১.
আমার জন্ম গ্রামে নানী বাড়িতে, আঁতুরঘরে দাইয়ের হাতে। ষাট দশকের মাঝামাঝি, মধুমতি নদীর তীরে। জন্মের দেড়-দুই বছরের মধ্যে ঢাকা শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস। শরীরে গ্রামের মাটির সোঁদা গন্ধ লেগে থাকলেও বেড়ে ওঠা শহরের আলো-হাওয়ার পরশে। আমাকে নিঃসন্দেহে এ শহরের স্থায়ী বাসিন্দা বলা যেতে পারে। গত চার দশকেরও বেশি এ শহরের পরিবর্তনের ছোঁয়া কিছুটা হলেও অনুভব করতে পেরেছি। আমাদের শৈশব-কৈশোরে পরিবর্তন এলেও তার একটা ধারাবাহিকতা ছিল। কোনো কিছুই বড় কোনো ধামাকা হয়ে আসে নি। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। সীমিত আয়। সীমিত ব্যয়। বাড়তি কোনো চাহিদার সুযোগ ছিল না। স্বাধীনতার আগে পুরানো ঢাকার শেখ সাহেব বাজার, সিদ্ধেশ্বরী, শাহজাহানপুর, মতিঝিল কলোনির ভাড়া বাসায় বসবাস করলেও স্বাধীন বাংলাদেশে একদম শুরু থেকেই থিতু হই ‘দ্বিতীয় রাজধানী’ খ্যাত শের-এ-বাংলা নগরের সরকারি কলোনিতে। শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে বসবাস করায় সে সময়কার নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে খুব একটা বঞ্চিত ছিলাম না। যদিও জীবনযাপন মোটেও ঝলমলে ছিল না। তবে এলাকার সবার সঙ্গে সবার কম-বেশি যোগাযোগ ছিল। আত্মীক সম্পর্ক ছিল। বিপদে-আপদে সবাই এগিয়ে আসতেন। সেই সময় রেশন থেকে চাল-আটা-তেল-চিনি না তুলে চলার উপায় ছিল না। রেশনকার্ড দিয়ে সেটা তুলতে যথেষ্ট বেগ পেতে হতো। এই ঢাকা শহরেই ছোটবেলা মাদুর বা পিঁড়িতে বসে খাওয়া-দাওয়া করতাম। হাফ প্যান্ট দিয়ে শুরু হলেও একটু বড় হওয়ার পর লুঙ্গি হয়ে ওঠে আরামদায়ক বসন। পোশাক-পরিচ্ছদ খুব বেশি ফ্যাশনদুরস্ত ছিল না। ঈদ উপলক্ষে এক প্রস্তু নতুন জামা-কাপড় পরিধান করলেও এর বাইরে তেমন বায়না ছিল না। মা-খালাদের সুতি শাড়িতে কেটেছে দিনের পর দিন। সালোয়ার-কামিজ পরতে দেখি নি। ঈদের দিন ছাড়া অন্য সময় সচরাচর সেমাই-পোলাও-কোর্মার দেখা মিলতো না। সাজ-সজ্জার জন্য তিব্বত স্নো-পাউডার-কাজল-ভ্যাসলিনই ছিল প্রধান উপকরণ। উৎসব না এলে অন্তত ছেলেদের ক্ষেত্রে গায়ে দেওয়ার সাবান খুব একটা সুলভ ছিল না। কাপড় কাচার জন্য ছিল ৫৭০ সাবান আর জেট পাউডার। বাসার কাপড়ধোয়া, ঘরমোছা, ঝাড়– দেওয়ার কাজের জন্য পার্টটাইম বুয়া রাখা হতো। আঙ্গুলে পাউডার লাগিয়ে দাঁত মাজতাম। ঈদের দিন আতর মাখানোটাই ছিল একমাত্র সুগন্ধি ব্যবহার। জন্মদিন উদযাপনের কোনও রীতি ছিল না। পকেটমানির প্রশ্নই আসে না। সেটা নানা কৌশলে সংগ্রহ করতে হতো। অনেক দূরের স্কুলে যেতাম হেঁটে হেঁটে। প্রাইভেট টিউটর সুলভ ছিল না। অসুখ হলে সরকারি ডিসপেনসারিতে যেতে হতো। দেওয়া হতো নানা রঙের সিরাপ। বোতলে দাগ কাটা থাকতো। সেই অনুপাতে খেতে হতো। জ্বর হলে সাগু-বার্লি খাওয়াটা ছিল বাধ্যতামূলক। আপেল-আঙ্গুর-কমলা তখন খানদানি ফল। সহসা তার নাগাল পাওয়া যেত না। হরলিক্সও ছিল পরম কাক্সিক্ষত।
সিগারেট প্যাকেট দিয়ে তাস খেলা, সাতচাড়া, ডাংগুলি, মার্বেল, ঘুড়ি উড়ানো ছিল প্রিয় খেলা। ফুটবল, ক্রিকেটও ছিল। তবে খেলার মাঠ, পার্ক ও আকাশ ছিল অবারিত। রোদেও পুড়েছি, বৃষ্টিতেও ভিজেছি। অনিয়মও করেছি। আমাদের নাগালের মধ্যে ছিল স্যাকারিন আর বরফ দিয়ে বানানো দুই পয়সার লাল-সবুজ আইসক্রিম, ঝালমুড়ি আর নানা পদের আচার। খাওয়া-দাওয়ায় খুব বেশি বৈচিত্র্য না থাকলেও তাতে অবশ্য ফরমালিন ছিল না। আর মাঝে-মধ্যে দেখা পাওয়া যেত বায়োস্কোপওয়ালার। এলাকায় টেলিভিশন ছিল দু’একটি বাসায়। কৃষি কলেজের মিলনায়তনে গিয়ে সাদা-কালো টেলিভিশন দেখতাম। তবে বাসায় ছিল রেডিও। সেটাই ছিল বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। তাতে অনুরোধের আসর, নাটক, সৈনিক ভাইদের জন্য ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘দুর্বার’ শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম। হলে গিয়ে সিনেমা দেখা হতো কালেভদ্রে। কমিউনিটি সেন্টারে পাঠাগার ছিল। নাটক আয়োজিত হতো। বেড়াতেও খুব একটা যাওয়া হতো না। বছরে এক-আধবার আত্মীয়-স্বজনের বাসায় যাওয়া হতো। এ ক্ষেত্রে বেবি ট্যাক্সি বা রিক্সাই ছিল প্রধান বাহন। বাসায় আত্মীয় কেউ এলে নিয়ে আসতেন নাবিস্কো বিস্কুট, চকলেট কিংবা গোলপাতায় রসের মিষ্টি। তবে স্কুলের ছুটিতে বছরে এক কি দু’বার গ্রামে বেড়াতে যেতাম। এ কারণে গ্রামের প্রতি একটা টান রয়েই গেছে। গাড়িওয়ালা কোনো আত্মীয় কারো বাসায় এলে সেটা ছিল এলাকার সাড়া জাগানো ঘটনা। কাছাকাছি কেউ বিদেশে গিয়েছে, সে সময় খুব একটা শোনা যেত না। ঈদ ছাড়া খুব একটা উৎসবের দেখা মিলতো না। আর সেটাও খুব বেশি ঝলমলে ছিল না। বাংলা নববর্ষ উদযাপন তো দূরে থাক, আমাদের এলাকায় জাতীয় কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন নিয়মিত চোখে পড়তো না। কাছাকাছি এলাকার মধ্যে আজিমপুরে বৈশাখী মেলার উত্তাপ পেতাম। বইমেলাও তখন জমে ওঠে নি। আর জাতীয় পর্যায়ে তো বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতোই। তা ছিল আমাদের নাগালের বাইরে।
২. আমার দুই পুত্রের জন্ম ঢাকার নার্সিং হোমে। দু’জনেই সিজারিয়ান। একজন মাধ্যমিকের গণ্ডি অতিক্রমের অপেক্ষায়। আরেকজন প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়েছে। যদিও মন-মেজাজে দু’জন দুই ভিন্ন মেরুর। তবুও তাদের বেড়ে ওঠা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার খুব একটা হেরফের নেই। এ শহরের ইট-বালু-সিমেন্টের সঙ্গেই তাদের মেলবন্ধন। সবুজের দেখা মেলে না। গ্রামের সঙ্গে একদমই যোগাযোগ নেই। যে এলাকায় থাকে, সেখানে