বাতিল করে দেওয়া হয়, তার জবাব আজও পাওয়া হয় নি। তবে অস্বীকার করবো না, তাকে কখনও ভুলতে পারি নি। 

মুক্তা যেমন শুক্তিরও বুকে থাকে, তেমনিভাবে আগলে রেখেছি তার সান্নিধ্যের মধুময় স্মৃতি। যখনই কোথাও তার মতো কাউকে কিংবা অবিকল তার ভঙ্গিমা দেখতে পাই, বুকটা কেমন উচাটন উচাটন করতে থাকে। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সবটাই হয়ে যায় মরীচিকা। আর কখনও তার নাগাল পাওয়া হয় নি। এই বিভ্রান্তি নিয়ে তাকে প্রতিনিয়ত খুঁজে চলি। তার কণ্ঠে শোনা গান হররোজ শুনি। কেউ যখন সেই গান গায়, আমি কান পেতে রই।

অনেক বছর পর কক্সবাজারে এসেছি। সব কেমন বদলে গেছে। সৈকত শহরের সেই বর্ণিলতা অনুভব করতে পারছি না। সবুজের গহীনতা নেই। শহরটি যেন রূপ নিয়েছে আবাসিক এলাকায়। হোটেল, মোটেল, রিসোর্টগুলোতে নান্দনিক সৌন্দর্যের বালাই নেই। অধিকাংশই গড়ে তোলা হয়েছে আবাসিক ভবনের মতো করে। তা দেখে প্রাথমিক অবস্থায় বোঝার উপায় নেই এটি সৈকত শহর। কেবল সমুদ্রের কাছে গেলেই তা অনুধাবন করা যায়। দিনের বেলায় জনাকীর্ণ সৈকতে সাগরের ঢেউয়ে চেপে নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে আসার খুব একটা সুযোগ পাওয়া যায় না। এত এত মানুষের ভিড়ে সমুদ্র দূরের হয়ে থাকে। 


যতই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে থাকে, ততই যেন মায়াবিনী হয়ে ওঠে সমুদ্র। ধরা দেয় নানান রূপে। রহস্যময়তার চাদরে মুড়ে দেয় চারদিক। সূর্য ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে দৃশ্যমান হয় অপার্থিব সৌন্দর্যের এক আধার। সেই সৌন্দর্যকে স্মৃতিময় করার জন্য  মুহুমুর্হু জ্বলতে থাকে মোবাইল বা ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। কারও হাতে সূর্য। কারও আঙুলে সূর্য। কারও মাথায় সূর্য। নানান ভঙ্গিমায় সূর্যাস্তকে বন্দী করা হয়। কতভাবেই না গোধূলিকে ধরে রাখার কসরত চলতে থাকে। আমরাইবা পিছিয়ে থাকি কেন? আর সৈকতের পেশাদার ফটোগ্রাফারদের ক্রমাগত তাগাদা তো আছেই। 

আগে সৈকতের ফটোগ্রাফাররা ছবি তুলে প্রিন্ট করে হোটেলে পৌঁছে দিত। সেই সিস্টেম আর নেই। এখন ছবি তোলার পর ডাটা কেবল কিংবা পেন ড্রাইভ দিয়ে ছবি মোবাইল ফোনে ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়। বেশি টাকা পাওয়ার জন্য ঘন ঘন ক্যামেরার শাটার টিপে গাদা গাদা ছবি ধরিয়ে দেয়। একই ভঙ্গিমায় অনেক ছবি তোলা হয়। কার্যত কিছু করার থাকে না। অবশ্য প্রিন্ট কপি ছবির গুরুত্ব আগের মতো আর নেই। এখন ছবি তোলা হয় মূলত একবার দেখা কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করার জন্য। প্রতিনিয়ত জমা হয় হাজার হাজার ছবি। তার মধ্যে পুরনো ছবির তেমন আর কদর থাকে না।


ব্যস্ততার কারণে কক্সবাজারে তোলা অসংখ্য ছবি ঢাকায় ফিরে আসার আগে আর দেখার সুযোগ হয় নি। অনেক দিন পর ছবিগুলো দেখার সময় চমকে যাই। সেই ছবিগুলোর মধ্যে নানান ভঙ্গিমায় জ্বল জ্বল করতে থাকে সুরভি। কত দিন পর তাকে দেখলাম। ফটোগ্রাফার তার ক্যামেরা থেকে ডাটা কেবল দিয়ে আমার মোবাইলে যে ছবিগুলো দেয়, তাতে শুধু আমাদের ছবি নয়, ভুল করে অন্য অনেকের ছবিও দিয়ে দিয়েছে। সেই ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে সৈকতে ভ্রমণরত সুরভি। তবে খুব কাছাকাছি হলেও ক্ষণিকের জন্য তার সঙ্গে সরাসরি দেখা হলো না। বুকের মধ্যে সুরের হাহাকার ছড়িয়ে দিতে থাকে তার কণ্ঠে গাওয়া গান, সাগরের তীর থেকে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন