মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি
এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

শনিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৬
তুমি কি আমার বন্ধু হবে
রবিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৬
ক্যানভাসে শীতের অনুভব
সব ঋতু মোটামুটি একইভাবে কেটে যেত। খুব একটা পার্থক্য বুঝতে পারতাম না। কখনও সহনীয় গরম। কখনও অসহনীয় গরম। কখনও ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি। কখনও মুষলধারে বৃষ্টি। কখনও রঙধনু আকাশ। কখনও মেঘলা আকাশ। প্রকৃতির শান্ত রূপ যেমন দেখেছি, তেমনি দেখেছি মহা চোটপাটও। এটাকে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার মনে হতো। মনে তেমন একটা ছাপ ফেলতো না। সেই বয়সে সৌন্দর্যবোধ এতটা ছিল না। রোমান্টিকতা ছিল না। বুদ্ধিমত্তাও শাণিত ছিল না। এমনিতেই আমার বুদ্ধি শার্প ছিল না। (এখনও আগের মতোই আছে।) মস্তিক্সের অ্যান্টেনা কোনো কিছু সহজে ক্যাচ করতে পারতো না। সবাই যেটা চট করে বুঝতে পারে, আমি সেটা পারতাম না। কোনো কিছু বুঝতে বুঝতেই সময় পেরিয়ে যেত। যে কারণে প্রকৃতির রূপ বদলের মর্ম বুঝতে পারতাম না। এখনও খুব যে চালাক-চতুর হতে পেরেছি, সেটা বলা যাবে না। তবে প্রকৃতির বহিরঙ্গের পরিবর্তনটা অন্তত ধরতে পারি। শারীরিক ও মানসিক কারণেও টের পেয়ে যাই। তাছাড়া বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধি কি একটু খোলতাই হয়েছে? ঠিক জানি না।
তবে বোধহীন সেই বয়সে একমাত্র বুঝতে পারতাম শীতকালকে। না বুঝে উপায়ও ছিল না। এ ঋতুটি একদমই অন্যরকম। তার কুহক, তার মায়াময়তা, তার সৌন্দর্য আবিষ্ট করে দিয়েছে। তবে তার পাতাঝরার কান্না বুকের মধ্যে ছড়িয়ে দিত বিষণ্নতা। প্রকৃতিকে যখন উত্তরের হাওয়া বইতে শুরু করতো, তখন ঠিকই টের পাওয়া যেত। আর হাড়কাঁপানো কনকনে শীত তো তার দাপট দিয়ে তার আবির্ভাব কাউকে না বুঝিয়ে ছাড়তো না। প্রত্যুষের কুয়াশা, ভোরের শিশির আর সকালের মিষ্টি নরম রোদের কোনো তুলনা ছিল না। থরে থরে সাজানো প্রকৃতির এ আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃত্ত না হয়ে কি পারা যায়? কুয়াশার কারণে মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হওয়ার সহজাত চুল্লি ছিল বেশ মজাদার। পায়ে পায়ে ঘাসের শিশির মাড়িয়ে যাওয়াটা ছিল পুলকজাগানিয়া। মুক্তোর মতো দেখতে টলমলে শবনম মুখে মাখালে মনে হতো ঔজ্জ্বল্য বুঝি অনেকখানি বেড়ে গেল। শরীরে মিষ্টি রোদের আদর খাওয়াটা আমার কাছে মনে হয়েছে স্বর্গীয় একটা ব্যাপার। এমন মুহুর্তের জন্য চিরকাল মুখিয়ে থাকা যায়।
শীতের রংচঙে পোশাকের কারণে শরীরটাও হয়ে ওঠে রংদার। মনটাও প্রজাপতির মতো রঙিন। চারপাশে যেন আনন্দের পসরা সাজানো থাকে। অনুভবটা হয় এমন : ‘ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো’। চলায় আনন্দ। ঘুরায় আনন্দ। খেলায় আনন্দ। এমনকি খুব বেশি দূরে না গেলেও মনটা প্রফুল্ল হয়ে ওঠেছে। প্রিয়জনের সঙ্গে একই রিক্সায় একই চাদরের আড়ালে উষ্ণতা ভাগাভাগি করে নেওয়াটা ছিল রোমাঞ্চকর। খাওয়াদাওয়া করতেও মজা লেগেছে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, টমেটো, বরবটি, মুলা, লাউ, লাল শাক, পুঁই শাক, পাট শাক, কলমি শাক, ডাটা শাক, মুলা শাক, সরিষা শাক সহ টাটকা শাক-সব্জির কদরই ছিল আলাদা। স্বয়ংক্রিয় বাবুর্চির অদৃশ্য ছোঁয়ায় সব খাবারের সোয়াদও যেন বেড়ে যেত। অবশ্যই পরিবেশিত খাবার গরম গরম হতে হতো। ঠাণ্ডা হয়ে গেলে এরচেয়ে বিস্বাদ খাবার আর কিছু ছিল না।
রাতে ঘুমটাও হয়েছে গভীর। বিছানায় লেপ-তোশকের ওম যে কি আরামদায়ক! যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়েছে জীবনের অনাবিল সুখ। তবে সকাল বেলা এই উষ্ণতা ছেড়ে ওঠে আসাটা জীবনের একটি কঠিনতম কাজ মনে হতো। যেন প্রিয়তমার নিবিড় আলিঙ্গন ছেড়ে অনিচ্ছা নিয়ে সরে যাওয়া। আর শীতল পানি দিয়ে হাত-মুখ ধোয়াও ছিল দণ্ড ভোগ করার মতো। শীতকালে রাতের বেলা আলো জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলার ধুম পড়ে যেত। পাড়ায় পাড়ায়। এমনকি বাড়ির আঙ্গিনায়ও।
গ্রামের বাড়িতে শীতকালটা ছিল আরো বেশি উপভোগ্যময়। যখন খুব ভোরে গ্রামের ঘুম ভেঙে যেত, তখন প্রকৃতির মাধুর্য বুকের মধ্যে সুখের কাঁপন ধরিয়ে দিত। শুনতে পাওয়া যেত শিশিরের শব্দ। উত্তরীয় দিয়ে শরীর মুড়িয়ে ঘরের বাইরে পা দিলে কুয়াশার মিহি রেশমি চাদরে ঢাকা প্রকৃতি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠতো। উদীয়মান সূর্য আর কুয়াশার মিথস্ক্রিয়ায় যে দৃশ্যপট দৃশ্যমান হতো, এমন জীবন্ত ছবি কোনো শিল্পীর তুলিতে প্রস্ফুটিত হওয়া সম্ভব নয়। অপার্থিব এক মায়াবী জগত। কী যে নিষ্পাপ, কী যে পবিত্র, কী যে বিশুদ্ধ। মনটাকেও পরিশুদ্ধ করে দিত। কুয়াশাও এক ধরনের জাদুবাস্তবতা। তার ভেলকিতে অদৃশ্য হয়ে যেত ঘরবাড়ি-নদনদী-বিস্তীর্ণ প্রান্তর। আবার তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে একটু একটু করে ম্যাজিকের মতো আড়াল থেকে দৃশ্যমান হতো। সরিষার ফুলে ফুলে হলুদ হয়ে ওঠতো বিস্তৃত ভূমি। পাখিদের মনেও যেন রংয়ের ছোঁয়া লাগতো। ছড়িয়ে দিত চঞ্চলতা। ছড়িয়ে দিত সুরেলা আমেজ।
বেহেস্তি শরাব কি খেজুরের রসের মতো? ঘুম থেকে ওঠে চুমুক দেওয়ার পর মনে হয়েছে পান করছি শরাবন-তহুরা। তার মৌতাত যেন কাটতেই চাইতো না। আগুনের কুণ্ডুলী জ্বালিয়ে উত্তাপ নেওয়া কিংবা রান্নাঘরের চুলার আগুনে ভাঁপ নেওয়ার সময় সঞ্চালিত হয়েছে রক্তের প্রবাহ। ফসল কাটার পর জমিতে নাড়ার আগুনে কলুই পুড়িয়ে খাওয়া ছিল অন্যরকম আনন্দ। সের বা ডুলায় (বেতের তৈরি) করে পাটালি বা ঝোলা গুড় দিয়ে হুড়ুম বা মুড়ি খাওয়ার মজাও কম ছিল না। গরম ডিম সিদ্ধ, মোয়া, ভাঁপা, চিতই সহ রসের বা রকমারি পিঠাপুলি, পায়েসের ব্যঞ্জন ছিল যেন অমৃত। স্বল্প পানির খাল কিংবা বিলে সংঘবদ্ধ হয়ে পোলো দিয়ে একতালে মাছ ধরার ঐকতান বাঙালির ঐতিহ্যের অংশ। কই মাছ, শোল মাছ, টাকি মাছ, বাইন মাছ, শিং-এর মতো জিওল মাছ ধরতে পারার ধকল কিন্তু কম ছিল না।
শীতের বিপরীত চিত্রও ছিল। যা মোটেও রোমান্টিক নয়। গরীবদের অসহায়তা, দুর্ভোগ ও দুর্দশাও অবলোকন করতে হয়েছে। একটু উষ্ণতা, একটু আশ্রয়, একটি গরম কাপড়ের জন্য তাঁদের উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষার কত চিত্রই তো আমাদের চোখের সামনে দেখতে পেয়েছি। আর সংবাদপত্রের পাতায় পাতায়ও তা গুরুত্বসহকারে শোভা পেয়েছে। দেখা দিত ঠাণ্ডা জাতীয় রোগ। প্রকোপ বাড়তো সর্দি-কাশি-জ্বরের। তখন শীতকালটাকে অভিশাপের মতো মনে হয়েছে। তাছাড়া কখনও কখনও অকারণেই ছুঁয়ে যেত বিষণ্ণতা। তারপরও সেই বয়সে শীতকালটা ছিল আনন্দের। উপভোগের। উল্লাসের।
অতীতের চিত্রপটে শীতকালের যুগপৎ এই ছবি হৃদয়পটে স্থায়ী হয়ে আছে। এখন তো আগের মতো সেই শীত নেই। সেই সবুজ নেই। সেই প্রকৃতিও নেই। শহরে এখন আর নিয়মিত তেমনভাবে তীব্র শীত নামে না। শিশিরের দেখা পাওয়া যায় না। শীতের পাখিও আসে না। তবে যা যা আসে তা হয়তো আমার চোখে ভাসে না। আমারও তো সেই শৈশব নেই। সেই কৈশোর নেই। সেই তারুণ্য নেই। যে কারণে এখনকার শীত হয়তো আমার মনে সেই উচ্ছ্বাস নিয়ে আসে না। সেই আনন্দ পাই না। সেই ভালোবাসাও পাই না।
আর গ্রামের সঙ্গে সম্পর্কটা অনেকটাই অপস্রিয়মাণ। বলতে গেলে কোনো যোগাযোগই নেই। তবে দূর থেকে যেটুকু অনুভব করি, গ্রামও তো এখন শহর হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। সেখানেও শীতের তীব্র কামড় নেই। পিঠাপুলির তেমন কদর নেই। মাছের সমাগমও নেই। নদী-নালা-খাল-বিলই তো হারিয়ে যাচ্ছে। তাহলে শীতইবা আসবে কীভাবে? বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি। বদলে যাচ্ছে শীতকালও। শীতকালটা তাই হয়ে আছে নস্টালজিয়ায় আঁকা ক্যানভাসের ছবি। ক্যাটালগ উল্টিয়ে উল্টিয়ে আপন মনে তাকে কখনও কখনও খুঁজি।
রবিবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৬
সূর্যস্মান
বুকের মধ্যে অভিমানের মেঘ জমলে তার পরিণতি কী হয়, আমি ঠিক জানি না। তবে তার খেসারত দিতে হয় বেশ ভালোভাবেই। যেমনটি আমাকেও দিতে হচ্ছে। সোনা যতই পোড়ানো হয়, ততই নাকি খাঁটি হয়। মানুষ পুড়লে নিকষিত হেম হয় কিনা জানি না। তবে পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যেতে হয়। অনেক দিন যাবৎই আমি ভালো নেই। আমার মন ভালো নেই। সঙ্গত কারণে ঈদ উপলক্ষে আমার কোনোরকম তৎপরতাই ছিল না। কোনো কিছুতেই আমার আগ্রহ ছিল না। লীলাবতির সঙ্গে কথা ছিল, সে কথা রাখে নি। সে কথা রাখেও না। তার কারণে সব কিছুই থেকে আমি নিজেকে গুটিয়ে নেই। এ নিয়ে বাসায় মনোমালিন্য হয়। সেটা আমি পাত্তাই দেই নি। তারপরও আমার জন্য ঈদের নতুন পোশাক কেনা হয়, তখনই আমি বলেছি, এটা কেনা হলে আমি পরবো না। ক’দিন যাবৎ সম্পর্কের বেশ অবনতি ঘটে। কথা-বার্তা বন্ধ। আজ সকালে খুব তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যায়। এটা ইদানিং নিয়মিতই হচ্ছে। ঘুমই হতে চায় না। এর কারণ, লীলাবতি। তার কারণে আমি শান্তিতে থাকতে পারছি না। সকালে গোসল করার পর আমাকে নতুন পোশাক পরতে দেওয়া হলে আমি নাকচ করে দেই। বাসার ছোটদের দিয়েও অনুরোধ করা হয়। সেটাও প্রত্যাখ্যান করি। ওমনি ক্ষেপে যায়। যা নয় তাই বলতে থাকে। এমনও বলে, দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ ও মিশুকের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলেও আমার মতো অখ্যাতদের কেন অপমৃত্যু হয় না? এটা শোনার পর মেজাজ হারিয়ে ফেলি। গালাগালি করি।
ইচ্ছে করেই কালো প্যান্ট ও কালো গেঞ্জি পরে বাসা থেকে বের হয়ে যাই। অনেক দিন ধরে শেভও করা হয় না। বাসার কাছে সকাল পৌনে নয়টায় নামাজ শেষ করে গন্তব্যহীনভাবে হাঁটতে থাকি। কারো সঙ্গে কোলাকুলিও করা হয় না। সকালে এক চুমুক পানিও খাওয়া হয় নি। ঘরে-বাইরে আমি এক জটিল সময় অতিক্রম করছি। এ থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছি না। পারবো কীভাবে? আমার মন আমাকে পারতে দিচ্ছে না। সিদ্ধান্ত নেই, নিজেকে যতটা পারি পুড়াবো। পুড়িয়ে যদি নিজের ভিতরের সব রাগ-ক্ষোভ-যন্ত্রণা-কষ্ট-অভিমান-ব্যথা-বেদনা গলিয়ে দেওয়া যায়! তেমন একটা ইচ্ছে নিয়ে আমি হাঁটতে থাকি। প্রথমদিকে ছিল রোদ-ছায়ার লুকোচুরি খেলা। একটু একটু করে ঘামতে থাকি। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দুর্গন্ধে পেট গুলিয়ে আসতে চাইছিল। হাউজিং হয়ে বছিলার দিকে যেতে থাকি। বছিলা সড়কে ওঠার পর আগুনের তাপ বের হচ্ছিল। আমি কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে সূর্যের তরল সোনায় অবগাহন করতে থাকি। এমনিতেই আমি কালো, সূর্যের আগুন আমাকে করে তোলে কৃষ্ণাঙ্গ।
ঘুমিয়ে থাকা কবিতা
নান্দনিক মরীচিকা
কবিতার নন্দনকানন
কে তুমি কবিতাকন্যা
বেদনার অশ্রুপাত
তোমার পোড়া গোপন চিহ্ন
প্রতিশোধ
১.
ভাদ্রের ভ্যাপসা গরমে মানিক মিঞা এভিনিউর গোল চক্করের কাছে দাঁড়িয়ে কুল কুল করে ঘামতে থাকে আবির। অনেকক্ষণ রিক্সা না পেয়ে আস্তে-ধীরে চড়ছিল মেজাজ। দুপুরের এই সময় রিক্সা-বদলি হওয়ায় প্রায়শই দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ভারি বিশ্রী ব্যাপার। হেঁটে রওয়ানা দেবে কিনা ভাবতে থাকে। উপর থেকে তাকে দেখলে যতটা শান্ত-শিষ্ট মনে হয়, আসলে তেমনটি সে নয়। কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করা তার ধাতে নেই। রিক্সা না পেয়ে হেঁটে গন্তব্যস্থানে যাওয়া তার কাছে মামুলি ব্যাপার। বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করে যথারীতি হাঁটতেই থাকে। কিছুটা পথ হাঁটার পর আচমকা পাশে এসে দাঁড়ায় টকটকে লাল রঙের একটি টয়োটা গাড়ি। গা ঘেঁষে দাঁড়াতেই মেজাজ আরো বিগড়ে যায়। যুৎসই একটা খিস্তি ঝাড়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে, ড্রাইভিং সিটে বসা সুদর্শন এক যুবক। তার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। চোখে কালো রঙের গাঢ় সানগ্লাশ। ছোট করে ছাঁটা চুল। হাল ফ্যাশনের হালকা নীল গেঞ্জি গায়ে।
কিরে দোস্ত, চিনতে পারছিস না?
বলেই সানগ্লাশটা খুলতেই যুবকটিকে আবিরের চেনা চেনা মনে হতে থাকে। কোথায় যেন দেখেছে। একটা ধন্দে পড়ে যায়। তার স্মৃতিশক্তি এত বেশি দুর্বল কোনো কিছুর ধারণক্ষমতা খুবই কম। সহজে কোনো কিছু মনে করতে পারে না। এজন্য জীবনে তাকে অনেক বার সমস্যায় পড়তে হয়েছে। কিরে শালা, চিনলি না। আমি মোহন। এবার আর চিনতে ভুল হয় না। অনেক দিন পরে দেখা। স্কুল জীবনের বন্ধু। স্কুল ছাড়ার পর এই প্রথম দেখা হলো। কম দিন তো আর পার হয়নি। চেহারা-ছুরতও অনেক বদলে গেছে। এ কারণে চিনতে একটু বেগ পেতে হলো।
কিরে, কই যাবি? এই ভর-দুপুরে হেঁটে হেঁটে যাস কই?
আগের জায়গায় আছিস নাকি? ওঠ, গাড়িতে ওঠ। বাসায় পৌঁছে দেই।
একটুখানি উসখুস করলেও গাড়িতে ওঠে পড়ে আবির। দীর্ঘ প্রায় দশ বছর পর দেখা হওয়ায় কথার ফোয়ারা যেন ছুটতে থাকে। মোহন আগে থেকেই খুব মিশুক। যে কোনো আসর সহজেই মাতিয়ে তুলতে পারে। অপরিচিতকে আপন করে নেওয়ার সহজাত ক্ষমতা আছে। কথায় কথায় অনেক কিছু জানা গেল। মোদ্দা কথা হলো, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর ইউ.এস.এ চলে যায়। জমিয়ে ব্যবসা করছে। সেখানকার গ্রিন কার্ড হোল্ডার। বাবা-মায়ের পীড়াপীড়িতে বিয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে ঢাকায় এসেছে। বিয়েও ঠিক-ঠাক। সপ্তাহখানেক পর বিয়ের অনুষ্ঠান। গাড়ীতে রাখা বিয়ের একটি কার্ড দিয়ে আমন্ত্রণ জানালো। বিয়েতে থাকার সম্মতি আদায় করে নেয়। মোহনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওর উন্নতির কথা চিন্তা করছিল আবির। কি ছিল আর এখন কী হয়েছে? এক সময়কার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর পরিবর্তনে ভালই লাগলো।
২.
আবির বিয়েতে যাবে না ভেবেছিল। কথা দেওয়ায় না গিয়ে পারলো না। বিশাল আয়োজন। পাত্রী পক্ষের অঢেল ঐশ্বর্য প্রকাশ পাচ্ছিল। ঢাকার এলিটদের মধ্যে অনেককে দেখা গেল। বিয়েতে বেশ ক’জন পুরানো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়ার পর বন্ধুরা মিলে মোহনের বউকে দেখার জন্য যায়। এ বিষয়ে আবিরের কোনো আগ্রহ না থাকলেও বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে তাকেও যেতে হয়। পাত্রীকে দেখে তার দেহের রক্ত চলকে ওঠলো। শরীরটা অবশ অবশ লাগতে থাকে।
বছর চারেক আগের হলেও এখনও তার বুকে ভিডিও ক্যাসেট হয়ে আছে সেদিনের সেই ঘটনাটি। গণভবন এলাকার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরতে একটু রাত হয়ে যায়। শীতের কারণে সন্ধ্যা রাতটাকে একটু গভীর মনে হতে থাকে। কুয়াশায় ঢাকা চারপাশ। রাস্তায় লোক চলাচল নেই বললেই চলে। গণভবন থেকে যে রাস্তাটা কৃষি কলেজের পাশ দিয়ে গেছে, সেটা এমনিতে নির্জন। রিক্সা না পেয়ে হেঁটে হেঁটে আসছিল আবির। উল্টো দিক থেকে আসা একটি প্রাইভেট কার আচম্বিতে তার পাশে ব্রেক কষতেই বুকটা দুরু দুরু করে ওঠে। যদিও সাথে তেমন কিছু নেই। বাপের দেওয়া সিকো ফাইভ ঘড়ি আর খুচরো কিছু টাকা-পয়সা ছাড়া। তবে প্রাণটা নিয়ে একটু ভয় খেয়ে যায়। জানের মায়া বলে কথা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কালো আলখেল্লায় ঢাকা তিন জন নেমে এসে তাকে ঘিরে ধরে। দু’জনের হাতে পিস্তল। আরেক জনের হাতে চকচকে একটি ক্ষুর। গাড়ি স্টার্ট দেওয়া অবস্থায় ড্রাইভিং সিটে বসে আরেক জন। রীতিমতো ফিল্মি স্ট্যাইল। ভয়ে সিটিয়ে যায় আবির। আগন্তুকদের তিন জন ধাক্কা মেরে তাকে গাড়ীর পিছনের আসনে বসিয়ে দেয়। পিস্তলধারী দু’জন তার দুই পাশে বসে থাকে কোমরে পিস্তল ঠেকিয়ে। পুরো বিষয়টি ঘটতে থাকে একদমই নিঃশব্দে। আদেশ-নির্দেশ যা কিছু হচ্ছিল আকার-ইঙ্গিতে।
পলকের মধ্যে গাড়ি চালিয়ে দেয়। গাড়ীর রঙিন কাঁচ ওঠানো থাকলেও সামনের আসনে বসা ক্ষুরধারী একটি কালো কাপড় দিয়ে আবিরের চোখ বেঁধে দেয়। তারপর তিন জনে মিলে তার হাত দু’টিকে পিছমোড়া করে বাঁধে। চার জনের একজনও কোনো কথা বলছিল না। যা বলছিল পিস্তল আর ক্ষুর। চোখ ও হাত বাঁধা থাকায় বসতে কষ্ট হওয়ায় একটু নড়াচড়া করতেই পেটের কাছে শক্ত কিছু দিয়ে সজোরে আঘাত করতেই কুঁকড়ে যায় আবির।
তাদের উদ্দেশ্য কি, ঠিক বুঝতে পারে না। তাকে নিয়ে অনাহুত বেশ কিছুক্ষণ ঘোরঘোরির পর এক সময় বুঝতে পারে, গাড়িটি বোধহয় কোনো বাড়ির সীমানায় ঢুকলো। গাড়ি থেকে তাকে নামিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানো হলো। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় আবিরের চিরদিনের অভ্যাস সিঁড়ি দিয়ে গুনতে গুনতে ওঠা। একুশটি সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করে। হঠাৎ একটি কুকুরের কর্কশ চিৎকারে বুকটা দারুণভাবে কেঁপে ওঠে। ওকে একটি ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করার শব্দ পেল। এরপর একটি বিছানায় তাকে শুইয়ে দিয়ে প্রথমে পা দু’টিকে, তারপর হাত দু’টিকে বিছানার চারপাশে শক্তভাবে বাঁধা হতেই সম্মিলিতভাবে মেয়েলি কণ্ঠ শুনতে পায়। ওর বোধশক্তি লোপ পাওয়ায় ও আসলে কোনো কিছু বুঝে ওঠতে পারছিল না। একটা রহস্যের মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকে।
এক ঝটকায় মুখের বাঁধন খুলে দিতেই দেখতে পেলো, প্যান্ট-শার্ট পরা অদ্ভুত সুন্দর চার জন স্মার্ট তরুণী তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। সে কিছু বুঝতে না পেরে তাকিয়ে থাকলো ফ্যাল ফ্যাল করে। ঘটনার আকস্মিতায় ও আসলে বিমূঢ় হয়ে যায়। অদূরে ভয়ঙ্কর চেহারার কালো কুচকুচে একটি অ্যালসেশিয়ান কুকুর তীক্ষè দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে। সুযোগ পেলেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষায়। ঘরটা দামি আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো। দরজা-জানলা বন্ধ। ভারী পর্দা নামানো থাকায় বাইরের কোনো কিছু ঠাওর করা যাচ্ছিল না। সারা বাড়ি কেমন যেন চুপচাপ। কোথাও কোনো সাড়া-শব্দ নেই। দেওয়াল ঘড়ির মিষ্টি শব্দে বুঝতে পারলো রাত বাড়ছে।
এরপরের ঘটনার জন্য আবির মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ঘরে রাখা ফ্রিজ থেকে দু’টি বোতল ও গ্লাস বের করা হলো। লেবেল দেখে হুইস্কির বোতল চিনতে অসুবিধা হলো না। চার জনে চিয়ার্স বলে একটু একটু করে হুইস্কি পান করতে থাকে। সঙ্গে গরুর ভুনা মাংস। আবিরকে পেট ভরিয়ে হুইস্কি পান করানো হয়। একটু একটু করে দুলে ওঠতে থাকে ও। এ সময় ভিসিআরে চালিয়ে দেওয়া হয়। তাতে থ্রি এক্সের রমরমা নীলাভ দৃশ্যাবলী। একটি দৃশ্যে এক তরুণকে নিয়ে চার তরুণীর শারীরিক পীড়ন। তরুণের বুকফাটা আর্তনাদে তাদের বিকৃত উল্লাসকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল। দৃশ্যটা সইতে না পেরে চোখ সরিয়ে নেয় আবির। মাথাটা ঝিম ঝিম করতে থাকে। তারপরের ঘটনার জন্য ও মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ভিসিআরে দেখা দৃশ্যের মতো অবিকল ঘটে যায় বাস্তবে। দৃশ্যপটের নায়িকাদের মধ্যে একজন বললেন, এ হলো প্রতিশোধ। এতদিন ছেলেরা মেয়েদের ওপর জোর-জবরদস্তি, নিপীড়ন, শ্লীলতাহানি করে এসেছে। মেয়েরা সহ করেছে মুখ বুজে। এখন থেকে এর জবাব দেওয়া হবে।
তারপর তাকে কীভাবে বাসা থেকে বের করে আনা হয়, তা একটুও বুঝতে পারে নি। শরীরে কোনো অনুভূতি ছিল না। যখন কিছুটা হুঁশ হয়, নিজেকে সেই রাস্তার ধারে দেখতে পায়। রাত তখন অনেক গভীর। পকেটে হাত দিয়ে দেখে পাঁচ শত টাকার আনকোরা চারটি নোট।
৩.
কিরে! ঝিম মেরে আছিস কেন? ভাবীর সঙ্গে একটু কথা-টথা বল। তুই শালা আগের মতো চুপচাপ রয়ে গেলি। বন্ধুদের কথাগুলো কানে যেতেই স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলো আবীর। নববধূর দিকে তাকিয়ে সেদিনের কথা বলা মেয়েটির ছবি ভেসে ওঠলো। তারপর নববধূর দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখা ভিডিও ক্যাসেটটা মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল। সিঁড়ির একুশটি ধাপ বেয়ে নামতে নামতে তার মুখে ফুটে ওঠলো এক টুকরো মৃদু হাসি।
একা
জরুরি টেলিগ্রাম পেয়ে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই ভোর বেলা একাকি ছুটতে হলো কৌশিককে। একাকি শব্দটি মনের কোনায় ভেসে ওঠতেই মনে পড়ে যায় শুচির মুখ। একা একা ও কোথাও যায় নি শুনে শুচির সে কি হাসি। একবার সংসদ চত্বরে অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর সময় বাদাম খেতে খেতে কি প্রসঙ্গে যেন কথাটি ওঠেছিল। শুচির হাসি শুনে আশ-পাশের লোকজন ওদের দিকে তাকাতেই কৌশিকের চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়। এরপর খুঁটিনাটি কিছু হলেই শুচি মজা করার জন্য ওকে ‘খোকনসোনা’ ব’লে ক্ষেপায়। সত্যি বলতে কি- এই চব্বিশ বছর বয়সেও একা একা তার দূরে কোথাও যাওয়া হয় নি। যাতায়াতের ঝুট-ঝামেলা তো আছেই, সেইসঙ্গে কোথাও একা একা গিয়ে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াটাও একটা সমস্যা। কিন্তু এ যাত্রায় আর কোনো উপায় ছিল না। যাবার সময় অসুবিধায় যাতে না পড়তে হয়, সেজন্য আগে-ভাগেই কমলাপুর রেল স্টেশন রওয়ানা হওয়ার কথা ভেবেছিল। বাসা থেকে বের হতে হতে খানিকটা দেরি হয়ে যায়। তারপর ট্র্যাফিক সিগনাল আর যানজট মাড়িয়ে স্টেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ বিলম্ব হয়ে যায়। এমনটি হওয়ায় নিত্যসঙ্গী চাপা টেনশন তার বুকে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরে। ট্রেনের টিকিট পাবে কিনা এই সংশয়টা বুকের মাঝে পেন্ডুলামের মতো অতিমাত্রায় দোল খেতে থাকে। এমনিতেই সামান্য কারণেই কৌশিক টেনশনে ভোগে। যদি কেউ একবার বলে, কৌশিক তোর সঙ্গে কথা আছে। ব্যস, হয়ে যায় তার দফারফা। কথাটা না শোনা পর্যন্ত তাকে পেয়ে বসে একরাশ অস্থিরতায়। আর এই দূরের পথ জার্নি করার কথা শোনার পর তাকে উৎকণ্ঠায় পেয়ে বসে। এখন যদি টিকিট না পায়, তাহলে মুশকিলে পড়তে হবে। অথচ তাকে যে করেই হোক যেতেই হবে।
যা আশঙ্কা করেছিল, তাই ঘটলো। কাউন্টারে ঊর্মি-নিশিথার কোনো টিকিট পাওয়া গেল না। প্রায়শই কৌশিকের নেতিবাচক চিন্তাগুলো সত্য হয়ে যায়। যে কোনো কাজের ক্ষেত্রেই তার মনের মাঝে ঠাঁই করে নেয় নেতিবাচক ভাবনা। একজন মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ অনুযায়ী সে ইতিবাচক ভাবার চেষ্টা করেও তা কার্যকর করতে পারে না। এই মুহুর্তে অস্ফুট স্বরে নিজেকে একটা গাল দিলো। কী করবে ভেবে না পেয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়েছিল কৌশিক। এমন সময় দেবদূতের মতো একজন তার সামনে এসে হাজির।
স্যার, টিকিট লাগবে?
ব্ল্যাকারকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। তার কাছ থেকে চড়া দামে টিকিট কেটে ট্রেন ছাড়ার অল্প কিছুক্ষণ আগে কৌশিক নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসলো। কিন্তু তখনও সে হ্যাঙওভারটা কাটিয়ে ওঠতে পারছিল না। জানলার পাশে বসেও ট্রেনের দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে দুশ্চিন্তা আর অস্থিরতা মগজের কোষে কোষে জটলা পাকাতে থাকে। একা জার্নি না করার অভিজ্ঞতা না থাকাটা তো আছেই, একই সঙ্গে রাঙ্গামাটি গিয়ে অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কায় একটা উদ্বেগ তার চোখে-মুখে স্পষ্ঠ হয়ে ওঠে।
চলমান ট্রেনের খোলা জানলায় জীবনানন্দীয় দৃশ্যপট ব’য়ে গেলেও মনটা অশান্ত থাকায় কোনো রকম অনুভূতি তার হৃদয়ে ছাপ ফেলছিল না। অথচ খোশ-মেজাজে থাকলে এই মুহুর্তে কৌশিকের বুকের মাঝে গুঞ্জরিত হতো প্রিয় কবির কবিতার প্রিয় পংক্তিমালা। সব কিছু মিলিয়ে কৌশিক বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে যায়। আচানক, সামনে বসা অচেনা এক ভদ্রলোকের কথায় চটকা ভেঙে চাইতেই দেখে অনেকগুলো চোখ তার দিকে ফেরানো। এতে একটু লজ্জা পেয়ে যায়। পাশেই বসা এক ভদ্রলোক। কিছুটা স্থূলাকায়। গম্ভীর প্রকৃতির। কোনো অফিসের বস বস চেহারা। তার উল্টোদিকে হাস্যোজ্জ্বল আরেক জন ভদ্রলোক। বয়স ৩৩/৩৪ হতে পারে। চোয়ালটা ভাঙা। চোখ দু’টো দাবানো। যেন গর্তের মাঝে বসিয়ে রাখা হয়েছে। পিটপিটে চাইনি। পরনে ঝকমকে সাফারি। বুঝতে বেগ পেতে হলো না, এই ভদ্রলোকই তাকে বিব্রত অবস্থায় ফেলেছেন। ভদ্রলোকের পাশে অর্থাৎ তার সামনে জানলার পাশে বসা একজন মহিলা। হাবভাবে মনে হলো, ভদ্রলোকের স্ত্রী। কিন্তু জুটি হিসেবে তার চোখে বেমানান লাগলো। মহিলার সঠিক বয়স আন্দাজ করা কঠিন। তবে ২৬/২৭ বছর হতে পারে। মুখশ্রী বেশ সুন্দর। সাজগোজেও পরিচর্যার ছাপ। মুখে আলতো হাসি ছড়ানো। চোখের দিকে এক পলক তাকিয়ে কৌশিকের বুকটা ধক করে ওঠে। চোখ দু’টি যেন তার দিকে খিলখিলিয়ে হাসছে। নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে পরিবেশটাকে বুঝতে চেষ্টা করলো। বুঝতে পারলো, ভদ্রলোক তাকে কোনো প্রশ্ন করেছেন এবং তার জবাবের অপেক্ষায় সকলেই। একটি অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরলো। কী করবে বুঝতে না পেরে একটু বোকা বোকা হেসে বললো-আমাকে কিছু বললেন? তার কথায় ভদ্রমহিলার ঠোঁটে হাসির একটা ছোট্র ফোয়ারা বয়ে গেল। শান্ত দীঘিতে ছোট্র ঢিল ছুঁড়লে যেমনটি হয়। এই হাসি তার সংকোচ আরো বাড়িয়ে দেয়। নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার কথা ভাবলো সে। কিন্তু বুঝতে দেরি হলো না- ভুল জায়গায় এসে পড়েছে। জ্যামিতিক সমান্তরালে বসলেও সাফারি পরা ভদ্রলোক কৌণিকভাবে তারসঙ্গে আলাপচারিতা চালাতে লাগলো। সম্ভবতঃ পাশের ভদ্রলোকের সঙ্গে সুবিধা করতে না পেরে তাকেই পেয়ে বসেছেন। তবে ভদ্রলোকের কথায় সম্মোহনী শক্তি আছে বলতে হবে। ট্রেন গাজীপুর যাবার আগেই ভদ্রলোক কৌশিকের সঙ্গে খাতির জমিয়ে ফেললেন। অবশ্য এ ক্ষেত্রে চুপচাপ স্বভাবের কৌশিকের ভূমিকা শ্রাবকের। কখনো সে মাথা দুলিয়ে কিংবা মুচকি হেসে ভদ্রলোকের কথায় সায় দিচ্ছিল। আর মাঝে মাঝে আড় চোখে ভদ্রমহিলাকে দেখছিল। কখনো-সখনো তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছিল।
ভদ্রলোক কথায় কথায় জানালেন, ভদ্রমহিলা তার স্ত্রী। কৌশিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর নিজের ব্যক্তিগত জীবনের ফিরিস্তি দিতে শুরু করেন। চট্টগ্রামেই বসবাস। সেখানেই ব্যবসা। নিজের চেষ্টায় ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছেন। বিয়ে করেছেন প্রেম করে। সেও হয়ে গেছে সাত/আট বছর। কোনো সন্তান-সন্তদি হয় নি। ঝাড়া হাত-পা। ঢাকায় বেড়াতে এসেছিলেন। এও জানালেন, কৌশিকের মতো দেখতে তার একজন শালা আছে। ভদ্রলোকের স্ত্রীও এ কথায় সায় দিলেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে ট্রেনের মধ্যেই কৌশিককে খাতির-যত্ম শুরু করে দেন। বুফে-কারের কর্মচারীরা এলে নানা রকম খাদ্যের অর্ডার দিলেন। কৌশিক কয়েকবার বারণ করা সত্ত্বেও তাদের আপ্যায়ন থামে না। নাস্তার দাম দিতে গিয়ে ইতোমধ্যে একবার দুলাসুলভ ধামকিও খেতে হয়েছে।
ট্রেন চট্টগ্রামের কাছাকাছি আসার পর চকিতে কৌশিকের মাথায় চিন্তার টেউ খেলে যায়। তখন বিকেল গড়িয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে আজ তার রাঙ্গামাটি যাওয়া হবে না। পাঁচটার পর রাঙ্গামাটি যাওয়া বন্ধ। রাতটা তাকে হোটেলেই কাটাতে হবে ব’লে ভাবছিল। অথচ তার হোটেলে থাকার একদমই অভ্যাস নেই। কিন্তু এছাড়া উপায়ও নেই। ট্রেনটা থামতেই ভাবনাটা ঝেড়ে ফেলে মনে মনে হোটেলে ওঠার প্রস্তুতি নিয়ে নেয়।
স্টেশন থেকে বের হয়ে হয়ে সহযাত্রী ভদ্রলোক ও তার স্ত্রীর কাছ কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার কথা ভাবছিল। সে মুহূর্তে ভদ্রলোক কৌশিকের বাহু আশ্লেষে জড়িয়ে ধরিয়ে বললেন, মতলব কি?
ট্রেনে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপের সময় কৌশিক তার গন্তব্যের কথা জানিয়েছিল। তাই বললো, রাতটা হোটেলে কাটিয়ে ভোরেই রাঙ্গামাটি ছুটবো। ভদ্রলোক কিছুটা ভারিক্কি চালে বললেন, দুলাভাইয়ের বাসা থাকতে হোটেলে কেন? মতলব খারাপ নাকি? এ কথায় ভদ্রলোকের স্ত্রী হাসতে লাগলো। কৌশিক বিব্রত বোধ করলো। সে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ভদ্রলোকের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু কোনোভাবেই ছাড়া পেল না। একান্ত নিরূপায় হয়ে তাদের সঙ্গে তাকে যেতে হলো। এটাও তারজন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা।
শাড়ি
এক্সকিউজ মী। কিছু মনে করবেন না। আপনাকে একটু বিরক্ত করতে চাই।
কোনো রকমে কথাটা বলতে পারলো সাহান। এটুকু ব’লে ও আনইজি ফিল করতে থাকে। অগ্রহায়ণের বিকেলটা সবে খুলছে। একটা ফুরফুরে আমেজ। শীতের সূক্ষন কামড় প্রকৃতিতে। তা সত্ত্বেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে তার কপালে। চেষ্টা করেও হাসিটাকে ধরে রাখতে পারছে না ঠোঁটে। পারতপক্ষে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে মোটেও স্বাচ্ছন্দ বোধ করে না সাহান। আর অচেনা মেয়ে হলে তো কথা নেই। অথচ একটা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এসে তাকে নিজের খোলস থেকে বের হতে হলো।
টুকটাক কিছু কেনা-কাটা করতে হবে ব’লে রূপককে নিয়ে সাহান এসেছে নিউমার্কেটে। কেনাকাটা সেরে বের হয়ে আসছিল ওরা। এমন সময় দক্ষিণের গেট দিয়ে একটি মেয়েকে ঢুকতে দেখা যায়। মেয়েটিকে প্রথম দেখায় যে কেউ হোঁচট খাবে। অবিকল যেন মাধুরী দীক্ষিত। অপাপবিদ্ধ আয়ত দুই চোখ। কেমন যেন স্বপ্ন জড়ানো। নাম না জানা সুগন্ধি ফুলের পাপড়ির মতো ওষ্ঠ। প্রিন্টেট সালোয়ার-কামিজ। মেয়েটাকে দেখে বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ভালো লাগার অনুভূতি। নাকে এসে লাগে দামি কোনো সুগন্ধী।
মেয়েটা খানিকটা এগিয়ে যেতেই রূপক বললো, দোস্ত, দারুণ জিনিস। তুই যদি কথা বলতে পারিস, তোকে নগদ এক হাজার পুরস্কার দেব।
কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে ভয় খায় সাহান। আজ অব্দি এমন কিছুই কখনো করে নি, যাতে ঝলসে ওঠে সাহসের স্ফুলিঙ্গ। একটা শাইনেস সর্বদা ঘিরে রাখে তাকে। এই দুর্বলতাটুকু বন্ধু-বান্ধবরা ভালো করেই জানে। এটা জেনেই বন্ধু-বান্ধবরা সুযোগ নেয়। যখন-তখন তাকে ফেলে দেয় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। কিন্তু আজ হঠাৎ সাহান হয়ে যায় অন্য মানুষ। বের হয়ে আসে পরিচিত গন্ডি থেকে। রূপকের দিকে রহস্যময় একটু হাসি দিয়ে দ্রুত মেয়েটির দিকে এগিয়ে যায়। চারপাশের যাবতীয় ঔৎসুক্য দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সে কাছাকাছি হয় মেয়েটির।
কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে একরাশ সঙ্কোচ নিয়ে মেয়েটির পাশাপাশি হাঁটতে থাকে।
মেয়েটি প্রথম অবস্থায় থমকে গেলেও চোখে-মুখে একরাশ কৌতূহল নিয়ে বললো, জ্বী, বলেন।
কিছুটা ধাতস্থ হয়ে সাহান বললো, আসলে আমি এসেছিলাম, একটা শাড়ি কিনতে। একজনকে গিফট করবো। কিন্তু এ বিষয়ে আমার একদমই আইডিয়া নেই। তাই নিরূপায় হয়ে আপনার একটু হেলপ চাচ্ছিলাম। যদি আপনি বিরক্ত বোধ না করেন।
মেয়েটি সাহানের অ্যাপ্রোচে হেসে ফেলে।
একটা শাড়ি কিনে দিতে হবে, তারজন্য অ্যাত অনুনয়-বিনয়ের কী আছে? কী শাড়ি কিনতে হবে বলুন?
আমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ আনাড়ি। যা ভালো হয়, কিছু একটা কিনে দেন।
আরে বাবা, কার জন্য কিনবেন, কত টাকার মধ্যে কিনবেন, সেটা না বললে হবে কী করে? তাছাড়া যার শাড়ি কিনবেন, তার বয়স কত, গায়ের রঙ কেমন, এসব না জেনে শাড়ি কিনবো কীভাবে?
সাহান একটু ভেবে নিয়ে বললো, এই হাজারখানেক টাকার মধ্যে হলেই হবে। আর সব কিছু আপনার মতো। আপনাকে যেমন শাড়িতে মানায়, তেমন হলেই হবে।
আমার মতো? একগুচ্ছ সংশয় নিয়ে জানতে চাইলো মেয়েটি।
কথায় কথায় সাহানের আড়ষ্টতা অনেকখানি কেটে যায়। কথা চালিয়ে যেতে থাকে সাবলীলভাবে।
হ্যাঁ, যারজন্য শাড়িটি কিনতে চাচ্ছি, সেও আপনার মতো অদ্ভুত সুন্দর। আপনি চয়েজ করে দিলে আমার বিশ্বাস, তার অবশ্যই পছন্দ হবে।
আমার ওপর আপনার দেখছি দারুণ কনফিডেন্স। না জেনে না শুনে অ্যাতটা আস্থা থাকা ভালো নয়। তাতে ক’রে জীবনে অনেক পস্তাতে হয়। আর আমি বুঝি সুন্দর!
শুধু সুন্দর বললে অবশ্যই ভুল বলা হবে। অপূর্ব। মুম্বাইয়ের একজন নায়িকার মতো।
এ কথা শুনে মেয়েটি মৃদু মৃদু হাসতে থাকে। এমন প্রশংসায় সে যে অভ্যস্ত তা বুঝতে পারা যায়।
বাই দা বাই, এতক্ষণ ধরে কথা বলছি, পরিচয়টা হলো না। আমি সাহান। শব্দ বেঁচে খাই।
বুঝলাম না।
একটি পত্রিকায় কাজ করি।
আপনি সাংবাদিক?
লোকে তাই বলে। আপনি?
আমি সোমা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনোমিক্সে অনার্স পড়ছি। হলে থাকি। চলুন, আপনার শাড়ি কেনা যাক।
বেশ কয়েকটি দোকান ঘোরাঘুরি করে উদ্দীষ্ট শাড়িটি পছন্দ হচ্ছিল না সোমার। রঙ পছন্দ হয় তো প্রিন্ট হয় না। সোমা যে বেশ চুজি তা অনুধাবন করতে সময় লাগে না সাহানের। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে একটা শাড়িতে রফা হলো।
শাড়ি কেনা হতেই সাহান বললো, যাক, ঝামেলা চুকলো। আপনার সৌজন্যে শাড়ি কেনার অভিজ্ঞতাও হলো। এরপর সোমাও কিছু প্রয়োজনীয় কেনা-কাটা সারলো। অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর সাহান বললো, গলা শুকিয়ে এসেছে। চলুন, একটু গলা ভিজিয়ে নেই।
সোমার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও সাহান তাকে নিয়ে বসলো নভেল ড্রিঙ্কস হাউজে। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে টুকরো টুকরো কথা কিছুক্ষণ।
বিদায় নেওয়ার জন্য নিউমার্কেটের বাইরে এসে রিক্সা ঠিক করে সোমা। রিক্সা ছেড়ে দেওয়ার মুহূর্তে সাহান শাড়িটি তার হাতে দিয়ে বললো, এটি আপনার জন্যই কেনা। একরাশ বিস্ময় নিয়ে সোমা চেয়ে থাকে সাহানের দিকে। এই ফাঁকে রিক্সাটা আস্তে আস্তে চলতে থাকে।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)