খেলার মাঠ নেই। তাই সেখানে তাদের যাওয়ার সুযোগও নেই। ফ্ল্যাটের কারও সঙ্গেও তেমন যোগাযোগ নেই। অনেকটাই বন্দি জীবনের মতো। এ কারণে প্রায়শই ছটফট করে। ডাইনিং টেবিলে খাওয়া ছাড়া এখন তো চিন্তাই করা যায় না। অবশ্য তারা ড্রয়িংরুমে রঙিন টেলিভিশন দেখতে দেখতে খেতে অভ্যস্ত। এলসিডি টেলিভিশন না হলে নাকি মজা পাওয়া যায় না। কম্পিউটার ছাড়া তো প্রতিদিনের জীবন চিন্তাই করা যায় না। সারাক্ষণই গেমস চলছে। অল্প বয়সেই একজনের চোখে চশমা। মোবাইল ফোনে গড়ে ওঠেছে নিজস্ব নেটওয়ার্ক। ইন্টারনেটের কারণে দুনিয়াটা খুব একটা দূরের নয়। আড়ালে-আবডালে ব্যবহার করে ফেসবুক। নতুন নতুন মডেলের মোবাইলের প্রতি টান তো আছেই। তথ্যপ্রযুক্তিতে কিছুটা আগ্রহী। ঈদে একাধিক সেট পোশাক অবশ্যম্ভাবী। তার মধ্যে ব্র্যান্ডের পোশাক থাকতে হবে। এছাড়া সারা বছর নতুন নতুন ড্রেস লেগেই থাকে। রাতের পোশাক আলাদা। এখন তো নতুন নতুন উৎসব। তার সঙ্গে তাল মেলাতে হয়। কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতেও নতুন ড্রেস না হলে চলে না। ড্রেসের সঙ্গে মানানসই কম্বিনেশন। পারফিউম, বডি স্প্রে তো থাকতেই হবে। প্রতিদিন গায়ে সাবান মাখতে হয়। টুথব্রাশের সাথে দামি পেস্ট দিয়ে দাঁত মাজাটাই এখন প্রচলিত। চোখে পড়ার মতো হেয়ারস্টাইল, সানগ্লাস। মায়ের তো নিত্য-নতুন কেনাকাটা আছেই। বদলে যায় ঘরসজ্জা। মাঝে-মধ্যে বাইরের হাল-আমলের রেস্তোরাঁয় না খেলে স্ট্যাটাস থাকে না।
আর বন্ধুদের সঙ্গে পিজ্জা, বার্গার খেতে যেতে হয়। হাতখরচার একটা ব্যাপার আছে। অন্তত পারিবারিকভাবে জন্মদিন পালন করতে হয় ঘটা করে। কোনো উপলক্ষ ছাড়াই পোলাও-কোর্মার আব্দার রক্ষা করতে হয়। বাসায় একজন কাজের বুয়া দিয়ে চলে না। বুয়াদেরও কাজের রেট বেশ বেড়েছে। বেড়েছে স্ট্যাটাসও। এক এক কাজের জন্য এক এক রেট। এখন তো অসুখেরও কোনও লাগাম নেই। লেগেই থাকে। এজন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। তাছাড়া কথায় কথায় প্যারাসিটামলসজাতীয় বিভিন্ন ট্যাবলেট, ক্যাপসুল খাওয়াটা মামুলি একটা ব্যাপার। কেউ রোদে পুড়তে চায় না। চায় না বৃষ্টিতে ভিজতেও। আপেল-আঙ্গুর-কমলা খাওয়ার খুব একটা আগ্রহ নেই। মুচমুচে চিপস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর চিকেন ফ্রাই পেলে আর কিছু না হলেও চলে। নাগালের মধ্যে পাঠাগার নেই। নাটক নেই। সিনেমা নেই। দৈনিক পত্রিকা, গল্পের বই-পত্র পড়ার খুব একটা আগ্রহও নেই। স্টেডিয়ামে গিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ দেখার ঝোঁক আছে, কিন্তু সুযোগ হয় না। একজন প্রাইভেট টিউটর দিয়ে চলার প্রশ্নই আসে না। আছে বিভিন্ন কোচিং। বন্ধুদের অনেকেই নাকি এক একটা বিষয় এক একজন টিচারের কাছে পড়ার জন্য ছুটে যায়। এসএসসি’র সীমানা টপকানোর আগেই ব্যয়বহুল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পরিকল্পনা। বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ তো এখন ডালভাত। এর মধ্যে ঘটনাচক্রে একবার বিমানে প্রতিবেশী দেশে ঘুরে আসা হয়েছে। সেটাও খুব একটা মন রাঙাতে পারে নি। ইউরোপ-আমেরিকার প্রতি একটা টান আছে। দুই ফুফুই থাকে দেশের বাইরে। সেটাও অন্যতম আকর্ষণ। রাস্তা-ঘাটে একটুও হাঁটতে রাজি নয়। পিতা ক্যারিসমেটিক না হওয়ায় নিজস্ব ফ্ল্যাট নেই। গাড়ি নেই। এ কারণে আক্ষেপ আছে। মনস্তাপ আছে। অবশ্য পিতার সঙ্গে ছুটির দিন ছাড়া সন্তানদের দেখা-সাক্ষাৎ কম হয়। তাছাড়া দুই প্রজন্মের মধ্যে কেন জানি অজানা একটা দূরত্ব রয়ে যায়। যে কারণে তাদের মনের একান্ত কথা খুব একটা জানা হয় না। সন্তানদের মনোভাব সম্পর্কে যেটুকু অনুভব করতে পারা যায়, সেটাই তুলে ধরা হলো।
এমন একটা রূপান্তরিত সমাজ কাঠামোয় কেউ কেউ যখন বলেন, বাংলা নববর্ষ আমাদের ঐতিহ্য নয়। অতীতে খুব বেশি ঘটা করে তা উদযাপন করা হয় নি। এখন কেন এই আদিখ্যেতা? এ ধরনের কথার কোনো গুরুত্ব আছে বলে মনে হয় না। বাংলা নববর্ষ অবশ্যই আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। একদম অতীতের কথা বাদ দিলেও সেই বাদশাহ আকবরের আমল থেকে এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যাবে না। অতীতে হয়তো এখনকার মতো জমকালোভাবে উদযাপিত হয় নি। শুধু বাংলা নববর্ষ কেন, এই সেদিনও আমাদের কোন উৎসব অনেক বেশি জমজমাট ছিল? বলতে গেলে কোনোটাই ছিল না। আসলে সেই সামর্থ্য, সেই মনমানসিকতাই ছিল না। অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবিত্তের রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাব বদলে যাওয়ায় উৎসবগুলো দিনে দিনে অনেক বেশি আনন্দময় হয়ে ওঠছে। বাড়ছে বৈচিত্র্য। যোগ হচ্ছে নতুনত্ব। যে কোনও পর্যায়ের অনুষ্ঠানই সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছে। এমনকি বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচও হয়ে ওঠেছে উৎসবের উপলক্ষ। তবে জনসংখ্যাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। লোকসংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি বাড়ছে উৎসবের ব্যাপ্তি ও বিশালত্ব। আমাদের দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর বসবাস। তাছাড়া অসাম্প্রদায়িক একটা চেতনা নিয়ে এই বাংলাদেশের জন্ম। সে কারণে সর্বজনীন উৎসব হয়ে ওঠার সব অনুষঙ্গই আছে বাংলা নববর্ষে। এ উৎসবের বিস্তার ও জাগরণ ঘটছে শুধু এই শহরেই নয়, পুরো দেশেই। এটি যত বেশি বিস্তৃত হবে, যত বেশি ঘটা করে উদযাপিত হবে, যত বেশি মানুষকে আকৃষ্ট করবে, ততই এগিয়ে যাবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন