পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৬

দাঁতে দাঁতে ঘাস কেটেছি

অনেক তুচ্ছ বিষয়ও অনেকেরই মন হরণ করে নেয়। ঘাসকে কি তুচ্ছ বলা যায়? সেটা এক একজনের কাছে এক একরকম বিবেচনা। কবি আবিদ আজাদ তো ‘ঘাসের ঘটনা’ লিখে কাব্যাঙ্গনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। জীবনানন্দ দাশ তো ঘাসের তীব্র অনুরাগী ছিলেন। তাঁর মতো করে ঘাসকে কেউ অনুভব করেছেন বলে মনে হয় না। তিনি তো মনে করতেন, ‘পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে’। ‘ঘাস’ কবিতায় লিখেছেন, কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয় পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা; কাঁচা বাতাবীর মতো সবুজ ঘাস—তেমনি সুঘ্রাণ— হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে! আমারো ইচ্ছে করে এই ঘাসের এই ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো গেলাসে-গেলাসে পান করি, এই ঘাসের শরীর ছানি—চোখে ঘষি, ঘাসের পাখনায় আমার পালক, ঘাসের ভিতর ঘাস হ’য়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে। ঘাসের নিশ্চয়ই ঔষধি উপকারিতা আছে। সেটা ভালো বলতে পারবেন কবিরাজরা। তবে ভোরবেলা খালি পায়ে ঘাসের ওপরে হাঁটার উপকারিতার কথা শৈশবেই জেনেছি। চোখের দৃষ্টিশক্তিও নাকি তাতে ভালো থাকে। আর ঘাসকে ওষুধ হিসেবেও কত ব্যবহার করেছি। ছোটবেলা দুষ্টুমি করতে গিয়ে কিংবা অন্য কোনও কারণে শরীরের কোথাও কাটেনি, এমন সৌভাগ্যবান খুব কমই আছেন। সেক্ষেত্রে কেটে যাওয়া স্থানে ঘাস চিবিয়ে তার প্রলেপ দিয়ে রক্তপাত বন্ধ করার চেষ্টা করেছি রক্তক্ষরণের। অনেকে অবশ্য থামিয়েছেন ভালোবাসার রক্তক্ষরণও। প্রকৃতপক্ষে ঘাসের উপকারিতা কতটা, সেটা আমার জানা নেই। তবে মনের সঙ্গে ঘাসের একটা সংযোগ অনুভূত হয়। ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটলে মনটা বেশ সতেজ হয়ে যায়। আর প্রিয় কারও হাতে হাত ধরে হাঁটলে তখন ঘাসের পথকে মনে হয় স্বর্গীয় উদ্যান। অবশ্য ঘাস ছাড়া কি কোনও উদ্যান কল্পনা করা যায়? ইদানিং অবশ্য ঘাসের কদর বেড়েছে। কোথাও কোথাও বাণিজ্যিকভিত্তিতে চাষ হয় ঘাসের। খেলার মাঠে ঘাসের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। উইম্বলডন টেনিসের ঘাসের কোর্টের খ্যাতি তো দুনিয়াজোড়া। গলফ কোর্স তো ঘাস ছাড়া চিন্তাই করা যায়। এক একটা গলফ কোর্স যেন ঘাসের উপত্যকা। ঘাসের বুকে আলতোভাবে গড়িয়ে যায় গলফ বল। ক্রিকেট খেলায় উইকেটে ঘাসের উপস্থিতিতে ভিন্ন কৌশল সাজাতে হয় অধিনায়ককে। ফুটবল মাঠেও সবুজ ঘাসের কার্পেট জুড়িয়ে দেয় চোখ। শীতকালে ঘাসের সৌন্দর্য অনেকখানি বেড়ে যায়।

ঘাসের ডগায় জমে থাকে শিশিরবিন্দু। তাতে ভোরের সূর্যের আলোর প্রতিফলনে ঝলমল করে হীরকদ্যুতি। ঘাসের প্রতি আমার এক ধরনের দুর্বলতা আছে। ঘাসের সৌন্দর্য যেমন আমাকে মুগ্ধ করে, তেমনি একটা সময়ে ‘ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি’। কেবল পা-ই ফেলিনি, দাঁতে দাঁতে কত যে ঘাস কেটেছি, তার যোগফল নিশ্চয়ই কম হবে না। ঘাস যেন অনাদৃত এক ভালোবাসা। ঘাসের তো খুব একটা পরিচর্যার প্রয়োজন পড়ে না। একরাশ অবহেলা নিয়ে যেখানে সেখানে বেড়ে ওঠে লকলকিয়ে। বিস্তীর্ণ ঘাসের সবুজ বাগিচার সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। আর অনেকেরই ভালোবাসার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঘাস। ঘাস খেয়ে গরু-ছাগল-হরিণেরা জীবন ধারণ করলেও অসংখ্য মানুষের ভালোবাসায়ও ঘাস যুগিয়েছে পুষ্ঠি। অনেক রোমান্টিক মুহূর্তে কারও কারও কাছে ঘাস ছিল পরম আশ্রয়। ‘সব চোখ ফাঁকি দিয়ে বুকে ভালোবাসা নিয়ে’ কপোত-কপোতিরা যখন নিরিবিলি ঘাসের বিছানায় মিলিত হতেন, তখন তাদের প্রশ্রয় দিত নরম সবুজ ঘাস। প্রেমিকের চোখে সরাসরি তাকাতে বিব্রত লাজুক প্রেমিকা আড়াল হিসেবে খুঁজে নিত ঘাস। ঘাসের দিকে হরিণের মতো মায়াবী চোখে তাকিয়ে, কখনো ঘাস নিয়ে অকারণেই টানাটানি করে, কখনো আনমনে মুখে নিয়ে ইঁদুরের মতো টুকটুক করে ঘাস কেটে অনেক না বলা কথার উত্তর দিয়ে দিতেন। কোনও কোনও প্রেমিকেরও অবলম্বন ছিল ঘাস। আমার তো বদভ্যাসের শেষ নেই। বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে আড্ডা মারতে মারতে ঘাস চিবিয়ে খাওয়াটা ছিল তার একটি অংশ। ঘাসের গোড়ার সাদা অংশটুকুর মধ্যে খুঁজে কি পেতাম আবেগের নির্যাস? ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে দাঁতে কাটতে কাটতে বন্ধুত্বের কত কত নিবিড় মুহূর্ত পেরিয়ে এসেছি। শরীরে, মনে লেগে আছে ঘাসের পরশ। অবশ্য সেই দিন তো এখন আর নেই। বদলে গেছে ভালোবাসাবাসির ধরন। বন্ধুত্বের ধরনও পাল্টে গেছে। ঘাসের কার্পেটে আড্ডা মারতে এখন খুব একটা দেখা যায় না। এখন তো সোশ্যাল মিডিয়ায় গড়ে ওঠে সম্পর্কের রেসিপি। সেখানে ঘাস কোথায়? এমনিতেই দুর্লভ হয়ে যাচ্ছে ঘাস। অন্তত শহর এলাকায় ঘাসের পরিসর তো দিনে দিনে কমছে। কংক্রিটের এই জঙ্গলে ঘাসের ছোঁয়া না থাকায় মনটাও ক্রমশ কংক্রিট হয়ে যাচ্ছে। হায়! কত কত দিন ঘাসের আস্বাদ পাওয়া হয় না। খালি পায়ে ঘাসের স্পর্শ নেওয়া হয় না। দেখাও তো হয় না! বুকের মধ্যে গুনগুনিয়ে ওঠে, ‘একদিন ছুটি হবে, অনেক দূরে যাবো, নীল আকাশে সবুজ ঘাসে খুশিতে হারাবো’। কবে আসবে সেই দিন?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন