অনেক দিন পর যেতে হলো পাটুরিয়া ফেরি ঘাটে। একটা সময় সদরঘাট লঞ্চ ঘাট এবং পরবর্তীতে আরিচা ফেরি ঘাটই ছিল যাতায়াতের প্রধান দুই প্রাণকেন্দ্র। সে সময় এত বেশি যানবাহন ছিল না। নদীপথ ছিল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে এ দুই ঘাট দেশের মানুষের কাছে ছিল একরকম তীর্থকেন্দ্র। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চল, পশ্চিমাঞ্চল আর উত্তরবঙ্গে যাতায়াতের এরচেয়ে ভালো তেমন কোনও বিকল্প ছিল না। কত কত মানুষের কোলাহলে সরগরম হয়ে ওঠতো। মনে হতো, এ যেন মানুষের মিলন মেলা। কেউ হন্য হয়ে ছুটছেন। কেউ অনন্ত এক অপেক্ষা নিয়ে বসে আছেন। আর কিছু মানুষ অকারণেই মনের আনন্দে ঘোরাঘুরি করছেন। হরেক পণ্যের পসার নিয়ে হকার ও ফেরিওয়ালাদের দাপট তো ছিলই। ছিল ভিক্ষুকরাও। কত রকম বিচিত্র অভিজ্ঞতা যে সঞ্চয় হতো। এ যেন এক জ্যান্ত রঙ্গমঞ্চ। যেখানে প্রতিনিয়ত অভিনীত হয় নিত্য-নতুন নাটক। কোনোটা হাসির। কোনোটা বেদনার। হোটেল ও বোর্ডিংয়ের ব্যবসাও ছিল রমরমা। সদরঘাটে এখন একদমই যাওয়া হয় না। সর্বশেষ অনেক আগে একবার বুড়িগঙ্গায় নৌকাভ্রমণ করার সময় পারিপার্শ্বিক ও নদীর পানির অবস্থা দেখে মনটা খুবই খারাপ হয়ে যায়। তবে সদরঘাটে আগের মতো সেই ব্যস্ততাও নেই। লঞ্চ-স্টিমারের কদরও তো আর আগের মতো নেই। যে কারণে একটু যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। আর আরিচা ঘাট তো কবেই পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। তার পরিবর্তে স্থান করে নিয়েছে পাটুরিয়া ঘাট। সেখানে যাওয়ার পর ভেবাচেকা খেয়ে যেতে হয়। জীবনানন্দ দাশের ভাষায়, ‘জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার’। কিন্তু পাটুরিয়া ঘাটে গিয়ে সেটা একদমই মনে হয়নি। ঢাকা থেকে মাত্র দুই ঘণ্টার পথ। জীবন যেন এখানে থমকে আছে। খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। অতীতের দিনগুলো যেন ফিরে ফিরে আসে। প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তা যথেষ্ট চওড়া নয়।
তদুপরি রাস্তার একপাশে মালবাহী ট্রাকের দীর্ঘ সারি। যেন পারাপারের জন্য যুগ যুগ ধরে অপেক্ষায়। অন্য পাশ দিয়ে গায়ে গা লাগিয়ে ঢিমেতালে যানবাহন চলাচল করে। ফেরি সার্ভিসকে খুব বেশি তৎপর মনে হয়নি। আমি যেদিন যাই, সেদিন চৈত্রের তপ্ত দুপুরে বাসের মধ্যে ফেরির অপেক্ষায় থাকতে হয় প্রায় দেড় ঘণ্টা। প্রচণ্ড গরম। কোথাও কোনো স্বস্তি নেই। বালুর চাদর বিছানো। উড়ছে আপন মনে। একটা পরিবর্তন অবশ্য হয়েছে। গাছগাছালির সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। কোথাও ছায়া নেই। এ পথের যানবাহনও খুব একটা জুতের মনে হয়নি। সর্বত্র জীবন গতিশীল হলেও এ ফেরি ঘাটে কেবল ব্যতিক্রম মনে হলো। পাটুরিয়া ফেরি ঘাটে ফিরে পেয়েছিলাম আমার অতীতকে। যখন স্কুলের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যেতাম, তখন সদরঘাট ও পরবর্তীতে আরিচাঘাটে যে অভিজ্ঞতা হতো, সেটি যেন একের পর এক রিউয়িন্ড হয়ে চলেছে। দুনিয়া কোথায় চলে গেছে, আর পাটুরিয়া ফেরি ঘাটের পরিবেশ রয়ে গেছে আগের মতো। নাগরিক জীবন থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। বাস থেমে থাকলেও থেমে থাকেনি ফেরিওয়ালাদের বিরামহীন তৎপরতা। একটু পর পর বাসে ওঠে সুরে সুরে তাঁদের নিবেদন। কত বিচিত্র ভঙ্গি। বিচিত্র ঢঙ। বিচিত্র পরিবেশনা। বেশ মজাই লাগে। কারও না কারও আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারা যায় না। আর আমি তো এমন ডাকের অপেক্ষায় থাকি। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কোনও বাধা-নিষেধ মানতে ইচ্ছে করে না। না হয় আয়ু থেকে কিছুটা সময় ক্ষয়েই গেল। তাই বলে এমন সুস্বাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে মন চায় না। যে জীবন ফেলে এসেছি, তার সঙ্গে রয়েছে এর নিবিড় সম্পর্ক। তাই চাইলেও এ ডাক এড়াতে পারি না। একের পর এক আসতে থাকে ঘনিষ্ট আমন্ত্রণ। এই ডিম খান ডিম। ডিম আছে ডিম। গরম ডিম। ঝালমুড়ি, শুধু খাইতে মন চাইবে। মশলা দিয়ে। লেবু দিয়ে। শশা। তাজা শশা। জালি শশা। খাইলে দিল ঠাণ্ডা। তিলের খাজা। নারিকেলের খাজা। বাড়িতে নিয়ে যান। না নিলে পস্তাইবেন। শ-ন পা-প-ড়ি। চা-না-চু-র। মাখানো চানাচুর। টেস্টি। চকলেট। ঝাল মশলা দিয়ে বাদাম-বুট। পপকর্ণ ভাজা। ঠাণ্ডা আইসক্রিম। গরমে ঠাণ্ডা। ফ্রিজের ঠাণ্ডা। চকবার। ঝাল-লবণ দিয়ে আমড়া। ভাজা মচমচে ভাজা। কড়া ভাজা। টাটকা। এই সিঙ্গাড়া গরম। মজার প্যাকেট বরই। টক-ঝাল-মিষ্টি। এই যে মিষ্টি কমলা। মজার খাবার পিঁয়াজু। আমি গেলে আর পাইবেন না। পানি। ঠাণ্ডা পানি। হাদিসের বই। বাচ্চাদের বই। ছোটদের বই। গল্পের বই। সুন্দর কলম। চিরুনি। টুথব্রাশ। আরও যে কত কি। এই হাঁকডাক, দরাদরি আর এ সংক্রান্ত কথপোকথন কম মজাদার নয়। আর্থিক সাহায্যের জন্যও বিভিন্ন কায়দায় আবেদন-নিবেদন করা হয়। আল্লার ঘরে দান করে যান। এ দান বৃথা যাবে না। মসজিদ-মাদ্রাসা-এতিমদের জন্য কিছু দিয়ে যান। চলার পথে বিপদ-আপদ থেকে নিরাপদে থাকুন। কত রকম ভিক্ষুক। কারও চোখ নেই। কারও হাত নেই। কেউ কথা বলতে পারেন না। কেউ চিকিৎসার জন্য আকুতি জানিয়ে সাহায্য কামনা করেন। কেউ সুরেলা কণ্ঠে, কেউ কেউ তীব্র চিৎকারে তাঁদের নিবেদন পেশ করেন। রাস্তার দু’পাশে হরেক রকম দোকান। তাতে সাজানো নানা কিসিমের পণ্য। আছে ডাব, আনারস, কমলা, আপেল সহ নানা ফল-ফলারি। রাস্তার ধারে রেকর্ডকৃত কণ্ঠে টানা বেজে চলছে স্বপ্নদোষের ব্যাখ্যা। পাতলা ধাতুর অপকারিতা। ইত্যাদি। ইত্যাদি। শুনলে কান গরম হয়ে যায়। এসব নিদানের জন্য আছে অষ্টধাতুর মাদুলি, তাবীয, হারবাল টনিক আর কত কি। এসব নিলে নাকি জাদুর মতো ফল পাওয়া যাবে। এ রাজধানীর বুকে এখন যে জীবনের দেখা মিলবে না, তেমন একটি ভিন্ন জীবনের সন্ধান মিলবে পাটুরিয়া ফেরি ঘাটে। জীবন নাকি থেমে থাকে না। তাহলে পাটুরিয়া ফেরি ঘাটে এ কোন জীবন?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন