১. প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে যখন শের-এ-বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কথা হচ্ছিল, তখন খুব একটা স্বস্তিতে ছিলাম না। না থাকার অন্যতম কারণ, সিনিয়র ভাইদের কাছে জানতে পারি, স্কুলের শিক্ষকরা নাকি খুবই কঠোর। ছাত্রদের শাসন করেন কড়া হাতে। একজন শিক্ষক আছেন, কোনো ছাত্র বেগড়বাই করলে তিনি নাকি শরীর থেকে রক্ত না ঝরানো পর্যন্ত ক্ষান্ত হন না। অনবরত পেটাতেই থাকেন। রক্ত বের হওয়ার পর ক্লাসের দেয়ালকে ক্যানভাস বানিয়ে সেই রক্ত দিয়ে ছবি আঁকাতেন। যাতে রক্তে আঁকা সেই ছবি দেখে অন্যরা সাবধানে হয়ে যায়। এমন ভীতিকর কথা আগে-ভাগেই যদি কানে ভাসতে থাকে, তাহলে কে আর সেই স্কুলে যেতে চায়? কিন্তু না গিয়েও তো উপায় ছিল না। তখন তো বাসার কাছের স্কুল ছাড়া দূরের কোনো স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা সাধারণত কেউ ভাবতেই পারতো না। অভিভাবকরা সেটা চাইতেনও না। তাছাড়া বর্তমান সময়ের মতো বেসরকারি স্কুলের এত রমরমা ছিল না। অগত্যা, জেনে-শুনে বিষ পান করতেই হতো। তবে এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর আমার মতো কেউ কেউ পেয়েছিল ‘স্বাধীনতা’ অর্জনের আনন্দ। ঘটনাচক্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শেষ তিনটি বছর আমাকে ক্লাস করতে হয় বাসার পাশের শের-এ-বাংলা নগর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে। আমি ভুল লিখছি না। হ্যাঁ, বালিকা বিদ্যালয়েই কেটেছে কৈশোরের অনেকগুলো দিন। নারী রাজত্বে সংখ্যালঘু হয়ে থাকার কি যে যন্ত্রণা, সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছিলাম। স্কুলে যতক্ষণ থাকতাম, ততক্ষণ রোবটের মতো বসে থাকতাম। মনের সুখে হৈ-হুল্লোড় করার সুযোগ ছিল না। পান থেকে একটুখানি চুন খসলেই নেমে আসতো শাস্তির খড়গ। অথচ সহপাঠী মেয়েরা ইচ্ছেমতো ঘুরতে পারতো। ছুটতে পারতো। এমনকি চাইলে ডানা মেলেও উড়তে পারতো। আর সেটা দেখে বুকের মধ্যে বইতো দীর্ঘশ্বাস। পলে পলে অনুভব করতাম, পরাধীনতার গ্লানি। মনে মনে ভাবতাম, ওরা পারলে আমরা কেন তাদের মতো চলতে-ফিরতে-ঘুরতে পারি না?
সেই বয়সে তো আর এই ‘বৈষম্য’র কারণ বুঝতে পারতাম না। এখনকার জেনারেশনের মতো চালাক-চতুরও ছিলাম না। তাই সব কিছু হজম করতাম নীরবে। যে কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সীমানা অতিক্রম করার পর মনে হতে থাকে, যেন ‘কারাগার’ থেকে মুক্তি পেয়েছি। আসলেই সেটা ছিল বাঁধনছেঁড়া মুক্তির আনন্দ। ১৯৭৬ সালে শের-এ-বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার পর মনে হতে থাকে, শুরু হলো জীবনের নতুন অধ্যায়। ভর্তি হওয়ার আগেই সিনিয়র ভাইরা বুকের মধ্যে যে ভীতির সঞ্চার করে দেন, তা ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে। হাইস্কুলের ছাত্র হওয়ার একটা আত্মতৃপ্তি তো ছিলই। খুব সহজেই স্কুলটির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে মোটেও বেগ পেতে হয়নি। তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই তো লাল ইটের এই স্কুলটিকে দেখে আসছি। সে কারণে আগে থেকেই একটা মানসিক সখ্যতা ছিল। একদিন এই স্কুলের ছাত্র হবো, সেটাও তো মনের মধ্যে ছিল। এ কারণে স্কুলে পা দিয়ে মনে হতে থাকে, আরে, এ তো আমার নিজেরই স্কুল। স্কুলের পরিবেশও খুবই আপন মনে হয়। সব মিলিয়ে বুকের মধ্যে উড়তে থাকে রঙ-বেরঙের ঘুড়ি। তার মানে এই নয় যে, আমরা মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে ছুটেছি। যা কিছু করেছি, সবটাই স্কুলের সীমানার মধ্যেই। তখন স্কুলের চারপাশে ইট-বালু-সিমেন্টের বাউন্ডারি না থাকলেও অলিখিত একটা বাউন্ডারির মধ্যেই আমরা আবদ্ধ থাকতাম। পারতপক্ষে সেই বাউন্ডারি আমরা লংঘন করতাম না। করলেও শিক্ষকদের চোখ ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। যে কারণে অবাধ্য হওয়া কিংবা ভুল পথে পা বাড়ানোর ঘটনা খুব একটা ঘটতো না। শিক্ষকরা অভিভাবকের মতো একদিকে যেমন শাসন করতেন, অন্যদিকে আবার ভালোও বাসতেন। ক্লাসে পড়া না পারলে, হোমওয়ার্ক ঠিকমতো না করে আনলে কিংবা কোনো অন্যায় করলে শিক্ষকরা কোনো ছাড় দিতেন না। শিক্ষকদের ভয়ে আমরা তটস্থ থাকতাম। তারপরও যে সবাই সুবোধ বালক হয়ে থাকতো, সেটাও বলা যাবে না। কেউ না কেউ তো নিয়ম ভেঙেই মজা পেতো। সংগত কারণে পেতে হতো সাজাও।
এক এক জন্য শিক্ষকের শাস্তি প্রদানের কায়দা ছিল এক এক রকম। ছোট-খাট গড়নের বাংলার মফিজ স্যার যাকে সাজা দিতেন, তার মাথা নীচের দিকে নামিয়ে এনে পিঠে কনুই দিয়ে এমনভাবে গুঁতা মারতেন, সেই ব্যথা সপ্তাহখানেকের আগে সারতো না। অঙ্কের কোঁকড়া চুলের আবুল বাশার স্যার লাঠি দিয়েই মারতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। লাঠি ভাঙলে তিনি মনে করতেন, ঠিকমতো শাস্তি দেওয়া হলো। ইংরেজির রাগী চেহারার রফিক স্যারের চড়ের ওজন ছিল কমছে কম সোয়া সের। মারার সময় তিনি ডাস্টারও কাজে লাগাতেন। কোনো ক্লাসের কোনো ছাত্র যদি দুষ্টুমি করতো, বাংলা ব্যাকরণের মোটা-সোটা দেহের সিদ্দিকুর রহমান স্যার সেই ছাত্রকে চিহ্ণিত করতে না পারলে, সবাইকে গণহারে বেঞ্চের ওপর দাঁড় করাতেন। ভালো ছাত্র কিংবা মন্দ ছাত্রের কোনো বিভাজন করতেন না। সবার হাতে একটা করে করে বেত মেরে তিনি তৃপ্তি পেতেন। ইংরেজির হালকা-পাতলা গড়নের মোখলেস স্যার ছিলেন খুবই শান্ত-শিষ্ট। শারীরিকভাবে তিনি কিছুটা অসুস্থ ছিলেন। এ কারণে একটু বাঁকা হয়ে হাঁটতেন। কিন্তু একবার যদি তিনি কোনো ছাত্রের ওপর রেগে যেতেন, সেদিন সেই ছাত্রের খবর হয়ে যেত। বেত দিয়ে মারতেই থাকতেন। সহজে থামতেন না। অসুস্থতার কারণে একটানা মারতে পারতেন না। দম নিয়ে থেমে থেমে মারতেন। দশম শ্রেণীর ইংরেজির শিক্ষক শামসুল হক স্যার পড়া না পারলে হাসতে হাসতে পেটের চামড়া ধরে এমন মোচড় দিতেন, পড়া না শিখে কেউ তাঁর পরের ক্লাসে আসতো না। তবে বেশি মজা হতো ইকবাল স্যারকে নিয়ে। তিনি পড়াতেন রসায়ন। খুবই মেধাবী ছিলেন। কেন জানি না, বেশি মেধাবীরা সাধারণত একটু অন্য রকম হয়। ইকবাল স্যার ছিলেন অনেকটাই অ্যাবসেন্ড মাইন্ডেড। এই জগত যেন তাঁর নয়। তাঁকে দেখে মনে হতো, তিনি যেন বিচরণ করছেন অন্য কোনো জগতে। এই কারণে তাঁর এই সরলতার সুযোগ নিতেন ক্লাসের দুষ্টু ছেলেরা। কেউ কেউ ইচ্ছে করেই স্যারকে বিরক্ত করতেন। বিরক্তি করার কত রকম কৌশল যে প্রয়োগ করা হতো, সেটা আর নাইবা লিখলাম। কিন্তু স্যার কখনোই দুষ্ট ছাত্রকে সনাক্ত করতে পারতেন না। তখন তাঁর যাকে সন্দেহ হতো, তাকেই তিনি পিটাতেন। কেউ তাঁর ভুল ধরিয়ে দিলে তাকেও ছাড় দিতেন না। এ কারণে ভালো ছাত্ররাও তাঁর হাত থেকে রেহাই পেতো না। পরীক্ষার আগে স্যারের কাছে সাজেশন চাইলে সহসা সেটা তিনি দিতে চাইতেন না। সবাই সম্মিলিতভাবে অনুরোধ জানালে তখন বোধকরি তাঁর মন খানিকটা নরম হয়ে যেত। তাঁর সাজেশন দেওয়ার ধরন ছিল অন্যদের চেয়ে একদমই আলাদা। কোনো চ্যাপ্টারে হয়তো ১০টি প্রশ্ন। তিনি একটি কিংবা দু’টি প্রশ্ন বাদ দিয়ে বাদবাকি প্রশ্নগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে সাজেশন দিতেন। তখন কেউ কেউ ফাজলামি করে স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতো, স্যার দু’টি প্রশ্ন বাদ পড়েছে। অমনি স্যার রেগে যেতেন। তবে স্যার পড়াতেন মন দিয়ে। তিনি এমনভাবে পড়তেন, যাতে ছাত্রদের বুঝতে কোনো সমস্যা না হয়। এ কারণে তিনি প্রাইভেট পড়ানোর পক্ষপাতি ছিলেন না।
স্যাররা মারধর করলেও আদরও করতেন। ছাত্রদের বুক দিয়ে আগলে রাখতেন। জীববিজ্ঞানের জাহিদ স্যার ছিলেন অসম্ভব সাহসী। একবার আন্তঃ স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় আমাদের স্কুলের খেলা পড়ে মোহাম্মদপুর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে। খেলার এক পর্যায়ে গণ্ডগোল বেধে যায়। মোহাম্মদপুরের স্কুলের ছাত্ররা লাঠি-সোটা নিয়ে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন জাহিদ স্যার বলতে গেলে সব ছাত্রকে একাই বুক দিয়ে আগলে রাখেন। নতুবা বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো। স্যারদের এই আন্তরিকতা, এই ভালোবাসা, এই আত্মত্যাগের কারণে শের-এ-বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রদের অনেকেই আজ নানানভাবে প্রতিষ্ঠিত। চারিদিকেই ছড়িয়ে পড়েছে স্কুলের সুনাম ও সুখ্যাতি। এটা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য গর্ব ও আনন্দের।
২. ১৯৮১ সালে এসএসসি পাস করার পর স্কুলের সঙ্গে ছিন্ন হয়ে যায় প্রাত্যহিক বন্ধন। বলতে গেলে এরপর স্কুলে আর যাওয়া হয়নি। সহপাঠী বন্ধুদের কারো সঙ্গেই তেমনভাবে যোগাযোগ নেই। ছিন্ন ফুলের মালার মতো আমরা ছড়িয়ে পড়ি নানান দিকে। অনেকেই তো দেশের সীমানা ছাড়িয়ে স্থায়ীভাবে চলে গেছে কোন সুদূরে। আর যারা দেশে আছে, তারা তো কাছে থেকেও যেন কত দূরে। জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ে সবাই কম-বেশি এতটাই ব্যতিব্যস্ত, দেখা-সাক্ষাৎ করার সুযোগই হয় না। এমনকি হয় না একটু হাই-হ্যালোও করাও। সেটা হবে কী করে? পাশ দিয়ে চলে গেলেও হয়তো আমরা কেউ কাউকে চিনতে পারছি না। হায়, জীবন কেন এমন? যারা ছিল খুব কাছের, তারাই হয়ে গেছে অনেক দূরের। এর কোনো হিসাব আমি মিলাতে পারি না। তখন খুব অসহায় লাগে। বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে কষ্টের জলপ্রপাত।
কণ্ঠে বাজে সায়ানের গান,
কেন বাড়লে বয়স ছোট্টবেলার বন্ধু হারিয়ে যায়
কেন হারাচ্ছে সব বাড়াচ্ছে ভিড় হারানোর তালিকায়।
আজ কে যে কোথায় আছি কোনো খবর নেই তো কারো
অথচ তোর ঐ দুঃখগুলোতে অংশ ছিল আমারও।
............................. দ্যাখ্ নীল নীল নীল আকাশের মতো অনন্ত হাহাকার
আজ বুকের ভিতর ভাঙছে ভাঙছে ভেঙে সব চুরমার।
কোনো শত্রুরও যেন প্রাণের বন্ধু এমন দূরে না যায় শোনো
বন্ধু কখনো কোনো বন্ধুকে বলো না যেন বিদায়।
জীবনের সেরা সময়ে, পাঁচটি বছর একই চত্বরে আমরা হেসে-খেলে কাটিয়েছি, ভাগ করে নিয়েছি যাবতীয় সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, সেই আমরাই পরস্পরের কাছ থেকে হয়ে পড়েছি বিচ্ছিন্ন। আমার কাছে এটা খুব কষ্টকর মনে হয়। জানি না, আমাদের স্কুলের সেই বন্ধুদের বুকের মধ্যে এই কষ্টটা কখনো দোলা দেয় কিনা? তবে আমরা খুবই সৌভাগ্যবান যে, এসএসসি পরীক্ষার আগে আমাদের ব্যাচের একটি গ্রুপ ছবি তোলা হয়। সাদা-কালো দুর্লভ সেই ছবিটিতে ধরা আছে আমাদের সেই উজ্জ্বল সময়খণ্ড। ছবিতে সবাই নেই। যারা আছে, তাদের অনেককেই এখন দেখলে হয়তো চিনতে পারবো না। মিলাতেও পারবো না মনের সঙ্গে মন। সময় নামক অন্তহীন স্রোত আমাদের মধ্যে গড়ে দিয়েছে বিশাল ব্যবধান। কিন্তু ছবিটা দেখলে অনুধাবন করতে পারি সেই সময়টাকে, সেই বয়সটাকেও। বন্ধুত্বের অমলিন স্মৃতির প্রতীক হয়ে আছে এই ছবিটা। স্কুল জীবনের কথা মনে পড়লে এই ছবিটা দেখি ফিরে ফিরে। সেইসঙ্গে মনে পড়ে যায় জীবনের সোনালি দিনগুলোর কথা। তাই তো এখনও স্বপ্ন দেখি, স্কুলের সেই বন্ধুদের নিয়ে। কেউ যদি কবীর সুমনের মতো ‘হঠাৎ রাস্তার অফিস অঞ্চলে’ কিংবা ‘হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিয়ে বলে’ ‘বন্ধু, কী খবর বল? কত দিন দেখা হয়নি.....’ আমি তো সেই দিনটির অপেক্ষায় আছি।
(শের-এ-বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯৮১ সালের এসএসসি ব্যাচের ছাত্র।)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন