পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

মঙ্গলবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৩

হো চি মিনের দেশে


বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম বিপ্লবী নেতা হো চি মিনের দেশ ভিয়েতনাম নিয়ে আছে একটা রোমান্টিক আবেগ। হৃদয়ে দাগ কেটে আছে আমেরিকানদের বিপক্ষে ভিয়েতনামিদের গেরিলাযুদ্ধ। উত্তর ভিয়েতনামের প্রায় প্রতি ইঞ্চি জমিতে বোমা ফেলার পরও মার্কিনীদের পরাজয় ইতিহাসের একটি বড় শিক্ষা হয়ে আছে। পরাক্রমশালী হলেই যে কোনো দেশ দখল করা যায় না, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে ভিয়েতনামিরা। তাদের এই শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ে দেশে দেশে। অনুপ্রাণিত হয়েছে বাংলাদেশও। এ কারণে ছোট বেলা থেকে দেয়াল লিখনে দেখেছি কিংবা মিছিলের শ্লোগানে শুনেছি, ‘....... পরিণাম, বাংলা হবে ভিয়েতনাম’। কিন্তু কখনোই ভাবিনি বিপ্লবী এই দেশটিতে যাওয়ার কথা। আর বর্ষা মৌসুমে তো নয়ই। ছিচকাঁদুনে বৃষ্টির মধ্যে কে আর সেখানে ঘুরতে যায়? ঘটনাচক্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটিতে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যখন গেলাম, মনটা আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত দেশটি এখন অনেক বদলে গেছে। কোথাও ধ্বংসের ছোঁয়া নেই। যেন ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠেছে সমাজতান্ত্রিক এই প্রজাতন্ত্রটি। কৃষি প্রধান দেশটি এখন বাজার অর্থনীতির দিকে হাত বাড়িয়েছে। মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে ভিয়েতনামের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে। এশিয়ার নতুন অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তুলছে নিজেদের।


রাজধানী হ্যানয়ে পা দিয়ে সবার আগে দৃষ্টি কেড়ে নেয় মেয়েদের অবাধ স্বাধীনতা। তারা যেন মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ছেন। চলাচলের প্রধান বাহন মোটর সাইকেল ও ভেসপা। সমস্ত পথজুড়ে তাদের অবারিত দাপট। বড় যানবাহন খুব একটা দেখা যায় না। যানজটও নেই। মোটর সাইকেল ও ভেসপা চালকদের বড় একটা অংশই মেয়েরা। এমনকি তাদের পেছনে দিব্যি বসে থাকেন ছেলেরা। রাত অব্দি স্বাচ্ছন্দে ও সাবলীলভাবে মেয়েদের চলাচল। পোশাক-আশাকেও মেয়েরা যথেষ্ট ফাস্ট ও ফ্যাশনেবল। হট প্যান্ট আর স্লিভলেস জামা গায়ে দিব্যি ছুটছেন। জানতে পারলাম, মেয়েদের এই স্বাধীনতাই ভিয়েতনামকে এগিয়ে নেওয়ার অন্যতম চাবিকাঠি। যুদ্ধের সময়ও মেয়েদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। ভিয়েতনামের আবহাওয়া ও প্রকৃতি অনেকটাই বাংলাদেশের মতো। বর্ষাকালে এই রোদ, এই বৃষ্টি। গরমও একই রকম।

গাছ-গাছালি, ফুল-পাখিরও যথেষ্ট সামঞ্জস্য আছে। শহরের রাস্তায় শোভা বর্ধন করছে কৃষ্ণচুড়া, হিজল-তমাল জাতীয় পরিচিত গাছ। জিনিস-পত্রের দামও অনেকটাই আমাদের দেশের মতো। তবে কারো যদি কোটিপতি হতে না পারার আক্ষেপ থেকে থাকে, তার সেই মনোবাসনা সহজেই পূরণ করা সম্ভব ভিয়েতনামে গিয়ে। এক মার্কিন ডলার ভাঙালেই পাওয়া যায় ২০ হাজারেরও বেশি ভিয়েতনামিজ ডঙ। তবে কেনাকাটি করতে গেলে চোখের পলকেই উড়ে যায় লাখ লাখ ডঙ। আসলে এই পৃথিবীটা আর কতটুকুবা চিনি? সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সৌন্দর্য আর বিস্ময়। ভিয়েতনামও প্রাকৃতিক রুপ-রস থেকে বঞ্চিত হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তা তাদের দিয়েছেন অকৃপণভাবে। তাদের আছে হা লঙ বে’র মতো প্রাকৃতির সৌন্দর্যের লীলাভূমি। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে প্রিয় এই গন্তব্যটি। ‘নিউসেভেনওয়ান্ডার্স অব নেচার’-এর একটি এই পর্যটনকেন্দ্রে না গেলে ভিয়েতনাম সফরই বৃথা হয়ে যেত। এজন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের যুগ্ন-সচিব জনাব এ টি এম মোস্তাফিজুর রহমানকে। তাঁরই আগ্রহ ও উৎসাহে সেখানে যাওয়া। হ্যানয় থেকে প্রায় চার ঘন্টার বাস জার্নি করে যখন হা লঙ বে’তে পৌঁছালাম, আমার জন্য অপেক্ষা করছিল অবাক করা এক পৃথিবী। প্রকৃতির এক অনুপম ও বিস্ময়কর নিদর্শন উন্মোচিত হয় আমার চোখে। যাওয়ার পথে দেখতে পেলাম ভিয়েতনামের ঘর-বাড়ি, জীবনযাত্রার চলমান ছবি। হাইরাইজ বিল্ডিং খুব একটা নেই। বাড়ি-ঘর গড়ে ওঠেছে ছোট ছোট পরিসরে। এ ক্ষেত্রে মনে হলো সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।


পথিমধ্যে আমাদের বাস কিছুক্ষণের জন্য যেখানে থামানো হয়, সেটা ছিল কুটিরশিল্পের প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র। বিশেষ করে চিনামাটির আকর্ষণীয় তৈজসপত্র সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয়। পর্যটকরা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে লুফে নিচ্ছিলেন কিছু না কিছু। কুয়াঙ নিন প্রদেশের বাই চে ট্যুরিস্ট জাহাজঘাট থেকে তপ্ত রোদ মাথায় নিয়ে ছোট স্টিমারে করে মেকং নদী দিয়ে যেতে থাকি হা লঙ বে। গরমের তাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পর্যটকদের কাছে আর্কষণীয় হয়ে ওঠে কৃষকদের মাথাল, ভিয়েতনামি ভাষায় বলা হয়, ‘নন’। চারপাশের দৃশ্য ভরিয়ে দিচ্ছিল মুগ্ধতায়। পেশাদার গাইডের বর্ণনায় জানতে পারছিলাম ইতিহাসের নানান আখ্যান। মাঝপথে সামুদ্রিক মাছ দিয়ে জম্পেশ মধ্যাহ্নভোজ। খাবারের স্বাদ আমাদের দেশের মতোই। তবে তেল-ঝালের অতিশয়োক্তি নেই। এ কারণে কিনা জানি না, মোটাসোটা কোনো ভিয়েতনামি একদমই চোখে পড়েনি। বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠেছে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হা লঙ বে। দেড় সহস্রাধিক কিলোমিটার নিয়ে এলাকাটি। তাতে আছে প্রায় হাজার দুয়েক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ। এই দ্বীপগুলোকে চুনাপাথরের খনি বললে অত্যুক্তি হবে না। নানান আকারের। নানান গড়নের। ভিয়েতনামজুড়ে যে ক্রিস্টালের রমরমা, তার উৎস হলো এই হা লঙ বে। সাধারণত তিন কিংবা সাত দিনের প্যাকেজ প্রোগ্রামে পর্যটকরা সেখানে ব্যাগ-বোচকা নিয়ে ঘাটি গাড়েন। না হলে এর সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করা যায় না। আমরা যেহেতু দিনে দিনে আবার ফিরে আসি, তাই সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্পটসমূহ ছিল আমাদের টার্গেট। সবুজ পানি। সবুজ পাহাড়। সবুজে মোড়া হা লঙ বে। পানি পরিবেষ্টিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র পাহাড়। নানান আকারের। ‘দ্য কিসিং রকস’ দেখে মনে হলো, গভীর ভালোবাসা নিয়ে একে অপরের দিকে ঝুঁকে আছে দু’টি পাহাড়। একটি পাহাড় দেখতে অবিকল একটি মুরগীর মতো। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম একটি ব্রিজ। গাইড জানালেন, এটির নাম ‘লাভব্রিজ’। প্রতি বছর অনেক তরুণ-তরুণী ভালোবাসার জন্য এই ব্রিজ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। আমাদের প্রথমে নিয়ে যাওয়া হলো ভাসমান জেলে গ্রামে। বেশ কিছু জেলে পরিবার সেখানে ঠাঁই করে নিয়েছেন। নৌকার মধ্যে তাদের থাকা-খাওয়া। আমরাও ঘুরতে বের হই ভাড়া করা নৌকায়। বিপদের ঝুঁকি থাকায় আমাদেরকে পরানো হয় লাইফ জ্যাকেট। প্রচণ্ড গরম। দর দর করে ঘামছিলাম। রোদের তাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রত্যেককে একটি করে ছাতা দেওয়া হয়। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখতে পাই ‘ভূগর্ভস্থ নদী’।


পাহাড়ের নিচ দিয়ে চলে গেছে গুহার মতো পথ। প্রাকৃতিকভাবে সহজাতভাবে গড়ে ওঠেছে এটি। সেই গুহার মধ্যে দিয়ে আমাদের নৌকা ঢুকে পড়ে। সে এক শিহরণজাগানো অনুভব ও অনুভূতি। চারপাশে পাহাড় দিয়ে ঘেরা জলভাগ। শীতল আমেজ পেতে থাকি। পানি বেড়ে গিয়ে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেলে এখান থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে কেউ কখনো ‘প্রাকৃতিক এই জেলখানা’য় আটকা পড়েছেন কিনা জানতে পারিনি। স্টিমারে ফিরে আসার পর আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় গুহার রঙের ভুবন ‘থিয়েন কাঙ’য়ে। কিছুটা বিপজ্জনক সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে আমরা প্রবেশ করি ‘রঙধনু গুহা’য়। মনে হলো, আমরা যেন কোনো চিত্রকলা প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছি। পাহাড়ের গুহার মধ্যে প্রকৃতি যে এমনভাবে চিত্রকলা সাজিয়ে রেখেছে, এটা না দেখলে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না।


ফাঁক-ফোকর দিয়ে আসা আলোয় গুহার ভিতরে নির্মিত হয়েছে বর্ণিল ও রঙিন জগত। কখনো-সখনো ভুলবশত মনে হয় অ্যাকুরিয়াম। চোখ ও মন জুড়িয়ে যায়। দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে বেশ দীর্ঘ গুহা। ঝিরি ঝিরি পানি আমাদের গায়ে পড়তে থাকলে বেশ মজাই লাগে। প্রাকৃতিক এই চিত্রকলা জাদুঘরে আছে হরেক রকম ভাস্কর্যও। পাথর ও মাটি দিয়ে গড়া। অনেক অবয়ব ও কাঠামো এমনভাবে গড়ে ওঠেছে, তা নিয়ে আছে নানান লৌকিক উপাখ্যান। অধিকাংশই কাহিনী ড্রাগন কিংকে নিয়ে। আছে অনেক প্রেম কাহিনীও। আর এমন অনেক কিছুই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর হা লঙ বে’র পরতে পরতে। সে আকর্ষণকে পেছনে ফেলে আমরা ফিরতে থাকি গন্তব্যে। গোধূলিলগ্নে হা লঙ বে’কে মনে হচ্ছিল চোখজুড়ানো একটি ভিউকার্ড।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন