কখনো-সখনো মনের খেয়ালে কবিতা লেখার ঝোঁক চাপে। লিখতে লিখতে হাল ছেড়ে দেই। চাইলেই কি আর কবিতা লেখা যায়? যায় না। অসমাপ্ত বা অর্ধ-সমাপ্ত সেই কবিতা আড়ালেই পড়ে থাকে। হওয়ায় হাওয়ায় উড়েও যায়। বোঝাই যাচ্ছে, আমার কবি হওয়া হবে না। আর বুকের মধ্যে যদি জীবনানন্দ দাশ বাস করেন, তাহলে কি আর কবিতা লেখার উপায় আছে? কবেই তো তিনি রায় দিয়ে গেছেন ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। প্রিয় কবির এমন ‘ধমক’-এর পর কবিতা লেখার দুঃসাহস হয় কী করে? তারপরও কেন যেন কবিতার মোহ ছেড়ে যেতে চায় না। কবিতার মায়াবী টানে ছুটতে ইচ্ছে করে। কবিতার কোমল আবষ্টনীতে আশ্লিষ্ট হতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে কবিতায় নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সঁপে দিতে। এটা তখনই খুব বেশি করে, যখন ঝুম ঝুম বৃষ্টি নামে, যখন জোছনায় প্লাবিত হয় চারপাশ, যখন পাশ দিয়ে হেঁটে যায় নাটরের বনলতা সেন, সে মুহূর্তে বুকের মধ্যে বড় স্বাদ জাগে কবিতায় ‘আত্মহত্যা’ করতে। রাস্তায় চলতে চলতে হাতের মোবাইল কিংবা কম্পিউটারের কী বোর্ডে কাঁপা কাঁপা হাতে কিছু কিছু লাইন লেখা হয়ে যায়। অধিকাংশ সময়ই অসমাপ্ত থেকে যায় কবিতা। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল জীবন। এরমধ্যে সদ্য সদ্য ঘটে যাওয়া ছোট্ট একটি ঘটনা ব্যক্ত করার লোভ সামলাতে পারছি না। তাতে যদি কবি হিসেবে কিঞ্চিৎ ‘খ্যাতি-প্রতিপত্তি’ জোটে, মন্দ কি? তাছাড়া বিষয়টি যেহেতু কবিতা, যেটি মোটেও আমার বিষয় নয়, সেখানে অপ্রত্যাশিতভাবে উচ্চারিত হয়েছে এই অভাজনের নাম, স্বভাববিরুদ্ধ হলেও এই সুযোগে নিজের একটু ঢাক-ঢোল পিটালে কেউ নিশ্চয়ই মাইন্ড করবেন না। তাই না?
তালাত মাহমুদের গাওয়া কালজয়ী গান ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো, চাঁদ বুঝি তা জানে’-এর গীতিকার ও কবি কে জি মোস্তফা’র সম্পাদনায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্যদের জন্য গত ১৩ বছর যাবৎ প্রকাশিত হয়ে আসছে মাসিক ‘কবিতাপত্র’। অনেক দিন ধরে তাতে লেখার বাসনা জাগলেও স্বভাবজাত লাজুকতার কারণে লেখা হয়ে ওঠেনি। আমার একজন শুভাকাঙ্খী কবি সুধীর কৈবর্ত দাসের অনবরত তাগিদায় মনের জড়তা কাটিয়ে ওঠে কী মনে করে গত বছর থেকে এই কবিতা পত্রিকার লেখক তালিকায় নাম লিখিয়েছি। তাতে টুকটাক লিখি। কবি হওয়ার তাড়না নিয়ে লিখি না। লিখি একান্তই মনের আনন্দে। প্রতি মাসের শেষ তারিখে যেদিন পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়, সেদিনই এ পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগে জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে কবিতা পাঠ ও কবিতা নিয়ে আলোচনা করা হয়। ইচ্ছে থাকলেও সময় মেলাতে না পারায় আমি কখনও এ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারি নি। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ঘটনাক্রমে উপস্থিত ছিলাম জাতীয় প্রেস ক্লাবে। টিভি রুমে আড্ডারত। উপস্থিত ছিলেন চ্যানেল আইয়ের সিনিয়র বার্তা সম্পাদক প্রণব সাহা সহ ক্লাবের নবীন-প্রবীণ সদস্যরা। ক্লাবের উপরের মিলনায়তনে যে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান চলছে, সেটা জানতাম না। জানলে একবার নিশ্চয়ই ঢু মারতে পারতাম। কবিতা পাঠের আসরের নিয়মিত সদস্য বিখ্যাত সুধীর কৈবর্ত দাস, ফরিদা ইয়াসমীন সেদিনের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে নিচে নেমে আমাকে দেখে উপস্থিত সবার সামনে উচ্চকণ্ঠে জানতে চাইলেন, আমার কবিতা পাঠ করার জন্য অনুষ্ঠানে আমি কোনও বান্ধবীকে পাঠিয়েছি কিনা? আমি হতচকিত হয়ে যাই। আমার কবিতা পাঠ! আমার বান্ধবী! কিছুই বুঝে ওঠতে পারছিলাম না। ক্লাবের উপস্থিত সদস্যরা মজার উপাদান পেয়ে কান সজাগ করে আমার দিকে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। এমন অবস্থায় আমি প্রকৃতঅর্থেই বেশ বিব্রত হয়ে পড়ি। নিজে যেখানে আজ অব্দি এ অনুষ্ঠানে যাইনি কবিতা পাঠ করতে, সেখানে আমি আমার কবিতা পাঠের জন্য বান্ধবীকে পাঠাবো! আমাকে যাঁরা কম-বেশি জানেন, তাঁরা বোধকরি জানেন, এতটা দুঃসাহসী মনোভাব অন্তত আমার নেই। আর আমার বান্ধবী? সে এলো কোথা থেকে? বিস্ময়, বিস্ময় আর বিস্ময়। সঙ্গত কারণে এটাও অবিশ্বাস্য যে আমার বান্ধবী জাতীয় প্রেস ক্লাবের মতো চত্বরে যেয়ে আমার লেখা কবিতা পাঠ করবেন। তবে অনুষ্ঠানে উপস্থিতিদের জবানির টুকরো টুকরো সংলাপে যেটুকু জানতে পারলাম, সেদিন প্রকাশিত ‘কবিতাপত্র’-এ আমার যে কবিতা প্রকাশিত হয়েছে, সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই কবিতা আবৃত্তি করেন একটি মেয়ে। মেয়েটি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য নন। তাঁকে সবাই চেনেন না। তবে এ অনুষ্ঠানে ইতোপূর্বেও নাকি তাঁকে দেখা গেছে। কবিতার প্রতি তাঁর আসক্তি আছে, সেটা বুঝতে পারা যায়। কিন্তু তিনি কী মনে করে এই অকবির কবিতা পাঠ করেছেন, সেটা সত্যিকার অর্থেই আমার জীবনের পরম এক বিস্ময়। সেখানে আমার পরিচিত যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরাও এটা বুঝতে পারেননি, মেয়েটি কেন আমার কবিতা পাঠ করলো? অবশ্য না পারারই কথা। তবে কেউ কেউ অনুমান করেছিলেন, নিশ্চয়ই মেয়েটি আমার অতি ঘনিষ্ঠ কেউ হবেন। এমন পরিস্থিতিতে এমনটি ভাবা মোটেও অসমীচীন নয়। একজন অপ্রতিষ্ঠিত ও অপরিচিত লেখকের কবিতা একটি মেয়ের আচানকভাবে পাঠ করাটা অবশ্যই রহস্যজনক মনে হতেই পারে। সে রহস্যের কূল-কিনারা করা যায়নি। মেয়েটি কবিতা পাঠ করায় আমি যে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছি, এমনটি ভাবার কারণ নেই। তবে এটা ঠিক, ভালো তো অবশ্যই লেগেছে। আমার কবিতা অপরিচিতা কেউ একজন পাঠ করেছেন, এতে পুলকিত না হওয়ার কোনও কারণ নেই। তাৎক্ষণিকভাবে নিজেকে বেশ কবি কবি মনে হতে থাকে। তাছাড়া এত এত কবি থাকতে মেয়েটি কেন আমার কবিতা পাঠ করলেন, সেটাও খুব জানতে ইচ্ছে করছে। এক পলক দেখার ইচ্ছে যে করছে না, সেটা অস্বীকার করা হবে সত্যের অপলাপ। হায়! তাঁকে তো আমি চিনি না। দেখা হবে কীভাবে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন