পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

বৃহস্পতিবার, ১১ অক্টোবর, ২০১২

আদনান সামি কি হারিয়ে গেলেন?

অনেক দিন যাবৎ পাদপ্রদীপের আলোয় নেই জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী আদনান সামি। একটা সময় সংগীত জগত কাঁপিয়েছেন তিনি। উপমহাদেশের ঘরে ঘরে বেজেছে তার গান। অনেকেই তার অনুরাগী হয়ে ওঠেন। যে আমি উর্দু কিংবা হিন্দি বুঝি না, সেও তার গানে হয়ে যাই মাতোয়ারা। এখনও সেই গান হঠাৎ যখন শুনি, দুলিয়ে দেয় মন-প্রাণ। এখনও সক্রিয় আছেন সংগীত জগতে। অথচ নতুন কোনো গান দিয়ে তিনি সাড়া জাগাতে পারছেন না তিনি। তার সবটুকুই কি দেওয়া হয়ে গেছে? সে কি করে হয়? অসামান্য প্রতিভাবান এই শিল্পী। অল্প বয়সেই সাড়া জাগান। দ্রুতলয়ের কীবোর্ডিস্ট হিসেবে চমক দেখান। পিয়ানো বাজানোতে তার জুড়ি নেই। গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবেও তার সুখ্যাতি রয়েছে। নব্বই দশকের শুরুতে জন্মভূমি পাকিস্তানে তার গানের প্রথম একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এরপর চলচ্চিত্র জগতেও প্রবেশ করেন। প্রথম স্ত্রী জেবা বখতিয়ারের সঙ্গে একটি মাত্র চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তবে গানই হয়ে ওঠে তার ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। ২০০০ সালে ভারতের খ্যাতিমান শিল্পী আশা ভোঁসলের সঙ্গে জুটি বেঁধে প্রকাশ করেন রোমান্টিক গানের অ্যালবাম ‘কভি তো নজর মিলাও’। ব্যাস, তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। যেন বিস্ফোরণ ঘটান তিনি। বিশেষ করে ‘কভি তো নজর মিলাও’ ‘ভিগি ভিগি রাতও মে’ ও ‘লিফট করা দে’ সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। তাকে নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যায়। উপমহাদেশের সংগীত জগতে তিনি হয়ে ওঠেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। প্রথম অ্যালবামের রেশ ফুরাতে না ফুরাতেই ২০০২ সালে আসে ‘তেরে চেহরা’। এই অ্যালবামও বেশ সাড়া জাগায়। চারিদিকে শুধু আদনান সামি আর আদনান সামি। বাংলাদেশেও তখন তিনি তুমুল জনপ্রিয়।
২০০৩ সালে তাকে বাংলাদেশে আনার প্রক্রিয়া শুরু হলে আলোড়ন পড়ে যায়। যে আমি পারতপক্ষে কোলাহল এড়িয়ে চলি, সেও তার গান শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠি। কিন্তু চাইলেই তো আর টিকিট পাওয়া যায় না। যাহোক, ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থায় আয়োজিত তার কনসার্টে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়। মোটাসোটা শরীর নিয়ে তিনি মাতিয়ে দেন। এমনিতেই ছিলাম তার গানের অনুরাগী, লাইভ কনসার্ট দেখার পর রীতিমতো তার ভক্ত বনে যাই। যে কারণে অন্তরের তাগিদ থেকেই তার খোঁজ-খবর কিছুটা রাখার চেষ্টা করি। এরমধ্যে অবশ্য মন খারাপ করার মতো অনেক ঘটনা তার জীবনে ঘটেছে। সাংসারিক বিপর্যয় তো ছিলই। শারীরিকভাবেও সুস্থ ছিলেন না। অস্বাভাবিক ওজন নিয়ে সুস্থ থাকাটা কঠিন বৈকি। তাই চিকিৎসকদের পরামর্শে ডায়েট, এক্সারসাইজ ও ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে ওজন কমিয়ে নিজেকে আধখানা আদনান সামি করে ফেলেন। বাড়তি মেদ ঝরালে একদমই বদলে যান তিনি। কিন্তু দাম্পত্য জীবনের কলহের কারণে তিনি বোধকরি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। আদালত অব্দি ছোটাছুটি করতে হয়। এরপর আর প্রকৃত আদনান সামিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বয়স ৪০ হওয়ার অনেক আগেই একপ্রকার হারিয়ে গেছেন প্রিয় এই শিল্পী। মেধাবীরা তো এত সহজে নিভে যেতে পারেন না। অবশ্য এটাও ঠিক, বেশি প্রতিভা নিয়ে জন্মালে কারো কারো ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। আদনান সামিরও কি তাই হলো? তবুও প্রতীক্ষায় আছি, আবার জ্বলে ওঠবেন আদনান সামি। গানে গানে মাত করে দেবেন চারদিক।

বৃহস্পতিবার, ৪ অক্টোবর, ২০১২

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় : সুরের আকাশে শুকতারা

গান যে অনুভবের তারে তারে কবে মর্মে পশেছিল, সেটা বলতে পারবো না। তবে সুর যেহেতু যে কারো হৃদয়ে সহজেই দোলা দিতে পারে, আমাকে নিশ্চয়ই দিয়েছিল, একদম শৈশবেই। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যেতে পারে, অনুধাবন করার মতো উপলব্ধি হওয়ার পর থেকেই হৃদয়ে ঠাঁই করে নেন হেমন্ত-কিশোর অর্থাৎ বাংলা গানের অন্যতম দুই প্রবাদপুরুষ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও কিশোর কুমার। দু’জনের দুই রকম কণ্ঠমাধুর্য মন জয় করে নেয়। তবে হেমন্তকে কেন জানি খুব কাছের ও আপন মনে হয়। বাংলা গানের সোনালি যুগের একজন দিকপাল হয়েও তারমধ্যে কোনো গরিমা ছিল না। নিপাট ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন একদমই তাই। অমায়িক ও অকপট। গানেই নিজেকে পুরোপুরিভাবে সমর্পণ করেছিলেন।

তার উদাত্ত ভরাট কণ্ঠ হৃদয়ে অনায়াসেই দোলা দেয়। যে কারণে তার গাওয়া গানগুলো বুকের গভীরে স্থান করে নেয় চিরদিনের মতো। এখনও তার গান কোথাও বেজে ওঠলে চারপাশটা ভরে যায় ভালো লাগায়। নস্টালজিক হয়ে ওঠে মন। তার দরদমাখা কণ্ঠে প্রতিটি গানই হয়ে আছে দেদীপ্যমান। ‘তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো’, ‘কেন দূরে থাকো শুধু আড়াল রাখো’, ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে নাতো মন’, ‘আমার জীবনের এত খুশি এত হাসি’, ‘আজ দু’জনার দু‘টি পথ’, ‘এই রাত তোমার আমার’, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’, ‘পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব’, ‘ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’, ‘বসে আছি পথ চেয়ে’, ‘আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি’, ‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না’, ‘পৃথিবীর গান আকাশ কি মনে রাখে’, ‘আজ রাতে ঘুমিয়ে পড়ো না তুমি’, ‘যাবার আগে কিছু বলে গেলে না’, ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম’, ‘আয় খুকু আয়’, ‘সব কথা বলা হলো’, ‘তারপর, তার আর পর নেই’, ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’, ‘বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা’, ‘মেঘ কালো আকাশ কালো’, ‘কত দিন পরে এলে একটু বসো’, ‘এক গোছা রজনীগন্ধা হাতে দিয়ে বললাম’, ‘শোনো বন্ধু শোনো’, ‘রানার ছুটেছে’, ‘যে বাঁশি ভেঙে গেছে’, ‘এই বালুকা বেলায় আমি লিখেছিনু’, ‘কোনো এক গাঁয়ের বধুর’, ‘সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা’, ‘মুছে যাওয়া দিনগুলো আমায় যে পিছু ডাকে’, ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’, ‘আমিও পথের মতো হারিয়ে যাবো’-র মতো চিরায়ত গানগুলো কি কখনো ভোলা যায়? অলৌকিক এক সৌন্দর্য রয়েছে গানগুলোর পরতে পরতে। এ কারণে গানগুলো শোনা হচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। তার আবেদন একটুও ম্লান হয়নি। হয়ে ওঠেছে কালজয়ী। সঙ্গত কারণে বাংলা গান বললেই অনায়াসে মনের মণিকোঠায় ভেসে ওঠেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হিন্দি গান গেয়েও তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার কণ্ঠে রবীন্দ্র সংগীতও পেয়েছে অন্য এক মাত্রা। সংগীত পরিচালক হিসেবেও ছিল তার সুখ্যাতি। কিংবদন্তি এই শিল্পীর গান শুনতে শুনতে বেড়ে ওঠেছি। তাই তার গানগুলোকে মনে হয় আমার নিজেরই গান।
তবে তাকে কখনো কাছ থেকে দেখবো কিংবা সামনা-সামনি তার গান শুনবো, এমনটি কখনো ভাবিনি। অথচ কখনো কখনো স্বপ্নও সত্য হয়ে যায়। আমার জীবনেও এই স্বপ্নটি সত্য হয়েছিল। ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে এই শিল্পী শেষ বারের মতো বাংলাদেশে আসেন। যদিও তখন তিনি অনেকটাই বেলা শেষের গান। আগের মতো আর গাইতে পারতেন না। শারীরিকভাবেও সুস্থ ছিলেন না। গান গাইতে খুবই কষ্ট হতো। তবুও অনুরোধের ঢেঁকি গিলে জাতীয় প্রেস ক্লাবেও এসেছিলেন গান গাইতে। বিখ্যাত শিল্পী হলেও তার মধ্যে কোনো অহমিকা ছিল না। একদমই সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। পোশাক-আশাকেও ছিলেন অনাড়ম্বর। ক্লাবের দোতলার একটি কক্ষে ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে তার গানের আয়োজন করা হয়। তিনি সেখানেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে স্বভাবজাত ভঙ্গিতে একে একে গাইতে থাকেন তার চিরকালীন ভালোলাগার গানগুলো। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। দেখেছিলামও বিমুগ্ধচিত্তে। সেদিন নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে হয়েছিল। সেই দিনটি এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে স্মৃতিপটে। এই জীবনে একটি বড় পাওয়া কাছাকাছি বসে তার গান শোনা। তাকে কাছ থেকে দেখা। ১৯৮৯ সালের সে সফরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন কবি, লেখক ও অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল। এই অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হওয়ার ক’দিন পরেই মৃত্যু আবু হেনা মোস্তফা কামালকে অকালেই ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আমার কাছে কেন জানি বিস্ময়কর লেগেছে, এর মাত্র দু‘দিন পরই ২৬ সেপ্টেম্বর সংগীত জগতকে শূন্য করে দিয়ে চলে যান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
তিনি চলে গেলেও স্রোতাদের কাছে এখনও তিনি জাগরূক আছেন। তাকে অনুকরণ ও অনুসরণ করে কত জন যে শিল্পী হিসেবে জীবন গড়েছেন, কিন্তু তার স্থান কারো পক্ষে পূরণ করা সম্ভব হয়নি। বাংলা গানের ইতিহাসে এ যাবৎ কত কত শিল্পী গান গেয়েছেন। কিন্তু তারমধ্যে স্ব-মহিমায় অনন্য হয়ে আছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তিনি যে সুরের আকাশে শুকতারা।
 
(জাতীয় প্রেস ক্লাবের স্মরণিকায় প্রকাশিত।)

বৃহস্পতিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

ফারিয়া লারা : উড়ন্ত এক প্রজাপতি

তখন দৈনিক পত্রিকায় কর্মরত। অধিকাংশ সময় থাকতো লেট-নাইট ডিউটি। বাসায় ফিরতে ফিরতে সকাল হয়ে যেত। যে কারণে সারা দুপুর ঘুমিয়ে কাটাতাম। সেদিন সবে ঘুমিয়েছি, এমন সময় আমার অন্ধকার ঘরে আচমকা জ্বলে ওঠে আলো। তড়িঘড়ি মশারিও খুলে ফেলা হয়। সেইসঙ্গে বেশ খানিকটা হৈ চৈ ভেসে আসে কানে। এমন তো হওয়ার কথা নয়! ঘুমের গভীরে তলিয়ে যাওয়ার আগেই জেগে ওঠতে বাধ্য হলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগে দেখি, আমার রুমে দাঁড়িয়ে অপরিচিত একজন তরুণী। হালকা পাতলা গড়ন। মুখে দুষ্টু দুষ্টু কিশোরী হাসি। চোখে-মুখে আলোর বিচ্ছুরণ। আমি বেশ অপ্রস্তত হয়ে যাই। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না,আমি কি ঘুমিয়ে আছি নাকি স্বপ্ন দেখছি। সেটা বোঝার আগেই মিষ্টি কণ্ঠে শুনতে পেলাম, দুলাল ভাই, এত বেলা করে ঘুমালে চলবে? ওঠেন ওঠেন। আসেন কথা বলি। এভাবেই আধো ঘুম অধো জাগরণে পরিচয় ফারিয়া লারার সঙ্গে। এটাই অবশ্যই তার ধরন। যে কাউকেই চমকে দিয়ে বেশ মজা পেত। তার ভঙ্গিমা একদমই আনকমন। আমার ছোট বোন ছন্দার বান্ধবী লাজিনা মুনার বোন। খ্যাতিমান লেখিকা সেলিনা হোসেনের কনিষ্ঠা কন্যা। তবে তার সঙ্গে পরিচয় হলে অন্য সব পরিচয় হারিয়ে যেতে সময় লাগতো না। লারা নিজেই নিজের পরিচয়। প্রাণবন্ত, প্রাণোচ্ছ্বল ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা উজ্জ্বল একটি মেয়ে। মাটিতে পা থাকলেও লারা যেন সব সময় উড়ে বেড়াতো। অস্থির, চঞ্চল ও ছটফটে। তবে অসম্ভব স্মার্ট, ধারালো ও ঝলমলে। নতুন কিছু করার প্রতি তার ছিল অন্তহীন উৎসাহ ও উদ্দীপনা। কখনও থেমে থাকতো না। যে কোনো কাজেই নিজেকে অনায়াসে জড়িয়ে ফেলতো। কত দিকেই যে ছিল তার বিচরণ। ছোট্ট এই জীবনে তার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার ছিল টইটম্বুর।

ঢাকা বিমানবন্দরে শ্রীলঙ্কার দীনেশ, নেপালের হরি, কাজী আলম বাবু, দুলাল মাহমুদ ও ফারিয়া লারা


১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির উদ্যোগে আয়োজন করা হয় সাউথ এশিয়ান স্পোর্টস প্রেস কমিশন (সাসপক)-এর সম্মেলন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তাতে অংশ নেয়। এই সম্মেলন আয়োজনে লারার উপস্থিতি আমাদেরকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা থেকে শুরু করে বিদেশি ডেলিগেটদের সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে তার কোনো তুলনা ছিল না। ডেলিগেটরা চলে গেলেও তাদের সঙ্গে লারার সম্পর্ক কিন্তু অটুট থাকে। একবার তার সঙ্গে কারো পরিচয় হলে তাকে কেউ ভুলতে পারতেন না। আসলেই তাকে ভোলা যায় না। লারার চলে যাওয়াটা আমার কাছে বড় হয়ে এক ধাক্কা হয়ে আসে। সে সব সময় নতুন কিছু করতে চাইতো। নিজে ছিল একটা রঙিন প্রজাপতির মতো। তার স্বপ্ন ছিল আকাশে উড়ার। পাইলট হয়ে উড়তেও শুরু করেছিল। জীবনের বিশাল আকাশে উড্ডয়নের মুহূর্তে হঠাৎই থেমে যেতে হয় তাকে। তার এভাবে থেমে যাওয়াটা ছিল খুবই কষ্টকর ও বেদনাদায়ক। তার কথা মনে পড়লেই মন খুব খারাপ হয়ে যায়। মনে পড়ে যায় টুকরো টুকরো স্মৃতি। বুকের মধ্যে বইতে থাকে দীর্ঘশ্বাস।

সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

কবি শান্তিময় বিশ্বাস : হিংস্র পৃথিবীর মায়াবী এক মানুষ

কিছু কিছু মানুষ আছেন, হৈ-হট্রগোলের মধ্যে বসবাস করলেও কোনো কিছু তেমনভাবে তাদের স্পর্শ করে না। প্রতিকূল পরিবেশেও নিজের আলাদা একটি জগত তৈরি করে নিতে পারেন। কোলাহলের মধ্যে থেকেও জীবনকে পর্যবেক্ষণ ও উপভোগ করেন ধ্যানীর মগ্নতায় আর গভীর ভালোবাসায়। এমন সহজাত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন কবি ও সাংবাদিক শান্তিময় বিশ্বাস, আমাদের প্রিয় শান্তি দা। নিভৃতচারী এই মানুষটি অনেকটা নীরবেই চলে গেলেন। অনেক দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ১২ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে পরলোকে পাড়ি জমান আপাদমস্তক শান্তিময় ও নিরীহ এই মানুষটি। নেত্রকোনার কৃতি সন্তান শান্তিময় বিশ্বাস।


১৯৪৬ সালে কলমাকান্দা থানার মনতলা গ্রামের একটি রাজনৈতিক পরিবারে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। রাজনৈতিক সচেতন হলেও রাজনীতির সঙ্গে তিনি ঘনিষ্টভাবে জড়াননি। সেই স্কুল বয়স থেকেই কবিতাই হয়ে ওঠে তার জীবন ও জগত। নেত্রকোনা দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় কবি হিসেবে তার হাতেখড়ি হয়। নেত্রকোনা কলেজ এবং আনন্দমোহন কলেজে পড়ার সময় কবিতার নন্দনকাননে হরেক রকম ফুল ফুটিয়ে সবার মনোযোগ কেড়ে নেন। খ্যাতিমান লেখক খালেকদাদ চৌধুরীর সম্পাদনায় নেত্রকোনা থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক ‘উত্তর আকাশ’ ও ‘সৃজনী’ সাহিত্য পত্রিকায় রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, জীবন চৌধুরীর পাশাপাশি লিখতেন শান্তিময় বিশ্বাস, হেলাল হাফিজের মতো প্রতিভাবান ও মেধাবী কবিরা। যে কারণে জেলা শহরে বসবাস করেও কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে তাকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। বরং নেত্রকোনার শিল্প ও সাহিত্য জগত যাদের আলোয় আলোকিত হয়েছে, তিনি তাদের অন্যতম। আজকের অনেক প্রতিষ্ঠিত কবি ও লেখকের কাছে তিনি ছিলেন আদর্শ ও অনুপ্রেরণা। কিন্তু তার পরিচিতির বলয়টা সেই অনুপাতে একদমই বাড়েনি। কেন বাড়েনি, এটা তার কাছের মানুষরাই অনুভব করতে পারেন। বুঝতে পারেন।
খুবই নিভৃত স্বভাবের মানুষ ছিলেন তিনি। প্রচারের ঢক্কা-নিনাদ এড়িয়ে চলতেন। নিজের একান্ত জগতেই বসবাস করতেন তিনি। তবে সেই জগতটা ছিল আনন্দ-রসে টইটুম্বুর। তাতে ছিল কেবল বই পড়া, গান শোনা আর কবিতা লেখা। এসব নিয়েই মগ্ন থাকতেন আপন চৈতন্যে। অনর্গল লিখতেন না। লিখতেন আপন খেয়ালে। কবিতা ও কবিতার বই প্রকাশের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন মিতচারী এবং শুদ্ধচারী। সারা জীবন কাব্যলক্ষীর সাধনা করেও তার গ্রন্থসংখ্যা সর্বসাকুল্যে একটি। ১৯৮৭ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয় তার কাব্যগ্রন্থ ‘হাঙরের মতো হিংস্র ইলিশের মতো মায়াবী’। তার অসংখ্য কবিতা জমে আছে অপ্রকাশের বেদনা নিয়ে। হারিয়েও গেছে অনেক কবিতা। তার সব কবিতা দুই মলাটের মধ্যে আনা গেলে সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন হতো একজন শক্তিমান কবির। উপকৃত হতো বাংলা সাহিত্য। সংসারে থেকেও শান্তিময় বিশ্বাস কখনো বৈষয়িক হতে পারেননি। সংসার চালানোর জন্য যে আর্থিক সামর্থ্যর প্রয়োজন হয়, সেটুকু বহন করতেও তাকে বেশ হিমসিম খেতে হয়।
স্বাধীনতার পর সাংবাদিকতার অনিশ্চিত জীবনকে বেছে নেওয়ায় কখনো আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের দেখা পাননি। মেধা ও যোগ্যতা থাকাসত্ত্বেও বড় কোনো প্রতিষ্ঠানে নিজেকে জড়ানোরও তাগিদ অনুভব করেননি। যতটুকু প্রয়োজন, তার বাইরে তাকানোর গরজ অনুভব করেননি। কোথাও থিতুও হতে পারেননি। অনেক সময় বেকারও থেকেছেন। এ নিয়ে তাকে খুব একটা হাপিত্যেশ করতেও শোনা যায়নি। সংসারের হাল স্কুল শিক্ষিকা সহধর্মিনীর ওপর ছেড়ে দিয়ে দিব্যি হেসে-খেলে জীবন যাপন করেছেন। তাই বলে তাকে কখনো অসুখী বা অসন্তুষ্ট মনে হয়নি। উপরন্ত দেখলে মনে হতো, তিনি যেন একজন পরিপূর্ণ সুখী মানুষের প্রতিকৃতি। তবে মোটেও দায়িত্বহীন ও বাউন্ডুলে ছিলেন না। সংসারের দায় মেটাতে কাজ করেছেন সংবাদ, আজাদ, বাংলার বাণী, খবর, দিনকাল, কিষাণের মতো দৈনিক পত্রিকা, সোভিয়েত বার্তা সংস্থা এপিএএন, বার্তা সংস্থা ইউএনবিতে। মৃত্যর আগ অব্দি কর্মরত ছিলেন বাংলাদেশ বেতারের বার্তা বিভাগে। ৩৫ বছরের সংসার জীবনে তিনি ছিলেন পুত্র প্রোটন বিশ্বাস ও কন্যা মৌটুসী বিশ্বাসের জনক। সংগীতের প্রতি তার ছিল অসম্ভব ভালোবাসা। তার এই ভালোবাসাটা চারিয়ে দিতে পেরেছেন পুত্রের হৃদয়ে। রবীন্দ্র ভারতী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীতে পড়াশুনা শেষ করে ঢাকায় সংগীত নিয়ে মেতে আছেন প্রোটন।
 দৈনিক বাংলার বাণীতে কর্মরত অবস্থায় তাকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়। প্রথম দিন থেকেই সবার মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার অদ্ভুত এক ক্যারিশমা ছিল তার। অনায়াসেই সবার মন জয় করে নিতে পারতেন। তার চলাফেরা, তার কথা বলা, তার আন্তরিক ব্যবহার, তার কাজ করার ধরণ, তার সিগারেট খাওয়ার ভঙ্গিমার মধ্যে থাকতো একটা ছন্দের দোলা। পোশাক-আশাকের মধ্যে ছিল একটা পরিপাট্য ও যত্মের ছাপ। পরিশীলিত ও রুচিবান মানুষ ছিলেন তিনি। এমনকি মাথার চুল কখনোই এলোমেলো রাখতেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় মাষ্টার্স করলেও অনুবাদেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। হাতের লেখাও ছিল চমৎকার। তবে তার জীবনযাপন ও জীবনদর্শন ছিল মুগ্ধ করার মতো। কোনো মোহ তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। সম্ভবত মহাত্মা গান্ধীর দর্শন ‘সিম্পল লিভিং অ্যান্ড হাই থিঙ্কিং‘ ছিল তার জীবনের মূলমন্ত্র। কেউ চলে যাওয়ার পর আমরা কারণে কিংবা অকারণেই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠি। কিন্তু শান্তি দা প্রকৃতঅর্থেই ছিলেন প্রশংসনীয় এক ব্যক্তিত্ব। এমন একজন মানুষ ইদানিং খুব কমই চোখে পড়ে। নিপাট ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন একেবারেই তাই। মুখে হাসি ছাড়া তাকে খুব একটা দেখা যেত না। কথা বলতেন খুব মজা করে। তাতে থাকতো মেধার দীপ্তি ও কৌতুকের সংমিশ্রণ। তিনি যেভাবে কথা বলতেন, যদি কাউকে কটু কথাও বলতেন, তাতে কেউ খুব একটা মাইন্ড করতেন না।
শান্তি দার বই কেনার প্রতি ছিল প্রচণ্ড নেশা। ধার করে ঘি না খেলেও কোনো বই পছন্দ হলে সেটা না কিনে ফিরতেন না। ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না’- সৈয়দ মুজতবা আলীর এ কথাটির তিনি ছিলেন সার্থক উদাহরণ। তিনি সত্যি সত্যিই দেউলিয়া হয়েও বই কিনতেন। তার সঞ্চয়ে অর্থ-কড়ি, সহায়-সম্পদ না থাকলেও ছিল অসংখ্য বই আর গানের বিশাল ভাণ্ডার। প্রায়শই পল্টনের পুরনো বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারতেন। অনেক সময় বই পছন্দ হলো, অথচ পকেটে পর্যাপ্ত টাকা নেই। এ কারণে কোনো কোনো সময় একান্ত কাছের মানুষের কাছে ছুটে যেতে একটুও দ্বিধা করতেন না। প্রয়োজনীয় টাকাটা সংগ্রহ করে খুব বেশি দেরিও করতে চাইতেন না। কারণ মনটা পড়ে থাকতো পছন্দ করা বইয়ের পাতায় পাতায়। কাঙ্খিত বইটি নিজের করে না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি পেতেন না। এই একটা ক্ষেত্রেই তাকে মনে হতো অস্থির ও চঞ্চল। তবে কারো কাছে তিনি ঋণী থাকতে মোটেও পছন্দ করতেন না। যত অল্প পরিমাণ অর্থই হোক না কেন, নির্ধারিত সময়ে টাকাটা ফেরৎ দিয়ে তবেই তিনি স্বস্তি পেতেন। তার সঙ্গে দেখা হলে দুষ্টুমি করে বলতাম, এইমাত্র পৃথিবীতে ‘শান্তি’ নেমে এলো। শুনে তিনি মিটি মিটি হাসতেন। হায়! তার মোহনীয় হাসিটা আর কখনোই দেখতে পাবো না।
(২০১২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)

সোমবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১২

সুরের ধারা ঝরে যেথায়............


বাংলাদেশে রবীন্দ্র চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন নন্দিত দু’জন নারী। উভয়ই প্রথিতযশা রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উদ্যোক্তা। একজন সন্জীদা খাতুন। আরেকজন তারই অনুসারী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। উভয়ই তাদের কণ্ঠমাধুর্য দিয়ে শ্রোতাদের হৃদয়ে আলাদা একটা স্থান করে নিয়েছেন। সংগত কারণেই রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী হিসেবে তাদের নাম আলাদা মর্যাদায় উচ্চারিত হয়। প্রবীণা সন্জীদা খাতুন এখন আর আগের মতো গাইতে পারেন না। তবে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা স্ব মহিমায় সমুজ্জ্বল। বাংলাদেশে তো বটেই, ভারতেও তাকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্র সংগীতের বড় কোনো আসরের কথা ভাবাই যায় না। বিশেষ করে, পশ্চিমবঙ্গের সংগীত চ্যানেল ‘তারা মিউজিক’য়ে প্রতিদিনই শোনা যায় তার সুরেলা আওয়াজ।
রবীন্দ্র সংগীতের শিল্পী হিসেবেই শুধু নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেননি সন্জীদা খাতুন আর রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। রবীন্দ্র সংগীতকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে এ দু’জনের অবদান বিস্ময়কর। বাংলা নববর্ষকে বাঙালির বুকে চিরস্থায়ীভাবে আসন করে দিচ্ছেন এই দুই সংগীত কিংবদন্তি। সন্জীদা খাতুন আর ছায়ানট তো একই মালায় গাঁথা। ষাটের দশকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে ছায়ানটের সাহসী ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় হয়ে আছে অমিলন। তারই অংশ হিসেবে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে অবিচ্ছেদ্য অংশ ছায়ানট। আজও ছায়ানটের পয়েলা বৈশাখ বরণ করে নেয়াটা নাগরিক জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ। ছায়ানটের গৌরবোজ্জ্বল অবদানের ক্ষেত্রে অন্যতম কা-ারি হলেন সন্জীদা খাতুন। এখনও বাংলাদেশের রবীন্দ্র চর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছায়ানট। রবীন্দ্র চেতনাকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বয়সের ভারকে তুচ্ছ করে সন্জীদা খাতুন ছায়ানটের সভাপতি হিসেবে অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ। তার সময় ছায়ানটের ব্যাপ্তি ও কার্যক্রম অনেক বেড়েছে। নেয়া হচ্ছে নতুন নতুন পদক্ষেপ।
ছায়ানটের ছায়াতলে লালিত রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাও রবীন্দ্র চর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। শান্তিনিকেতনের মেধাবী এই ছাত্রী ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সুরের ধারা’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুৃর আর রবীন্দ্র সংগীতকে ভালোবেসে এবং তার মোহরদি‘র (রবীন্দ্র সংগীতের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়) পরামর্শে, অনুপ্রেরণা ও নির্দেশনায় অনেকটা একক উদ্যোগে তিনি গড়ে তোলেন এই প্রতিষ্ঠানটি। খুব নীরবে কাজ করে গেলেও আজ ‘সুরের ধারা’ একটি প্রতিষ্ঠিত নাম। লালমাটিয়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ‘সুরের ধারা’র মাধ্যমে প্রতি বছর অসংখ্য ছেলেমেয়ে রবীন্দ্র সংগীতে দীক্ষা নিয়ে চলেছেন। পাশাপাশি শেখানো হয় উচ্চাঙ্গসংগীত সহ মূলধারার অন্যান্য গান। এছাড়া গত প্রায় এক যুগ ধরে বাংলা বছরের শেষ দিনটিতে ‘সুরের ধারা’ নিয়মিতভাবে আয়োজন করে আসছে বর্ষশেষের সংগীতানুষ্ঠান। সেটিও হয়ে ওঠেছে নাগরিক জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ। তবে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ‘সুরের ধারা’র অনুষ্ঠানমালা ছিল এককথায় অসাধারণ ও বিস্ময়কর। ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে তিন দিনব্যাপি রবীন্দ্র উৎসব বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ছিল সেরা আয়োজন। দুই বাংলার খ্যাতিমান শিল্পী, লেখক, সংগঠকদের নিয়ে সংগীত, আবৃত্তি, নাটক, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, চলচ্চিত্র, প্রদর্শনী এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সহস্র কণ্ঠে রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশনা সবাইকে মুগ্ধ করে দেয়। এই উৎসবে পাশ্চাত্যের যন্ত্রানুষঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গান পরিবেশন করেন ১৭টি দেশের ৩৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত ‘গান্ধর্বলোক অর্কেস্ট্রা‘। রবীন্দ্রনাথের গীতবিতানের ২২২২টি গান ডিভিডিতে ধারণ করা হয়। ২২টি ডিভিডিতে ধারণকৃত এই পুরো আয়োজনের নামকরণ করা হয় ‘শ্রুতি গীতবিতান’। ছোট্ট পরিসরের ‘সুরের ধারা’ এক লহমায় যেন ছাড়িয়ে যায় নিজেকে। রবীন্দ্র উৎসবের মাধ্যমে তাদের খ্যাতি যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সাংগঠনিক শক্তি। এখন ‘সুরের ধারা’ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে কোনো বড় অনুষ্ঠান আয়োজন করার সামর্থ রাখে। তাই তাকে ঘিরে উড়ে প্রত্যাশার রঙধনু।


এ কারণে এবার প্রথম ‘সুরের ধারা’ বর্ষশেষের পাশাপাশি বর্ষবরণ করার জন্য বিশাল কলবরে আয়োজন করে দুই দিনব্যাপি অনুষ্ঠানমালার। আগে এটি হত একদিনেই। চৈত্রের শেষ দিনে বর্ষবিদায়ের পরের দিন ভোরে সহস্রকণ্ঠে বরণ করে নেয়া হয় বাংলা নববর্ষকে। লালমাটিয়ার নির্জনতা ছেড়ে এবার এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের উন্মুক্ত চত্বরে। এই আয়োজন এবার বিবেচিত হচ্ছে নতুন সংয়োজন হিসেবে। বিপুলসংখ্যক দর্শক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন মুগ্ধতা নিয়ে। ‘সুরের ধারা’র যাবতীয় কার্যক্রম আবর্তিত হয় রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে কেন্দ্র করে। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীরা তারই নেতৃত্বে যে কোনো অসাধ্য কাজ সম্পন্ন করার ব্যাপারে অনেক বেশি আন্তরিক ও একতাবদ্ধ। ‘সুরের ধারা’র তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী শামীমা আক্তার শাওন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের সত্তায় মিশে আছেন। সেই শৈশবে তিনি স্থান করে নেন হৃদয়ে। তবে অল্প বয়সে আমার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ইচ্ছে থাকাসত্ত্বেও রবীন্দ্র সংগীত শেখা হয়নি। কিন্তু এখন এই সুযোগ এনে দিয়েছে আমার প্রিয় প্রতিষ্ঠান ‘সুরের ধারা’। এখানে শুধু রবীন্দ্র সংগীতই বুকে ধারণ করছি না, সেইসঙ্গে সাংগঠনিক বিষয় সহ অনেক কিছু শিখতে পারছি। ‘সুরের ধারা’র পরিবেশটা একটি পরিবারের মতো। তাই যে কোনো আয়োজন নিজেদের মনে করে সেটা সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার জন্য কারোই মোটেও কার্পণ্য থাকে না।‘ এটাই ‘সুরের ধারা’র এগিয়ে চলার অন্যতম মন্ত্র ও চালিকাশক্তি। ‘সুরের ধারা’র এই মন্ত্র ও শক্তি ‘হৃদয় মোর গানের তারা উঠবে ফুটে সারে সারে’।

নিবেদিতপ্রাণ এক সাংবাদিকের কথা

এখন তার কথা কারো খুব একটা মনে পড়ে না। স্মৃতিতে ধুলো জমতে জমতে অনেকটাই বিস্মৃত। অথচ একসময়ের প্রাণচঞ্চল সংবাদ কক্ষের মধ্যমণি ছিলেন তিনি। সারা দুনিয়া থাকতো তার হাতের মুঠোয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কত বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চোখের পলকে। তার পরিকল্পনায় প্রতিদিন পাঠকরা পেতেন ঝলমলে সব সংবাদপত্র। আর এখন সংবাদপত্রেই উপেক্ষিত, নিবেদিতপ্রাণ এই সংবাদব্যক্তিত্ব। সাংবাদিকতা নামক অধরা সোনার হরিণের পেছনে ছুটে জীবনকে নিংড়ে দিয়ে অনেক অপ্রাপ্তির বেদনা নিয়ে চলে গেছেন ইহলোক থেকে। তিনি সব্যসাচী সাংবাদিক মীর নূরুল ইসলাম। ছোট ও বড় - সবার কাছে তিনি ‘মীর ভাই’ নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন সৎ ও নির্লোভ সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ। সাংবাদিকতাকে পাথেয় হিসেবে নিয়ে উৎসর্গ করেন জীবন। কোনো প্রাপ্তির আশায় সাংবাদিকতাকে করেননি প্রলোভনের সিঁড়ি। এ কারণে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও সংবাদপত্র ছাড়া অন্য কোনো মোহ তাকে কখনোই আকৃষ্ট করতে পারেনি। নতুন কোনো সংবাদপত্র প্রকাশনার চিন্তা-ভাবনা হলেই সবাই তাকে মনে করতেন নির্ভরযোগ্য। তার সততা, তার সুখ্যাতি, তার দায়িত্বশীলতার কারণে তাকে নেওয়ার জন্য চলতো তোড়জোড়।
মীর নূরুল ইসলামের জন্ম বাংলা ১৩৪১ সালের ১১ অগ্রহায়ণ টাঙ্গাইলের কালিহতি থানার ইছাপুর গ্রামে। ছোট বেলায় থেকেই ছিল সাহিত্যের ঝোঁক। স্কুল বয়সে কলকাতার সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার ছড়া। ১৯৪৮ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শেষ ব্যাচ ছিল সেটি। আর্থিক সংকটের কারণে আইএসসি পরীক্ষা দিতে না পারায় জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমান ঢাকায়। ১৯৫২ সালে রেডিও পাকিস্তানে ‘এলান’য়ের সহ-সম্পাদক হিসেবে চাকরি নেন। ১৯৫৬ সালে তার সংবাদপত্রে হাতেখড়ি হয় দৈনিক সংবাদ-য়ে। তবে ৪/৫ দিন কাজ করার পর কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেহাদ-য়ে যোগ দেন সহ-সম্পাদক হিসেবে। মাসিক বেতন ১০০ টাকা। কিছু দিন পর একই পত্রিকার শিশুদের পাতা ‘সবুজ মেলা’ার দায়িত্ব পান। যোগ হয় বাড়তি ৭৫ টাকা। ইত্তেহাদ বন্ধ হলে তার ঠিকানা হয় আবুল কালাম শামসুদ্দীন সম্পাদিত দৈনিক জেহাদ-য়ে। জেহাদ বন্ধ হলে ১৯৬৪ সালে যোগ দেন দৈনিক পাকিস্তান-এ। এই প্রথম বেতন স্কেল সহ নিয়োগপত্র পান। ১৯৬৯ সালে দৈনিক সংগ্রাম বের হলে তাকে বার্তা সম্পাদক করা হয়। বছরখানেক কাজ করার পর বনিবনা না হওয়ায় শিফট-ইন-চার্জ হিসেবে চলে আসেন দৈনিক পূর্বদেশ-য়ে। ১৯৭২ সালে হন বার্তা সম্পাদক। ১৯৭৫ সালে সরকারি নির্দেশনায় পূর্বদেশ বন্ধ হয়ে গেলে রাজস্ব বোর্ডের অধীনে অ্যাসিস্ট্যান্ড কালেক্টর পদে নিয়োগপত্র পান। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার হাতছানি থাকলেও লোভনীয় এই চাকরিতে না গিয়ে তিনি রাজশাহী থেকে প্রকাশিত দৈনিক বার্তার বার্তা সম্পাদক পদটাকে মনে করেন শ্রেয়তর। একই পদে ১৯৮২ সালে যোগ দেন দৈনিক বাংলার বাণীতে। ১৯৮৪ সালে দৈনিক জনতা প্রকাশিত হলে তিনি হন সম্পাদক। কিছু দিন পর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বকোণের নির্বাহী সম্পাদক এবং ১৯৮৬ সালে একই পদে পুনরায় দৈনিক বাংলার বাণীতে যোগ দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করেন দৈনিক মুক্তকণ্ঠের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে। কর্মরত অবস্থায় ২০০১ সালের ৩ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন সাংবাদিকতায় উৎসর্গীকৃতপ্রাণ এই ব্যক্তিত্ব।
লেখক হিসেবেও তিনি ছিলেন সমাদৃত। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার ছিল সবর উপস্থিতি। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘মনের মানুষ’ ও নাটক ‘আড্ডা’। তার লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল হাস্যরস। তবে হাস্যরসের মধ্যে জীবনের বাস্তবতা তুলে ধরতেন তীর্যক ভাষায়। নিজের জীবন নিয়েও তিন অনায়াসে উপহাস করতে পারতেন। বাংলাদেশে রম্যরচনা লেখার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা। পত্র-পত্রিকা, বেতার, টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে তার অসংখ্য লেখা।
সাংবাদিকতাকে যারা একটি আদর্শ হিসেবে নিয়েছিলেন, তিনি তাদের অন্যতম। কঠিন দারিদ্র্যের মধ্যে দিনাতিপাত করেছেন, তবুও কখনো আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। কখনো চাকরিচ্যুত হয়ে, কখনো বেতন বঞ্চিত হয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হয়েছেন। বিশাল পরিবারের বোঝা টেনে নিতে হিমসিম খেয়েছেন, তবুও মাথা নত করেননি। সাংবাদিকতা আর লেখালেখির মাধ্যমেই কষ্টকর জীবন যাপন করেছেন। এ কারণে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আর্থিক স্বচ্ছলতার মুখ দেখেননি। তবুও লক্ষ্য থেকে সরে দাঁড়াননি। একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে বিভিন্ন মত ও পথের পত্রিকায় কাজ করেছেন, কিন্তু বুকের মধ্যে সমুন্নত রেখেছেন আদর্শের পতাকা। তার মত অনেকের আত্মনিবেদনে আজ সাংবাদিকতা একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির উপর এগিয়ে চলেছে। নিপাট ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন তেমনটি। দায়িত্বশীল পদে কাজ করেও তাকে কখনও উত্তেজিত হতে দেখা যায়নি। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে, দ্রুত কাজ করতে, দ্রুত লিখতে তিনি ছিলেন পারঙ্গম। রসিকতায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়। যে কোনো জটিল পরিস্থিতিকে হাসি-মশকরা দিয়ে তিনি সহজ করে দিতেন। সহকর্মীদের কাজের উৎসাহ দেওয়ার ক্ষেত্রেও তার জুড়ি ছিল না। তার হাত ধরে সাংবাদিকতার জগতে কত জনের হাতখড়ি হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। নবীন সাংবাদিকদের কাছে তিনি ছিলেন ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড।
এ দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতায় যে আলোর ঝরনাধারা, তা এসেছে অনেকের ত্যাগ-তিতিক্ষা আর সংগ্রামের মাধ্যমে। আলোকবর্তিকা হয়ে যারা পথ দেখিয়েছেন, তাদের অন্যতম হলেন মীর নূরুল ইসলাম। তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি ও ভালোবাসা।

(দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত।)

বুধবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

প্রথম কবিতা

আশির দশকের শেষ দিক। সময়টা এমন, মনের কথা মুক্তভাবে বলার উপায় নেই। চারপাশে বিধি-নিষেধের একটা বেড়াজাল। এমন একটা পরিবেশে শাঁখারিবাজার থেকে প্রকাশিত হবে তাদের বাৎসরিক পূজা সংখ্যা। এই পূজা সংখ্যার সার্বিক তত্ত্বাবধানে আমাদের সুধীর দা। বিখ্যাত সুধীর কৈবর্ত দাস। মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক। আমি তখন দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় কর্মরত। খেলাধুলার সঙ্গেই যোগাযোগটা বেশি। স্ইে সুবাদে সুধীর দার সৌজন্যে প্রতি সংখ্যা পূজা সংখ্যায় আমাকে ক্রীড়া বিষয়ক একটি নিবন্ধ লিখতে হয়। সে বছর কী মনে করে সুধীর দাকে বললাম, এবার কবিতা লিখবো। সুধীর দার হাতে নতুন একজন কবির আবির্ভাব হবে, সেই বিবেচনায় তিনিও বোধকরি রাজী হয়ে গেলেন। কবিতার বাগানে আমার বিচরণ নেই। মনের আনন্দে টুকটাক লিখেছি। সেটা একান্তই নিজের জন্য। আমি ছাড়া আর কারো পড়ার সুযোগ হয়নি। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি কবিতা লিখে চোখ-কান বন্ধ করে তুলে দেই সুধীর দার হাতে। এই প্রথম কোনো কবিতা প্রকাশের জন্য দিলাম। কবিতা হয়েছিল কিনা জানি না। তবে তাতে বোধকরি সেই সময়ের একটা ঝাঁঝ ছিল। সেটা বিচক্ষণ সুধীর দা বুঝতে পেরেছিলেন। পূজা সংখ্যা হাতে নিয়ে দেখি, আমার কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছে। তবে সব কিছু বিবেচনা করে আধখানা কবিতা ছাপিয়েছেন সুধীর দা। সেই সময়ের বিবেচনায় এটা করা ছাড়া তার গত্যন্তর ছিল না। আমি তো তাতেই খুশি। জীবনের প্রথম প্রকাশিত কবিতা বলে কথা। খুশির রেশ ফুরিয়ে যেতে না যেতেই সুধীর দা হাতে তুলে দিলেন পঞ্চাশ টাকা। কীসের টাকা? সুধীর দা জানালেন, এটা কবিতার সন্মানী। আমি তো থ্ মেরে যাই। কবিতা ছাপা হয়েছে, সেটাই তো বেশি। তার ওপর আবার সন্মানী! প্রথম কবিতা প্রকাশ করে সন্মানী পাওয়াটা জীবনের একটা স্মরণীয় ঘটনা হয়ে আছে। এরপর আর কখনো কবিতা প্রকাশের জন্য কোথাও দেয়া হয়নি। সন্মানীও পাওয়া হয়নি।


কয়েক দিন আগে প্রণব দা, চ্যানেল আইয়ের সিনিয়র বার্তা সম্পাদক প্রণব সাহা, ফোন করে জানালেন, কবিতা পড়বা নাকি? কবিতা পড়বো! কোথায়? তিনি জানালেন, জাতীয় প্রেস ক্লাবে। ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ভাষা শহীদ দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্যদের স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। দৈনিক ইত্তেফাকের ফরিদা ইয়াসমীন সাংস্কৃতিক কমিটির আহ্বায়ক এবং প্রণব দা এই কমিটির সদস্য। তাদের আমন্ত্রণে আমি কি মনে করে সম্মতি জানাই। ক’দিন পরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের কবিতা পাঠের জন্য একটি আমন্ত্রণলিপি পাই। আমন্ত্রণলিপির খামে আমার পরিচয় দেয়া হয়েছে কবি দুলাল মাহমুদ হিসেবে। যদিও আমি কবি নই, তারপর এই খামটি আমাকে বেশ রোমাঞ্চিত করে। একবুক রোমাঞ্চ ও শিহরণ নিয়ে নির্ধারিত দিনে কবিতা পাঠ করতে যাই। মঞ্চে বসে আছেন দেশবরেণ্য কবি বেলাল চৌধুরী। সামনে দর্শক সারিতে কবি ও সাংবাদিকরা। কোনো রকমে নিজের লেখা একটি কবিতা পাঠ করি। মঞ্চ থেকে নামতেই হাতে একটি খাম ধরিয়ে দেন ফরিদা ইয়াসমীন। তাতে ছিল ৫০০ টাকার প্রাইজবন্ড। মঞ্চে জীবনে প্রথম কবিতা পাঠ করে সন্মানী পেলাম। নিজেকে বেশ কবি কবি মনে হতে থাকে।

শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

চিত্রকলা বোঝা কিংবা না বোঝা

প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো, আমি চিত্রকলা নিয়ে বলার মত কেউ নই। সেটা নই বলেই এই লেখা। তবে চিত্রকলার বিষয়ে কিছুটা উৎসাহী বলা চলে। চিত্রকলা আমাকে মুগ্ধ করে। করে বলেই যে কোনো চিত্রকলা থেকে সহসা চোখ ফেরাতে পারি না। সে রঙদার হোক কিংবা রঙহীন হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। চোখ ও মনকে আবিষ্ট করলেই তন্ময় হয়ে দেখি। ছবি আঁকিয়েদের আমার ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী মনে হয়। সাদা ক্যানভাসকে কি অপরূপ দক্ষতায় বর্ণময় করে তোলেন চিত্রশিল্পীরা।


এ কারণে পত্রিকার চিত্রকলা বিষয়ক সমালোচনাগুলোও আমাকে বেশ আকৃষ্ট করে। সেটা অবশ্য চিত্রসমালোচকদের লেখার নৈবদ্যে। ভাষার এমন প্রাসাদগুন যে না পড়ে থাকা যায় না। একইসঙ্গে সমালোচনা পড়ে চিত্রকলা একটু-আধটু হৃদয়ঙ্গম করতে চাই। কখনো-সখনো গ্যালারীতে গিয়ে ছবি দেখার সুযোগ হয়। একজন সাধারণ দর্শকের চোখে যতটা পারা যায় চিত্রকলার নান্দনিক সৌন্দর্যটুকু অনুধাবন করার চেষ্টা করি। কবুল করে নেওয়া ভালো, আধুনিক চিত্রকলা আমি তেমনভাবে আত্মস্থ করতে পারি নি। নিজের মত করে একটা ধারণা করে নেই। একটি চিত্রকলার চিত্রকলা হয়ে ওঠার গল্প অনুধাবন করার ক্ষমতা আমার অধরাই রয়ে যায়। মোদ্দা কথা, আধুনিক চিত্রকলার ভাষা উদ্ধার করতে সত্যি সত্যিই হিমসিম খেয়ে যাই। এটা শুধু আমার নয়, আমার মত অনেকেরই এমন অভিজ্ঞতা হয়। চিত্রকলার প্রতি ভালোবাসা আছে, কিন্তু সেটা মর্মোদ্ধার করতে না পারার ব্যর্থতাও আছে।
যদিও দেশে এখন শিল্পচর্চা অনেক বেড়েছে। বেড়েছে শিল্পী, শিল্পানুরাগী ও গ্যালারী। বেড়েছে শিল্পীদের কদরও। চিত্রকর্ম বেচাকেনা বোধকরি আগের চেয়ে অনেক ভালো। তারপরও কি বলা যাবে, শিল্পবোদ্ধা ও শিল্পানুরাগীর সংখ্যা পর্যাপ্ত?
এখন প্রশ্ন ওঠতে পারে, আমাকে কে বলেছে চিত্রকলা বুঝতে? সেটা বলাটা অবশ্য অপ্রাসঙ্গিক নয়। তারপরেও কিছু কথা রয়ে যায়। এই জগতের রূপ-রস-গন্ধকে বুঝতে চাইলে সৌন্দর্যের অন্যতম রূপকলা চিত্রকলাকে কি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে? আমরা যারা চিত্রকলা বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লেখাপড়া করিনি এবং এখন তো আর সেটা সেভাবে করা সম্ভব নয়, তারা যদি চিত্রকলা বুঝতে চাই, তাদের জন্য কি কোনো ব্যবস্থা করা যায় না? ব্যবস্থা বলতে আমি কর্মশালা বা হাতে-কলমে শিক্ষার কথা বলছি না। বিদ্যমান পদ্ধতিতে কি এটা করা সম্ভব নয়?
চিত্রকলা আঁকা হয় নানা মাধ্যমে। তেল, প্যাস্টেল, অ্যাক্রিলিক, ওয়াটার কালার, কালি, মোম, ফ্রেসকো, এনামেল, স্প্রে পেইন্ট, টেম্পেরা আরও কত কি। নামগুলো পড়ি, কিন্তু কোনটার কী কাজ, সেটা বুঝতে পারি না। কাগজ, ক্যানভাস, কাঠ, গ্লাস, রাসায়নিক ধাতু সহ নানা উপকরণ ব্যবহার করা হয়। এটা তো যাহোক তেমন একটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। চিত্রকলার ধরন-ধারণ তো একদম অন্যরকম। মর্ডানিজম, ইমপ্রেশনিজম, অ্যাবস্ট্্রাক স্ট্যাইল, এক্সপ্রেসনিজম, কিউবিজম, পপ আর্ট সহ কত রকম স্ট্যাইল। মূর্ত চিত্রকলা বুঝতে খুব একটা বেগও পেতে হয় না। এই ধারার শিল্পীদের অন্যতম জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, এস এস সুলতান, কাইয়ুম চৌধুরীর মত শিল্পীদের চিত্রকলা হৃদয়-মনকে অনায়াসে রাঙিয়ে দেয়। দেশ-বিদেশের যে কোনো মূর্ত চিত্রকলাই বুঝতে খুব একটা ঘাম ঝরাতে হয় না। কিন্তু বিমূর্ত চিত্রকলা রয়ে যায় বোধের অগম্য। আর এখন তো চিত্রকলার ভাষা আরো বদলে গেছে। সময়ের সঙ্গে সমান্তরালভাবে চলতে হলে বদলে যাওয়াটাই রীতি। এত এত কিছু তো একজন সাধারণ শিল্পানুরাগীর পক্ষে আত্মস্থ করা সম্ভব নয়। সে হয়ত মনের টানে চিত্রকলার প্রতি আকৃষ্ট হন। সময়-সুযোগ পেলে চিত্রকলা প্রদর্শনীতে যান কিংবা সমালোচনা পড়েন বা শোনেন। যে সময়টাতে তিনি এতে মনোযোগী হন, সে সময়টুকুতেই তিনি এটা বুঝতে চাইবেন। আর এটা নিয়েই এত কথা বলা।
চিত্রকলাকে সাধারণ্যে পরিচিত করার ক্ষেত্রে পত্রিকা ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। পত্রিকা ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় চিত্রকলা বিষয়ক যে লেখাগুলো প্রকাশিত ও যে শিল্পকর্ম নিয়ে আলোচনা হয়, তাতে যে শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে আলোচনা করা হয় ও দেখানো হয়, লেখার সঙ্গে সামজ্ঞস্য রেখে যদি সেই চিত্রকর্মগুলো ছাপানো ও আলোচনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তা দেখানো হয়, সব তো আর সম্ভব নয়, অন্তত উল্লেখযোগ্য কাজগুলো যদি দেওয়া হয়, তাহলে শিল্পকর্মগুলো বুঝতে কিছুটা সুবিধা হতে পারে। যে সব পত্রিকা চিত্রকলা বিষয়ে লেখা প্রকাশ করে থাকে কিংবা যে সব ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় চিত্রকলা নিয়ে আলোচনা করা হয়, তারা যদি এটা অনুসরণ করে, তাহলে চিত্রকলা অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য হয়ে থাকবে না। বিশ্ববিখ্যাত শিল্পকর্ম নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা করা হয়। সঙ্গে থাকে চিত্রকলার রিপ্রোডাকশন। যে কারণে আমরা কিছুটা হলেও লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসার রহস্যময় হাসির মাজেজা কিংবা এ জাতীয় জগতবিখ্যাত চিত্রকলার গুরুত্ব কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। তেমনিভাবে বাংলাদেশের শিল্পীদের সেরা সেরা চিত্রকর্মগুলো নিয়ে যদি স্বতন্ত্রভাবে আলোকপাত করা হয়, তাহলেও বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমনটি করা হয়ে থাকে জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, এস এস সুলতানের ক্ষেত্রে। এ তো গেল মিডিয়ার কথা।
 

বিভিন্ন গ্যালারীতে আয়োজন করা হয় চিত্রকলা প্রদর্শনী। প্রদর্শনীশালায় ছবিগুলো সুন্দরভাবে টানিয়ে রাখা হয়। দর্শক নিজের অনুভব ও অনুভূতি দিয়ে ছবিগুলো বোঝার চেষ্টা করেন। গ্যালারীতে যদি বোদ্ধা কেউ একজন থাকেন, তিনি আগ্রহী দর্শককে দর্শনীর বিনিময়ে ছবিগুলো বুঝিয়ে দিতে পারেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদিও বিষয়টি সহজ নয়, তারপরও আরো কীভাবে সহজ বা সুলভ পদ্ধতিতে এটা করা যেতে পারে, সেটা ভেবে দেখা যায়। তাছাড়া ব্যক্তিগত যে প্রদর্শনীগুলো হয়, তাতে খুব একটা ক্যাটালগ বের করতে দেখা যায় না। যদিও বের করা হয়, তাতে সবগুলো চিত্রকর্ম থাকে না। সেক্ষেত্রে ক্যাটালগে প্রতিটি ছবির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া থাকলে চিত্রকলার সমঝদার বাড়তে পারে। ক্যাটালগগুলো স্পনসরের মাধমে কিংবা সুলভ মূল্যে বিক্রি করা যেতে পারে। একজন শিল্পীর চিত্রপ্রদর্শনী তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সে কারণে প্রদর্শনীটি গুরুত্বসহকারেই হওয়া উচিত। এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে যাতে অনেক দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগটা ভালোভাবে হয়ে যায়।
চিত্রকলাকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে এমনটি ভেবে দেখা যেতে পারে। যদিও হুট করে সেটা সম্ভব নয়, অন্তত উদ্যোগ তো শুরু করা যেতে পারে।