পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৬

ঘুঙুরের কান্না

কী এক কারণে অনেক আগে থেকেই ভারতের লখনৌ শহরের প্রতি একটা অদৃশ্য টান অনুভব করি। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এ শহরে কখনও যাওয়া হয় নি। কখনও যাওয়া হবে কিনা তাও জানি না। কিন্তু শহরটিকে নিয়ে দীর্ঘ দিন যাবৎ বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে একটি শিরোনাম। যদি কোনও দিন সেখানে যাওয়া হয় এবং লেখার সুযোগ হয়, সে লেখার শিরোনাম হবে ‘ঘুঙুরের কান্না’। কেন এমন একটি শিরোনাম হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে, আমি এর ব্যাখ্যা দিতে পারবো না। মানুষের জীবনে ব্যাখ্যাতীত অনেক কিছুই ঘটে। এটাও কি তেমন কিছু? তবে এ শহরটি নিয়ে যখন কল্পনায় ছবি আঁকি, তখন দেখতে পাই, সুর আর সুরায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত রসিকজনেরা। আর তাঁদের তো মজিয়ে দিয়েছেন এ শহরের মশহুর আশেক মির্জা গালিব, ‘সুর আছে, ভেসে যাও সুরের স্রোতে; সুরা আছে, ভুলে যাও সব-কিছু। রূপসীর প্রেমে পাগল হয়ে যাও, সাধুতা থাক অন্যদের জন্য।’ স্বাভাবিক নিয়মে সন্ধ্যা নেমে এলেই গুলজার হয়ে ওঠতে থাকে বিভিন্ন মজলিশ। সরগরম হয়ে ওঠে গজলের মেহফিল, গানের জলসা আর বাঈজীদের জলসাঘর। কান পাতলেই শোনা যায় মীর তকি মীর, মির্জা গালিবের গজল। হাওয়ায় ভাসতে থাকে শের-শায়েরী। আর ঘুঙুরের ঝংকারের ভেঙে যায় রাতের নীরবতা। ‘ভুলভুলাইয়া’-র গোলকধাঁধায় লুকোচুরি খেলতে খেলতে ভেসে আসে আশিক-আশিকীদের খিলখিল হাসি। চারপাশে আতরের সুঘ্রাণ। গোলাপের বাগিচা। হরেক পদের কাবাব ও বিরিয়ানির মৌ মৌ খুশবু।

নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ’র তারিফদারিতে মশগুল লখনৌর সংগীত, নৃত্য, নাটক, কবিতার আসর। শতরঞ্জ নিয়ে গভীরভাবে মগ্ন খিলাড়িরা। জীবনকে সুরভিত করার কত রকম উপাদানই না রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কেন যেন মনে হয়, নবাব ওয়াজিদ আলী শাহকে ইংরেজরা বিতাড়িত করার পর শহরটিতে নেমে আসে থোকা থোকা বিষণ্নতা। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির এমন একটি প্রাণবন্ত ও প্রাণোচ্ছ্বল শহর হয়ে পড়ে অনেকটা নিস্প্রাণ ও নির্জীব। সব রওশন হারিয়ে শহরটা কেমন যেন বিষণ্নতায় ভুগছে। কবিতায়, সংগীতে, নৃত্যে ছুঁয়ে যায় অন্তহীন বিষাদ। বাঈজীদের ঘুঙুরে বাজতে থাকে উচ্চকিত কান্না। এমনিতে বাঈজীদের জীবন ট্র্যাজেডির শেষ নেই। নবাবহীন লখনৌ শহরটায় তাঁদের সেই কদর কোথায়? আশাভঙ্গের খেদ নিয়ে ঝিমিয়ে পড়ে ঘুঙুর। শহরটা যেন ধুঁকছে ক্ষয়িষ্ণু অবয়ব নিয়ে। আমার বুকের মধ্যে লখনৌ শহর এভাবেই জেগে আছে। এ শহরের ইদানিংকার হালহকিকত ঠিকমতো কল্পনায় আসে না। এ কি অতীতের প্রতি এক ধরনের হ্যাঙওভার? সেটাইবা হবে কেন? আমি তো এ শহরের কেউ না। তবে খুব জানতে ইচ্ছে করে, এখন কি আগের মতো লখনৌ শহর চঞ্চল হয় কথক নৃত্যের ঘুঙুরে? ঠুমরির কি কদর আছে? বেগম আখতার কিংবা তাঁর পরের প্রজন্মের কারও কণ্ঠে কি শুনতে পাওয়া যায় তকি, গালিব বা ওয়াজিদ আলীর গজল? গজল, ঠুমরি, শায়েরী ছাড়া তো এ শহরটাকে একদমই মানবে না। এ শহর তো আলোকিত হওয়ার কথা হিন্দি চলচ্চিত্রের সুরের রাজা নৌশাদ আলী, জাভেদ আখতার, অনুপ জালোটা, কবি কাইফি আজমির মতো ব্যক্তিত্বদের রোশনগিরিতে। নতুন প্রজন্মের কী বোর্ডে ওঠে আসার কথা বিরহ ও বেদনার কবিতা। থাকার কথা আভিজাত্য, খানদানি ও বনেদিয়ানার ঐতিহ্য। আমি তো এ শহরের অতীত ও বর্তমান কিছুই জানি না। তারপরও কেন যেন অতীতের লখনৌ আমাকে আবিষ্ট করে রাখে। সেই মোহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। আমার স্বভাবের মধ্যে কি লুকিয়ে আছে ওয়াজেদ আলী শাহ’র লখনৌ শহরের কোনও নস্টালজিয়া?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন