এখন তার কথা কারো খুব একটা মনে পড়ে না। স্মৃতিতে ধুলো জমতে জমতে অনেকটাই বিস্মৃত। অথচ একসময়ের প্রাণচঞ্চল সংবাদ কক্ষের মধ্যমণি ছিলেন তিনি। সারা দুনিয়া থাকতো তার হাতের মুঠোয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কত বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চোখের পলকে। তার পরিকল্পনায় প্রতিদিন পাঠকরা পেতেন ঝলমলে সব সংবাদপত্র। আর এখন সংবাদপত্রেই উপেক্ষিত, নিবেদিতপ্রাণ এই সংবাদব্যক্তিত্ব। সাংবাদিকতা নামক অধরা সোনার হরিণের পেছনে ছুটে জীবনকে নিংড়ে দিয়ে অনেক অপ্রাপ্তির বেদনা নিয়ে চলে গেছেন ইহলোক থেকে। তিনি সব্যসাচী সাংবাদিক মীর নূরুল ইসলাম। ছোট ও বড় - সবার কাছে তিনি ‘মীর ভাই’ নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন সৎ ও নির্লোভ সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ। সাংবাদিকতাকে পাথেয় হিসেবে নিয়ে উৎসর্গ করেন জীবন। কোনো প্রাপ্তির আশায় সাংবাদিকতাকে করেননি প্রলোভনের সিঁড়ি। এ কারণে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও সংবাদপত্র ছাড়া অন্য কোনো মোহ তাকে কখনোই আকৃষ্ট করতে পারেনি। নতুন কোনো সংবাদপত্র প্রকাশনার চিন্তা-ভাবনা হলেই সবাই তাকে মনে করতেন নির্ভরযোগ্য। তার সততা, তার সুখ্যাতি, তার দায়িত্বশীলতার কারণে তাকে নেওয়ার জন্য চলতো তোড়জোড়।
মীর নূরুল ইসলামের জন্ম বাংলা ১৩৪১ সালের ১১ অগ্রহায়ণ টাঙ্গাইলের কালিহতি থানার ইছাপুর গ্রামে। ছোট বেলায় থেকেই ছিল সাহিত্যের ঝোঁক। স্কুল বয়সে কলকাতার সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার ছড়া। ১৯৪৮ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শেষ ব্যাচ ছিল সেটি। আর্থিক সংকটের কারণে আইএসসি পরীক্ষা দিতে না পারায় জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমান ঢাকায়। ১৯৫২ সালে রেডিও পাকিস্তানে ‘এলান’য়ের সহ-সম্পাদক হিসেবে চাকরি নেন। ১৯৫৬ সালে তার সংবাদপত্রে হাতেখড়ি হয় দৈনিক সংবাদ-য়ে। তবে ৪/৫ দিন কাজ করার পর কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেহাদ-য়ে যোগ দেন সহ-সম্পাদক হিসেবে। মাসিক বেতন ১০০ টাকা। কিছু দিন পর একই পত্রিকার শিশুদের পাতা ‘সবুজ মেলা’ার দায়িত্ব পান। যোগ হয় বাড়তি ৭৫ টাকা। ইত্তেহাদ বন্ধ হলে তার ঠিকানা হয় আবুল কালাম শামসুদ্দীন সম্পাদিত দৈনিক জেহাদ-য়ে। জেহাদ বন্ধ হলে ১৯৬৪ সালে যোগ দেন দৈনিক পাকিস্তান-এ। এই প্রথম বেতন স্কেল সহ নিয়োগপত্র পান। ১৯৬৯ সালে দৈনিক সংগ্রাম বের হলে তাকে বার্তা সম্পাদক করা হয়। বছরখানেক কাজ করার পর বনিবনা না হওয়ায় শিফট-ইন-চার্জ হিসেবে চলে আসেন দৈনিক পূর্বদেশ-য়ে। ১৯৭২ সালে হন বার্তা সম্পাদক। ১৯৭৫ সালে সরকারি নির্দেশনায় পূর্বদেশ বন্ধ হয়ে গেলে রাজস্ব বোর্ডের অধীনে অ্যাসিস্ট্যান্ড কালেক্টর পদে নিয়োগপত্র পান। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার হাতছানি থাকলেও লোভনীয় এই চাকরিতে না গিয়ে তিনি রাজশাহী থেকে প্রকাশিত দৈনিক বার্তার বার্তা সম্পাদক পদটাকে মনে করেন শ্রেয়তর। একই পদে ১৯৮২ সালে যোগ দেন দৈনিক বাংলার বাণীতে। ১৯৮৪ সালে দৈনিক জনতা প্রকাশিত হলে তিনি হন সম্পাদক। কিছু দিন পর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বকোণের নির্বাহী সম্পাদক এবং ১৯৮৬ সালে একই পদে পুনরায় দৈনিক বাংলার বাণীতে যোগ দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করেন দৈনিক মুক্তকণ্ঠের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে। কর্মরত অবস্থায় ২০০১ সালের ৩ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন সাংবাদিকতায় উৎসর্গীকৃতপ্রাণ এই ব্যক্তিত্ব।
লেখক হিসেবেও তিনি ছিলেন সমাদৃত। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার ছিল সবর উপস্থিতি। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘মনের মানুষ’ ও নাটক ‘আড্ডা’। তার লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল হাস্যরস। তবে হাস্যরসের মধ্যে জীবনের বাস্তবতা তুলে ধরতেন তীর্যক ভাষায়। নিজের জীবন নিয়েও তিন অনায়াসে উপহাস করতে পারতেন। বাংলাদেশে রম্যরচনা লেখার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা। পত্র-পত্রিকা, বেতার, টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে তার অসংখ্য লেখা।
সাংবাদিকতাকে যারা একটি আদর্শ হিসেবে নিয়েছিলেন, তিনি তাদের অন্যতম। কঠিন দারিদ্র্যের মধ্যে দিনাতিপাত করেছেন, তবুও কখনো আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। কখনো চাকরিচ্যুত হয়ে, কখনো বেতন বঞ্চিত হয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হয়েছেন। বিশাল পরিবারের বোঝা টেনে নিতে হিমসিম খেয়েছেন, তবুও মাথা নত করেননি। সাংবাদিকতা আর লেখালেখির মাধ্যমেই কষ্টকর জীবন যাপন করেছেন। এ কারণে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আর্থিক স্বচ্ছলতার মুখ দেখেননি। তবুও লক্ষ্য থেকে সরে দাঁড়াননি। একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে বিভিন্ন মত ও পথের পত্রিকায় কাজ করেছেন, কিন্তু বুকের মধ্যে সমুন্নত রেখেছেন আদর্শের পতাকা। তার মত অনেকের আত্মনিবেদনে আজ সাংবাদিকতা একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির উপর এগিয়ে চলেছে। নিপাট ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন তেমনটি। দায়িত্বশীল পদে কাজ করেও তাকে কখনও উত্তেজিত হতে দেখা যায়নি। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে, দ্রুত কাজ করতে, দ্রুত লিখতে তিনি ছিলেন পারঙ্গম। রসিকতায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়। যে কোনো জটিল পরিস্থিতিকে হাসি-মশকরা দিয়ে তিনি সহজ করে দিতেন। সহকর্মীদের কাজের উৎসাহ দেওয়ার ক্ষেত্রেও তার জুড়ি ছিল না। তার হাত ধরে সাংবাদিকতার জগতে কত জনের হাতখড়ি হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। নবীন সাংবাদিকদের কাছে তিনি ছিলেন ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড।
এ দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতায় যে আলোর ঝরনাধারা, তা এসেছে অনেকের ত্যাগ-তিতিক্ষা আর সংগ্রামের মাধ্যমে। আলোকবর্তিকা হয়ে যারা পথ দেখিয়েছেন, তাদের অন্যতম হলেন মীর নূরুল ইসলাম। তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি ও ভালোবাসা।
মীর নূরুল ইসলামের জন্ম বাংলা ১৩৪১ সালের ১১ অগ্রহায়ণ টাঙ্গাইলের কালিহতি থানার ইছাপুর গ্রামে। ছোট বেলায় থেকেই ছিল সাহিত্যের ঝোঁক। স্কুল বয়সে কলকাতার সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার ছড়া। ১৯৪৮ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শেষ ব্যাচ ছিল সেটি। আর্থিক সংকটের কারণে আইএসসি পরীক্ষা দিতে না পারায় জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমান ঢাকায়। ১৯৫২ সালে রেডিও পাকিস্তানে ‘এলান’য়ের সহ-সম্পাদক হিসেবে চাকরি নেন। ১৯৫৬ সালে তার সংবাদপত্রে হাতেখড়ি হয় দৈনিক সংবাদ-য়ে। তবে ৪/৫ দিন কাজ করার পর কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেহাদ-য়ে যোগ দেন সহ-সম্পাদক হিসেবে। মাসিক বেতন ১০০ টাকা। কিছু দিন পর একই পত্রিকার শিশুদের পাতা ‘সবুজ মেলা’ার দায়িত্ব পান। যোগ হয় বাড়তি ৭৫ টাকা। ইত্তেহাদ বন্ধ হলে তার ঠিকানা হয় আবুল কালাম শামসুদ্দীন সম্পাদিত দৈনিক জেহাদ-য়ে। জেহাদ বন্ধ হলে ১৯৬৪ সালে যোগ দেন দৈনিক পাকিস্তান-এ। এই প্রথম বেতন স্কেল সহ নিয়োগপত্র পান। ১৯৬৯ সালে দৈনিক সংগ্রাম বের হলে তাকে বার্তা সম্পাদক করা হয়। বছরখানেক কাজ করার পর বনিবনা না হওয়ায় শিফট-ইন-চার্জ হিসেবে চলে আসেন দৈনিক পূর্বদেশ-য়ে। ১৯৭২ সালে হন বার্তা সম্পাদক। ১৯৭৫ সালে সরকারি নির্দেশনায় পূর্বদেশ বন্ধ হয়ে গেলে রাজস্ব বোর্ডের অধীনে অ্যাসিস্ট্যান্ড কালেক্টর পদে নিয়োগপত্র পান। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার হাতছানি থাকলেও লোভনীয় এই চাকরিতে না গিয়ে তিনি রাজশাহী থেকে প্রকাশিত দৈনিক বার্তার বার্তা সম্পাদক পদটাকে মনে করেন শ্রেয়তর। একই পদে ১৯৮২ সালে যোগ দেন দৈনিক বাংলার বাণীতে। ১৯৮৪ সালে দৈনিক জনতা প্রকাশিত হলে তিনি হন সম্পাদক। কিছু দিন পর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বকোণের নির্বাহী সম্পাদক এবং ১৯৮৬ সালে একই পদে পুনরায় দৈনিক বাংলার বাণীতে যোগ দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করেন দৈনিক মুক্তকণ্ঠের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে। কর্মরত অবস্থায় ২০০১ সালের ৩ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন সাংবাদিকতায় উৎসর্গীকৃতপ্রাণ এই ব্যক্তিত্ব।
লেখক হিসেবেও তিনি ছিলেন সমাদৃত। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার ছিল সবর উপস্থিতি। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘মনের মানুষ’ ও নাটক ‘আড্ডা’। তার লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল হাস্যরস। তবে হাস্যরসের মধ্যে জীবনের বাস্তবতা তুলে ধরতেন তীর্যক ভাষায়। নিজের জীবন নিয়েও তিন অনায়াসে উপহাস করতে পারতেন। বাংলাদেশে রম্যরচনা লেখার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা। পত্র-পত্রিকা, বেতার, টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে তার অসংখ্য লেখা।
সাংবাদিকতাকে যারা একটি আদর্শ হিসেবে নিয়েছিলেন, তিনি তাদের অন্যতম। কঠিন দারিদ্র্যের মধ্যে দিনাতিপাত করেছেন, তবুও কখনো আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। কখনো চাকরিচ্যুত হয়ে, কখনো বেতন বঞ্চিত হয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হয়েছেন। বিশাল পরিবারের বোঝা টেনে নিতে হিমসিম খেয়েছেন, তবুও মাথা নত করেননি। সাংবাদিকতা আর লেখালেখির মাধ্যমেই কষ্টকর জীবন যাপন করেছেন। এ কারণে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আর্থিক স্বচ্ছলতার মুখ দেখেননি। তবুও লক্ষ্য থেকে সরে দাঁড়াননি। একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে বিভিন্ন মত ও পথের পত্রিকায় কাজ করেছেন, কিন্তু বুকের মধ্যে সমুন্নত রেখেছেন আদর্শের পতাকা। তার মত অনেকের আত্মনিবেদনে আজ সাংবাদিকতা একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির উপর এগিয়ে চলেছে। নিপাট ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন তেমনটি। দায়িত্বশীল পদে কাজ করেও তাকে কখনও উত্তেজিত হতে দেখা যায়নি। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে, দ্রুত কাজ করতে, দ্রুত লিখতে তিনি ছিলেন পারঙ্গম। রসিকতায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়। যে কোনো জটিল পরিস্থিতিকে হাসি-মশকরা দিয়ে তিনি সহজ করে দিতেন। সহকর্মীদের কাজের উৎসাহ দেওয়ার ক্ষেত্রেও তার জুড়ি ছিল না। তার হাত ধরে সাংবাদিকতার জগতে কত জনের হাতখড়ি হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। নবীন সাংবাদিকদের কাছে তিনি ছিলেন ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড।
এ দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতায় যে আলোর ঝরনাধারা, তা এসেছে অনেকের ত্যাগ-তিতিক্ষা আর সংগ্রামের মাধ্যমে। আলোকবর্তিকা হয়ে যারা পথ দেখিয়েছেন, তাদের অন্যতম হলেন মীর নূরুল ইসলাম। তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি ও ভালোবাসা।
(দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত।)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন