পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

সোমবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১২

সুরের ধারা ঝরে যেথায়............


বাংলাদেশে রবীন্দ্র চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন নন্দিত দু’জন নারী। উভয়ই প্রথিতযশা রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উদ্যোক্তা। একজন সন্জীদা খাতুন। আরেকজন তারই অনুসারী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। উভয়ই তাদের কণ্ঠমাধুর্য দিয়ে শ্রোতাদের হৃদয়ে আলাদা একটা স্থান করে নিয়েছেন। সংগত কারণেই রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী হিসেবে তাদের নাম আলাদা মর্যাদায় উচ্চারিত হয়। প্রবীণা সন্জীদা খাতুন এখন আর আগের মতো গাইতে পারেন না। তবে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা স্ব মহিমায় সমুজ্জ্বল। বাংলাদেশে তো বটেই, ভারতেও তাকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্র সংগীতের বড় কোনো আসরের কথা ভাবাই যায় না। বিশেষ করে, পশ্চিমবঙ্গের সংগীত চ্যানেল ‘তারা মিউজিক’য়ে প্রতিদিনই শোনা যায় তার সুরেলা আওয়াজ।
রবীন্দ্র সংগীতের শিল্পী হিসেবেই শুধু নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেননি সন্জীদা খাতুন আর রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। রবীন্দ্র সংগীতকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে এ দু’জনের অবদান বিস্ময়কর। বাংলা নববর্ষকে বাঙালির বুকে চিরস্থায়ীভাবে আসন করে দিচ্ছেন এই দুই সংগীত কিংবদন্তি। সন্জীদা খাতুন আর ছায়ানট তো একই মালায় গাঁথা। ষাটের দশকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে ছায়ানটের সাহসী ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় হয়ে আছে অমিলন। তারই অংশ হিসেবে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে অবিচ্ছেদ্য অংশ ছায়ানট। আজও ছায়ানটের পয়েলা বৈশাখ বরণ করে নেয়াটা নাগরিক জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ। ছায়ানটের গৌরবোজ্জ্বল অবদানের ক্ষেত্রে অন্যতম কা-ারি হলেন সন্জীদা খাতুন। এখনও বাংলাদেশের রবীন্দ্র চর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছায়ানট। রবীন্দ্র চেতনাকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বয়সের ভারকে তুচ্ছ করে সন্জীদা খাতুন ছায়ানটের সভাপতি হিসেবে অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ। তার সময় ছায়ানটের ব্যাপ্তি ও কার্যক্রম অনেক বেড়েছে। নেয়া হচ্ছে নতুন নতুন পদক্ষেপ।
ছায়ানটের ছায়াতলে লালিত রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাও রবীন্দ্র চর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। শান্তিনিকেতনের মেধাবী এই ছাত্রী ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সুরের ধারা’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুৃর আর রবীন্দ্র সংগীতকে ভালোবেসে এবং তার মোহরদি‘র (রবীন্দ্র সংগীতের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়) পরামর্শে, অনুপ্রেরণা ও নির্দেশনায় অনেকটা একক উদ্যোগে তিনি গড়ে তোলেন এই প্রতিষ্ঠানটি। খুব নীরবে কাজ করে গেলেও আজ ‘সুরের ধারা’ একটি প্রতিষ্ঠিত নাম। লালমাটিয়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ‘সুরের ধারা’র মাধ্যমে প্রতি বছর অসংখ্য ছেলেমেয়ে রবীন্দ্র সংগীতে দীক্ষা নিয়ে চলেছেন। পাশাপাশি শেখানো হয় উচ্চাঙ্গসংগীত সহ মূলধারার অন্যান্য গান। এছাড়া গত প্রায় এক যুগ ধরে বাংলা বছরের শেষ দিনটিতে ‘সুরের ধারা’ নিয়মিতভাবে আয়োজন করে আসছে বর্ষশেষের সংগীতানুষ্ঠান। সেটিও হয়ে ওঠেছে নাগরিক জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ। তবে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ‘সুরের ধারা’র অনুষ্ঠানমালা ছিল এককথায় অসাধারণ ও বিস্ময়কর। ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে তিন দিনব্যাপি রবীন্দ্র উৎসব বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ছিল সেরা আয়োজন। দুই বাংলার খ্যাতিমান শিল্পী, লেখক, সংগঠকদের নিয়ে সংগীত, আবৃত্তি, নাটক, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, চলচ্চিত্র, প্রদর্শনী এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সহস্র কণ্ঠে রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশনা সবাইকে মুগ্ধ করে দেয়। এই উৎসবে পাশ্চাত্যের যন্ত্রানুষঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গান পরিবেশন করেন ১৭টি দেশের ৩৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত ‘গান্ধর্বলোক অর্কেস্ট্রা‘। রবীন্দ্রনাথের গীতবিতানের ২২২২টি গান ডিভিডিতে ধারণ করা হয়। ২২টি ডিভিডিতে ধারণকৃত এই পুরো আয়োজনের নামকরণ করা হয় ‘শ্রুতি গীতবিতান’। ছোট্ট পরিসরের ‘সুরের ধারা’ এক লহমায় যেন ছাড়িয়ে যায় নিজেকে। রবীন্দ্র উৎসবের মাধ্যমে তাদের খ্যাতি যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সাংগঠনিক শক্তি। এখন ‘সুরের ধারা’ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে কোনো বড় অনুষ্ঠান আয়োজন করার সামর্থ রাখে। তাই তাকে ঘিরে উড়ে প্রত্যাশার রঙধনু।


এ কারণে এবার প্রথম ‘সুরের ধারা’ বর্ষশেষের পাশাপাশি বর্ষবরণ করার জন্য বিশাল কলবরে আয়োজন করে দুই দিনব্যাপি অনুষ্ঠানমালার। আগে এটি হত একদিনেই। চৈত্রের শেষ দিনে বর্ষবিদায়ের পরের দিন ভোরে সহস্রকণ্ঠে বরণ করে নেয়া হয় বাংলা নববর্ষকে। লালমাটিয়ার নির্জনতা ছেড়ে এবার এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের উন্মুক্ত চত্বরে। এই আয়োজন এবার বিবেচিত হচ্ছে নতুন সংয়োজন হিসেবে। বিপুলসংখ্যক দর্শক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন মুগ্ধতা নিয়ে। ‘সুরের ধারা’র যাবতীয় কার্যক্রম আবর্তিত হয় রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে কেন্দ্র করে। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীরা তারই নেতৃত্বে যে কোনো অসাধ্য কাজ সম্পন্ন করার ব্যাপারে অনেক বেশি আন্তরিক ও একতাবদ্ধ। ‘সুরের ধারা’র তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী শামীমা আক্তার শাওন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের সত্তায় মিশে আছেন। সেই শৈশবে তিনি স্থান করে নেন হৃদয়ে। তবে অল্প বয়সে আমার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ইচ্ছে থাকাসত্ত্বেও রবীন্দ্র সংগীত শেখা হয়নি। কিন্তু এখন এই সুযোগ এনে দিয়েছে আমার প্রিয় প্রতিষ্ঠান ‘সুরের ধারা’। এখানে শুধু রবীন্দ্র সংগীতই বুকে ধারণ করছি না, সেইসঙ্গে সাংগঠনিক বিষয় সহ অনেক কিছু শিখতে পারছি। ‘সুরের ধারা’র পরিবেশটা একটি পরিবারের মতো। তাই যে কোনো আয়োজন নিজেদের মনে করে সেটা সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার জন্য কারোই মোটেও কার্পণ্য থাকে না।‘ এটাই ‘সুরের ধারা’র এগিয়ে চলার অন্যতম মন্ত্র ও চালিকাশক্তি। ‘সুরের ধারা’র এই মন্ত্র ও শক্তি ‘হৃদয় মোর গানের তারা উঠবে ফুটে সারে সারে’।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন