পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

শনিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৬

তবুও চিঠির অপেক্ষায়.....

‘বলেছিলে তাই চিঠি লিখে যাই কথা আর সুরে সুরে মন বলে তুমি রয়েছো যে কাছে, আঁখি বলে কতদূরে.....’ জগম্ময় মিত্রের গাওয়া এ গানটি যেন সুদূর থেকে ভেসে আসা কোনো মনোলগ। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বেজে চলছে নিরন্তন। সুরেলা এ চিঠির ছত্রে ছত্রে বিরহ আর ভালোবাসা মাখামাখি হয়ে আছে। এ গানের যখন জন্ম, তখন তো চিঠিই ছিল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। টেলিপ্রিন্টার আর টেলিফোন তো অধিকাংশ মানুষের হাতের নাগালে ছিল না। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনা, রাগ-অনুরাগ, পাওয়া না পাওয়া নিয়ে হৃদয়ের আকুতি জানিয়ে কালির আঁচড়ে সাদা কাগজের বুকে ফুটে ওঠতো অন্তরঙ্গ আলাপন। আমাদের বয়সীরা তো চিঠিকেই মনে করতেন সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রধান যোগসূত্র। শৈশবেই মেলবন্ধন গড়ে ওঠে হলদেটে ইনভেলাপ, মাটিরঙা পোস্টকার্ড, লাল-কালোর ডাকবক্স আর খাকি পোশাকের ডাকপিয়নের সঙ্গে। যদিও বাসায় চিঠি আসতো কালেভদ্রে। তারপরও চিঠির প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতাম। কোন দূর থেকে আজানা কথার মালা খামবন্দি হয়ে আসার মধ্যে যে রোমাঞ্চ ছিল, তার কোনো তুলনা হয় না। চিঠিতে থাকতো কখনো আনন্দ, কখনো শোকের বার্তা। তারপরও চিঠি ছিল পরম আকাঙ্খিত। অবশ্য সব চিঠি পাঠাতে তো আর ইনভেলাপ, পোস্টকার্ড ও ডাকবাক্সের প্রয়োজন পড়তো না। যে চিঠিগুলো লেখা হতো একান্ত মনের মানুষকে, তার আয়োজন ছিল অন্যরকম। নিরালায় লেখা হতো সেই চিঠি। কখনো সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, কখনো পড়ালেখা কিংবা অন্য কোনো কাজের ফাঁকে ফাঁকে। সেই চিঠির ভাষাও ছিল হৃদয়তন্ত্রী থেকে ওঠে আসা অনুভবের রক্তক্ষরণ। আর সম্বোধনটা হতো অনেক মধুর।


রঙিন কাগজ, সবুজ কালি আর নীল খামের মোড়কের সেই চিঠি। চিঠি তো নয়, যেন নিষিদ্ধ বৃক্ষের প্রলুব্ধকর মায়াবী আপেল। সবার চোখ এড়িয়ে দুরু দুরু বুকে সেই চিঠি পৌঁছে দিতে হতো প্রাপকের হাতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বইয়ের মধ্যে চিঠি ভাঁজ করে রেখে লেনদেন করা হতো। কেউ কেউ অবশ্য ঘনিষ্ট বা নির্ভরযোগ্য কোনও বাহকের মাধ্যমে চিঠি পাঠাতেন। চিঠির উত্তরের অপেক্ষায় থাকাটা ছিল সুখের মতো ব্যথা। চিঠি পাওয়ার পর গোপনে সেটি পড়ার সময় ভাবাবেগে স্পন্দিত হতো হৃদয়। আর সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া গানটি ছিল পরম প্রার্থিত : ‘চিঠি দিও প্রতিদিন, চিঠি দিও। নইলে থাকতে পারবো না। চিঠিগুলো অনেক বড় হবে পড়তে পড়তে সকাল-দুপুর আর রাত্রি চলে যাবে।’ স্কুল বয়সে চিঠি লেখাটাকে কি ইচড়ে পাকামি বলা যায়? সেই বয়সেই আমার মকশো হয় চিঠি লেখায়। তখন তো ছিল পত্রমিতালির যুগ। কারও কারও সঙ্গে কিঞ্চিৎ পত্র বিনিময় হয়। কীভাবে কীভাবে যেন বিশেষ একজনের সঙ্গে চিঠির লেনদেন হয়ে যায়। সমবয়সী দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা ছিল না প্রেম, না বন্ধুত্ব ধরনের। আসলে ঠিক তাও নয়। নৈর্ব্যক্তিক এ সম্পর্কে শুধু মনের কথা ব্যক্ত করাই ছিল চিঠি লেখার উদ্দেশ্য। প্রকৃতপক্ষে ব্যতিক্রমধর্মী সেই সম্পর্কটার কোনও ব্যাখ্যা হয় না। সেই চিঠিগুলো রেখে দিয়েছিলাম পরম যত্মে। কিন্তু বাসা বদলের ধাক্কায় হারিয়ে গেছে সব। (নাকি কেউ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে ডাস্টবিনে?)। হারিয়ে ফেলেছি আমার কৈশোর আর তারুণ্যের গন্ধমাখা কিছু আবেগ। তারপর তো পত্র-পত্রিকায় চিঠিপত্র লেখাটা নেশায় পরিণত হয়। প্রতিদিন কোনও না কোনও পত্রিকায় চিঠি লিখতাম। কত কত বিষয়। যা লিখতাম, তার অধিকাংশই অপ্রকাশিত থেকে যেত। তাতে মোটেও হতোদ্যম হইনি। কিন্তু ক্রীড়া লেখালেখির জগতে ঢুকে পড়ার পর চিঠি লেখার আগ্রহ যেন হারিয়ে যায়। অবশ্য চিঠি লেখার ইচ্ছেটা বুকের মধ্যে সুপ্ত থাকলেও মনের নিভৃতকোণের কথা জানানোর জন্য তেমন কাউকে পাওয়া যায় নি। তখন তো সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা কেটে যায় স্টেডিয়াম পাড়ায়। গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব আর সম্পর্কের নতুন বন্ধন। কিন্তু কাছের সেই মানুষরা একে একে বিদেশে পাড়ি জমাতে থাকলে আমি অনেকটাই নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে থাকি। তাঁরাও বোধকরি সেটা অনুভব করতে পেরেছিলেন। সে সময় সিঙ্গাপুরে নকিব আহমেদ নাদভী (এখন কানাডায়), ইংল্যান্ডে দিলু খন্দকার, আয়ারল্যান্ড পরে সৌদি আরবে জিয়াউল করিম লোটাস (এখন যুক্তরাষ্ট্রে), জাপানে নজমুল আমিন কিরণ, কানাডায় ফরহাদ মান্নান টিটো, কাজী আলম বাবু, সৌদি আরবে ইকবাল কবীর প্রমুখের সঙ্গে পত্র বিনিময় হয়। তাতে ওঠে আসে অনেক সুখ-দুঃখের কথা। সেই চিঠি লেখাও একসময় থেমে যায়। তারপর কাগজ-কলমে আর চিঠি লেখা হয় নি। এরপর তো এলো ইন্টারনেটের যুগ। ফেসবুকের মতো ভার্চুয়াল জগতে মুঠোবন্দি হয়ে যায় পুরো দুনিয়া। এর দাপটে চিঠি লেখার চল বলতে গেলে ওঠেই গেছে। এরসঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। চেনা-অচেনা কত মানুষের অদৃশ্য পৃথিবী। চোখের পলকেই দূরের মানুষ চলে আসেন কাছে। যদিও আমি এ ব্যাপারে তত দক্ষ নই, তারপরও একজনের সঙ্গে যোগাযোগ হলো ইন্টারনেটে। ভাগ্যরেখা যে কখন কোনদিকে টেনে নিয়ে যায়, কেউ বলতে পারেন না। তবে যোগাযোগের শর্ত ছিল আমরা পরস্পরকে চিঠি লিখবো।


সেই চিঠিতে থাকবে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ। সেও রাজি হলো। অব্যক্ত কত কথাই তো লিখতাম। কিন্তু ভার্চুয়াল চিঠিতে সেই মৌলিক স্বাদ থাকে না। স্পর্শ থাকে না। গন্ধ থাকে না। এর কারণ, তাতে কাগজ, কলম, খাম, ডাকবক্স, ডাকপিয়নের ভূমিকা থাকে না। চিঠির লেনদেন হয় ইমেইলের মাধ্যমে। তারপরও দুধের স্বাদ অন্তত ঘোলে তো পেতাম। মনের কথাগুলো তো আর মিথ্যে ছিল না। কেন যেন সেই যোগাযোগটাও আর থাকলো না। ‘যত লিখে যাই তবু না ফুরায়, চিঠি তো হয় না শেষ- চিঠি নিয়ে আমার আক্ষেপ আজও ঘুচলো না। আমি বড্ড চিঠির কাঙাল। এর একটা কারণ হতে পারে, কথা-বার্তায় আমি মোটেও সাবলীল নই। অনেক বেশি শাই। কিন্তু চিঠিতে নিজেকে উম্মুক্ত করে দিতে আমরা কোনও জড়তা নেই। পত্রমিতালী আমার পছন্দের একটি বিষয়। এ কারণে খুব করে চাই কেউ আমাকে চিঠি লিখুক। জোছনায়, বৃষ্টিতে, বসন্তে। প্রতিদিন। তাতে থাকুক কাঁপা কাঁপা হাতের লেখা, লেপটে যাওয়া কালিতে মুছে যাওয়া অক্ষর, দুমড়ানো-মুচড়ানো কাগজ। থাকুক ঘামের গন্ধ, লিপস্টিকের ছোঁয়া, গোলাপের পাপড়ি। নীল কাগজে, নীল খামে, কোনও এক নীল সকালে পৌঁছে যাক পরম কাঙ্খিত সেই চিঠি। কবি মহাদেব সাহা’র মতো তীব্র আকুতি নিয়ে বলতে চাই, ‘চিঠি দিও’ ঃ ‘করুণা করে হলেও চিঠি দিও খামে ভরে তুলে দিও আঙ্গুলের মিহিন সেলাই। ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও, একটু সামান্য দাবি চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি। ......

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন