তুমি এখন কোথায়? মাঠে?
আরে না। অফিসেই তো আছি।
এখনো অফিসে! খেলা দেখতে যাওনি?
যেতে ইচ্ছে করছে না গো। বরং খেলতে ইচ্ছে করছে।
মানে কি? আজ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেকার হাইভোল্টেজ ক্রিকেট ম্যাচ। সবার দৃষ্টি এখন সেদিকে। আমিও তো টিভিতে খেলা দেখছি। আর এমন উত্তেজনাকর ম্যাচ তুমি দেখতে যাওনি? এমনটা তো ভাবতেই পারছি না। তুমি তো কখনো এমন খেলা মিস করো না। ঘটনাটা কী?
মনটা কেন যেন উদাস হয়ে আছে। খেলা নিয়ে উৎসাহ পাচ্ছি না। কোথায় যেন ছন্দ কেটে গেছে। সত্যি বলতে কি এই ম্যাচের পরিবর্তে আমার উত্তেজনা ধাবিত হয়েছে তোমার দিকে। তোমার সঙ্গেই ম্যাচ খেলতে ইচ্ছে করছে।
কী আবোল-তাবোল বকছো? আমার সঙ্গে ম্যাচ খেলতে ইচ্ছে করছে! আমি কি ক্রিকেটার নাকি তুমি ক্রিকেটার? মানে কী?
খেলার তো নানান প্যাটার্ন আছে। তোমার-আমার জন্য যেটা যুৎসই, সেটাই তো খেলবো। বুঝতে চেষ্টা করো, তোমার সান্নিধ্যের চেয়ে আমার কাছে রোমাঞ্চকর আর কিছু নেই। তোমাকে নিয়ে মনের মধ্যে যে কি তীব্র উঁচাটন চলছে, বোঝাতে পারবো না। তুমি তো জানো, আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে আবেগী মন। তার অবাধ্য হতে পারি না। আজ মিরপুরে গেলে মোটেও স্বস্তি পাবো না। খেলা দেখেও আনন্দ পাবো না। মন খারাপ হয়ে যাবে। তাহলে গিয়ে কী হবে? তোমাতে মজেছে প্রাণ, বুকের ভিতর করছে টনটন।
এ তো মারফতি কথা। তোমার যত সব বাহানা। আজ কি মাথায় পাগলামি ভর করেছে? আমি জানতাম তুমি এখন মাঠে থাকবা। জাস্ট তোমাকে হাই-হ্যালো বলার জন্য ফোন করেছি। আমার সান্নিধ্য তুমি পাবে কীভাবে? ফোনেও তো বেশিক্ষণ কথা বলতে পারবো না। তাছাড়া আমার বুঝি বাসায় কাজ নেই?
এই ভর দুপুর বেলা তোমার কী কাজ তা কি আমি জানি না? তোমার প্রতিদিনের রুটিন আমার চেয়ে বেশি কে জানে টুনটুনি পাখি? বাসায় তো নিশ্চয়ই এখন একাই আছো। তুমি ফোন না করলেও আমি এখনই তোমাকে মেসেজ পাঠাতাম।
তাহলে তুমি স্টেডিয়ামে যাচ্ছ না? খেলা কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। টস জিতে পাকিস্তান ব্যাট করছে।
খেলা যখন কেউ না কেউ ব্যাট তো করবেই। চলো আমরাও টস করি।
তোমার কথার কোনো আগামাথা বুঝতে পারছি না। আজ তোমার কী হয়েছে, কে জানে। আমাদের আবার কীসের টস?
আগে শোনো, তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে৷ আমরা এখন একটা খেলা খেলবো। এই খেলার নিয়ম হচ্ছে, টসে যদি আমি জিতি, তুমি আমার অফিসে চলে আসবে। আর যদি হেরে যাই, তোমার কাছে আমি যাবো।
না, না। কী সব উল্টাপাল্টা কথা। এটা কী কোনো খেলা? তোমার মাথায় যত্ত সব আজগুবি চিন্তা-ভাবনা ঘুরপাক খায়। টস-ফসের মধ্যে আমি নেই। এ ধরনের ঝুঁকি নিতে পারবো না। আমি কোথাও যেতে পারবো না। তোমাকেও আসতে হবে না। তোমার মনগড়া ইচ্ছে চাপিয়ে দিলেই হলো!
আহ্ সোনাবাবু, এমন করো না। এই দিন তো সব সময় আসবে না। আমার অফিসে আমি ছাড়া কেউ নেই। রাস্তাঘাটও একদম ফাঁকা। তোমার আসতে একদমই সময় লাগবে না। সহজেই চলে আসতে পারবে।
সহজেই চলে আসতে পারবে মানে? আমি কি আসতে চেয়েছি নাকি টসে হেরে গেছি?
তা অবশ্য হারোনি। তবে টসের কথা বাদ দাও, সিদ্ধান্তটা আমাকে নিতে দাও। অন্য সব দিন তো তোমার কথাই মেনে চলি। আজ অন্তত আমার কথা শোনো। তুমি চলে আসো। কোথাও যানজট নেই। তাড়াতাড়ি আসতে পারবে।
তুমি বললেই হলো। নিজেই নিজের খেলার নিয়ম ভাঙছো। এটা আবার কেমন খেলা? শোনো, ফালতু কথা রাখো। খেলা দেখতে দেও। পাকিস্তানের উদ্বোধনী দুই ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ হাফিজ আর নাসির জামসেদ কিন্তু দারুণ খেলছে। দ্রুতলয়ে এগিয়ে চলেছে রানের গতি।
লক্ষীসোনা, তুমি আসো, আমরাও ভালো খেলতে চেষ্টা করবো।
এই ফাজিল, তুমি কী বলতে চাইছো? মাথা কি আউলা-ঝাউলা হয়ে গেছে?
কাছে আসলেই তো সব জানতে পারবে।
তুমি তো একটা বদ। কী মতলব আঁটছো, কে জানে। বলছি না, আমি আসতে পারবো না।
সোনামণি, বাইরে তাকিয়ে দেখো, চৈত্রের এই পড়ন্ত দুপুরে একদমই রোদ নেই। ছায়ায় ঢেকে আছে চারপাশ। কী মায়াময় পরিবেশ। প্রকৃতি তোমাকে বরণ করে নিতে চাইছে। তোমার আসতে একটুও কষ্ট হবে না। মনটা তোমার সান্নিধ্য খুব খুব করে চাইছে। বউ, আমাকে বিমুখ করো না।
বউ বউ করো না। বাসায় এখন কেউ নেই। এখন বের হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
ফারিয়া তো একটু পর স্কুল থেকে এসে পড়বে। তারপর না হয় রওয়ানা দাও।
মেয়েকে একা বাসায় রেখে আসতে পারবো না। এতদিন তো এসেছো। আজ আবার কী হলো?
বাচ্চা মেয়েকে কি একা রেখে আসা যায়? কীভাবে আসি তা তো তোমার অজানা নয়। প্রতিবারই কাউকে না কাউকে ডেকে এনে ম্যানেজ করতে হয়। আজ সবাই খেলায় মগ্ন। কাউকে ডাকা যাবে না। আর তোমার অফিস তো কাছেও না। এত দূরে যাওয়াও সম্ভব নয়।
বললাম তো, আজ বেশি সময় লাগবে না। একটা সিএনজি নিয়ে চট করে চলে আসো।
এইভাবে তোমার অফিসে যাওয়াটা মোটেও শোভনীয় নয়। ডেটিং করতে কি কেউ অফিসে যায়? কখন কে দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি।
আমি তো আগে কখনো তোমাকে অফিসে আসতে বলিনি। আজ বুঝে-শুনেই আসতে বলছি। তুমি এলে আমার অফিসটাও তোমার দেখা হয়ে যাবে। আর তোমাকে নিবিড়ভাবে দেখতে পারবো আমি।
এমন আদিখ্যেতা করছো কেন? আমাকে কখনো দেখোনি?
আরে অফিসে তো দেখিনি। এই দেখার আলাদা একটা মজা আছে। রোমাঞ্চ আছে। তোমাকে তো নানাভাবে দেখতে ইচ্ছে করে।
আর কাকে কাকে এই অফিস দেখিয়ে মজা নিয়েছো?
কী যে বলো না। আর কাকে দেখাবো? তুমিই হবে প্রথম।
তোমার সাহস কিন্তু দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে অফিসে দেখা করার ঝুঁকি কেউ নেয়?
তোমার জন্য আমি সবকিছু করতে পারি।
কচু পারো। শুধু কথার ফুলঝুরি।
লক্ষী বউ আমার, এমন কথা বলতে পারলে?
যা সত্য তাই তো বললাম। বাহ্, পাকিস্তানের দুই ওপেনারই সেঞ্চুরি করেছে। ওয়ান ডে ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানদের এমন কৃতিত্ব এই প্রথম। তাই না?
হতে পারে। চলো, আমরাও আজ এমন একটা নজির গড়বো, যা হবে আমাদের জীবনে প্রথম।
কীসের নজির?
দুই ব্যাটসম্যানই ভারতের বিপক্ষে তাঁদের প্রথম সেঞ্চুরি করেছে। অন্য দলের বিপক্ষে হাফিজ আগে তিনটি করলেও জামসেদের এটি অভিষেক সেঞ্চুরি। আমাদের তো এমন সুযোগ নেই। তবে কিছু একটা নিশ্চয়ই করতে পারবো। যা আমাদের জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
দুজনের সেঞ্চুরি অবিকল আমাদের সম্পর্কের মতো। তুমি আগে তিনটা প্রেম করেছো। আমার ক্ষেত্রে তুমিই প্রথম।
কীসের মধ্যে কি পান্তা ভাতে ঘি। কোথায় আমি তিনটা প্রেম করলাম?
দেখো, আমার কাছে লুকিয়ো না। তোমার অতীতের অনেক খবর আমি জানি। তুমি তো দুষ্টের শিরোমণি লঙ্কার রাজা/চুপি চুপি খাও তুমি চানাচুর ভাজা। তুমি যে ডুবে ডুবে জল খাওয়া লোক, সেটা কি আমি জানি না? সবকিছু যেনেও কেন যে তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি?
তুমি অকারণেই আমাকে লেগ পুলিং করছো। সংসারের বাইরে আমার একটাই প্রেম। একটাই ভালোবাসা। আর সেটা হলো তুমি। তুমিও যেমন, আমিও তেমন।
মোটেও না। এ বিষয়ে তুমি আমার চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে আছো। তোমার মায়াবী স্পিনের ঘূর্ণি দিয়ে এর আগের কত জনের হৃদয় বধ করেছো, তার পুরো হিসাব তো আর আমার জানা নেই।
তোমার এই কথা একদমই ঠিক না। তুমি তো জানো, আমি সহজে সবার সঙ্গে মিশতে পারি না। কেউ এগিয়ে না এলে কথাও বলতে পারি না। ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতে নামলে নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশ সময় লেগে যায়।
সেঞ্চুরি তো ঠিকই মারতে পারো। তাই না?
সেটাইবা পারলাম কোথায়? তবে এটা ঠিক, মানিয়ে নিতে পারলে রান তুলতে তেমন একটা সমস্যা হয় না। তোমার সঙ্গে যেমন স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাট করতে পারি। এমন ব্যাটিং উইকেটের সুবিধা আমাকে আর কে দেবে? আমার জীবনের পরম সৌভাগ্য যে তোমাকে পেয়েছি।
তুমি তো আস্ত একটা ছুপা রুস্তম। মিষ্টি মিষ্টি কথা তো ভালোই বলতে পারো। এমন কথা শুনলে মেয়েদের কি না পটে উপায় আছে? আমি তো মূলত তোমার কণ্ঠ শুনেই ফিদা হয়ে যাই।
দেখো, শচীন টেন্ডুলকার যেমন রান করতে ভালোবাসে, মুত্তিয়া মুরালিধরন যেমন উইকেট নিতে ভালোবাসে, আমিও তেমনি তোমাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। এমন ভালোবাসা আমার জীবনে কখনও আসেনি। এটা তোমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।
চারপাশে তো জন্টি রোডসের মতো ফিল্ডাররা সতর্কভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারা তো ক্যাচ বা রান আউট করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। ওয়ানডে ক্রিকেটে আউট হলে পুনরায় ব্যাট করার সুযোগ থাকে না। আমাদেরও ভাগ্যেও তেমনটাই হবে। আর এই খেলায় সামাজিক স্বীকৃতি নেই। আমরা কোনোভাবে কট হলে কী অবস্থা হবে, সেটা কি বুঝতে পারছো না? মহা কেলেঙ্কারির একশেষ হবে।
তা তো জানি। আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান। তাছাড়া নিন্দার কাঁটা যদি না বিধিল গায়ে/প্রেমের কি সাধ আছে বলো।
তুমি তো চলো হুজুগে। আগপিছ কিছু দেখো না। বিপদের কথাও ভাবো না। কোনো অঘটন ঘটলে তুমি না হয় সব ম্যানেজ করে নিতে পারবে। আলগোছে দুধের সরটুকু খেয়ে মুখ মুছে নিপাট ভদ্রলোক সাজবে। আমার পরিণতি কী হবে বুঝতে পারো?
তোমার কথা শুনে বুকের মধ্যে বাজছে, পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া?/যব পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া?/পেয়ার কিয়া তো চোরি নাহি কি, পেয়ার কিয়া/পেয়ার কিয়া তো চোরি নাহি কি/চুপ চুপ আয়ে বর্না কিয়া? এ তো চিরকালের কথা। তা নিয়ে আগাম ভেবে আর কী করবে? তবে যা কিছু ঘটুক না কেন আমি তোমার সঙ্গে আছি। থাকবো। আমার ওপর এই আস্থা নিশ্চয়ই তোমার আছে।
জানি না। বিপদে পড়লে কী হবে কে জানে? তখন সবার অবস্থা হয়, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। এই একটু লাইনে থাকো তো। বোধহয় ফারিয়া এসেছে। গেট খুলে দিয়ে আসি।
হ্যালো।
হু।
কী করো?
কিছুই করছি না। তোমার সঙ্গে করার অপেক্ষায় আছি।
অসভ্য একটা।
লক্ষীবাবু, আর দেরি করো না। জলদি জলদি চলে আসো।
তুমি এমনভাবে কথা বলো, যেন আমার কোনো বন্ধন নেই। ঝাড়া হাত-পা। চাইলেই যখন-তখন হুট করে তোমার কাছে ছুটে আসতে পারি। আমার তো একটা সংসার আছে। নাকি?
তা তো জানি। একটু ম্যানেজ করে আসো না বাবু।
তুমি মনে করো সব কিছু খুব সোজা। তুড়ি বাজালেই সব হয়ে যায়। আমাকে কত কিছু যে ভেবে চলতে হয়, তা তুমি বুঝতে চাও না।
বুঝবো না কেন? ফিল্ডারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকানো তো সহজ কাজ নয়। কিন্তু এত দিনে তো তুমি অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান হয়ে ওঠেছো। তোমার তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
তোমার যত অবান্তর কথা। তাই যদি হতো, তাহলে তো অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানরা প্রতি ম্যাচেই সেঞ্চুরি হাঁকাতে পারতো। তাই না?
তোমাকে কেন এত ভালো লাগে জানো?
হঠাৎ আবার ভালো লাগার কী হলো?
তোমার মধ্যে আছে একজন অধিনায়কের বিচক্ষণতা। মাঠে ও মাঠের বাইরে খুব চমৎকারভাবে ম্যানেজ করতে পারো। তুমি একজন দক্ষ অলরাউন্ডারও। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং-এ তোমার জুড়ি মেলা ভার।
থাক থাক। আমার আর গুণকীর্তন করতে হবে না। অনেক করেছো। তোমার লোপ্পা বলে আমি প্রলুব্ধ হচ্ছি না। দেখছো না, ভারতীয় স্পিনারদের ফাঁদে পা দিচ্ছেন না ইউনিস খান। ছক্কা না মেরেও খুব সাবলীলভাবে ব্যাট করে রানের গতি ঊর্ধ্বমুখী রেখেছে। আজ মনে হয় ভারতের খবর আছে। পাকিস্তান বড় ইনিংস গড়তে যাচ্ছে।
তুমি তো দেখি ইদানীং ক্রিকেটের দারুণ অনুরাগী হয়ে ওঠেছো। ভালো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও করতে পারো।
দেখতে হবে না কার সঙ্গে পেয়ার-মহব্বত করছি।
আমি কিন্তু ক্রিকেটের টেকনিক্যাল বিষয় তেমন বুঝি না। তবে কমনসেন্স বলছে, ভারত কিন্তু সহজে ম্যাচ ছেড়ে দেবে না। ঢাকার মাঠে দু’দলের পরিসংখ্যানে ভারত এগিয়ে আছে। এরআগে তারা পাঁচটিতে আর পাকিস্তান তিনটিতে জিতেছে। যদিও দু’দলের সর্বশেষ ম্যাচে জয়ী হয়েছে পাকিস্তান। কিন্তু গত বছর বিশ্বকাপ জয়ের পর ভারতীয় দলটির আত্মবিশ্বাস এখন উঁচুতে। অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে গৌতম গম্ভীর, শচীন টেন্ডুলকার, বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, সুরেশ রায়নার সমন্বয়ে দুর্ধর্ষ ব্যাটিং লাইনআপ। আর এই এশিয়া কাপে ফর্মের তুঙ্গে আছে কোহলি। সে একাই খেলা ঘুরিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে৷
তোমার মতো আর কি।
আমি আবার কী করলাম?
তুমিও তো দারুণ ফর্মে আছো। না হলে আমাকে অফিসে আমন্ত্রণ জানানোর দুঃসাহস পাও কী করে?
তুমিই তো আমার সাহস। তোমার সাহসে বলীয়ান হয়ে। অ্যা-ই জানু, পাকিস্তানের ইনিংস তো শেষ হতে চললো। তুমি রওয়ানা দিচ্ছ না কেন?
প্লিজ জানটু আজকে থাক। আরেক দিন না হয় আসবো।
সোনাবাবু, এমন করো না। আজকের দিনটাতে অন্তত আমাকে আশাহত করো না। না এলে খুব কষ্ট পাবো।
তুমি কেন যে এমন করো? কিছু বুঝতে চাও না। আচ্ছা দেখি, কাউকে ম্যানেজ করে বাসায় আনতে পারি কি-না। না পারলে আসতে পারবো না।
তুমি চাইলেই পারবে। তুমি তো গুগলি বলে ওস্তাদ। এই মোক্ষম অস্ত্র দিয়ে সহজেই ব্যাটসম্যানকে বোকা বানিয়ে দিতে পারো।
ঘোড়ার ডিম। ফোন রাখছি। একটু পর তোমাকে জানাচ্ছি।
আচ্ছা, সোনামণি।
হ্যালো। ফোন ধরতে এত সময় লাগে? কার সঙ্গে কী করো?
কার সঙ্গে কী করবো? আমার জীবনে তুমি ছাড়া আর কে আছে বলো? এই ফাঁকে ওয়াশরুমে গিয়ে একটু ওজন কমালাম।
এই শোনো, এখন কিন্তু ড্রেস বদলাতে পারবো না। যা পরে আছি, তাই পরেই আসছি।
লাগবে না। তোমাকে যে কোনো ড্রেসেই সুন্দর লাগে। আর ড্রেস না থাকলে আরো বেশি সুন্দর লাগে।
এই পাজি, ইতরামো করবে না। আরেকটা কথা, তুমি আমার সঙ্গে কোনো বদমাইশি করবে না। এই শর্ত মানলে আসবো নতুবা আসবো না। মানবে তো শর্ত?
তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে/ভালোবাসবে ওগো শুধু মোরে/তাই চম্পা বকুল করে গন্ধে আকুল.......
তোমার মনে এখন খুব স্ফূর্তি তাই না? দাঁড়াও, আমি এসে তোমার স্ফূর্তি বের করছি।
কীভাবে করবে? শুয়ে, বসে নাকি দাঁড়িয়ে?
তুমি না একদম নষ্ট হয়ে গেছো। সারাক্ষণই তোমার মুখে অসভ্য কথাবার্তা। কোনো লাগাম নেই। আমি কিন্তু সিএনজিতে। রাস্তায় তো গাড়ির সংখ্যা খুব কম। লোক চলাচলও বেশি নয়। খুব দ্রুতই চলে আসছি।
বলেছিলাম না। তুমি তো আমার কথা বিশ্বাস করতে চাও না। এমন একটা ক্রিকেট ম্যাচের আকর্ষণ কে আর মিস করবে বলো? এ কারণে লোকজন ঘর হতে বের হয়নি। টিভির সামনে নিমগ্ন হয়ে আছে। এজন্যই আজ তোমাকে আসতে বলা। আসো তুমি। আমি তোমাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য অফিসের গেটে দাঁড়িয়ে আছি।
থাকো। আশেপাশে পরিচিত কেউ আছে কি-না খেয়াল রেখো।
দেখছো, কত তাড়াতাড়ি চলে এসেছো।
ইশ্, এভাবে যদি প্রতিদিন চলাচল করা যেত!
টুনটুনি, তোমাকে কিন্তু অন্য রকম লাগছে।
কী রকম?
গোপন অভিসারে আসা লাস্যময়ী নায়িকার মতো। যেন আদর পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে আছো।
এইসব অভিসন্ধিমূলক কথা বলবে না। তোমার মন খারাপ করতে চাইনি বলে চলে এলাম। অফিসটা তো বেশ ভালোই। চারপাশে নিরিবিলি। লোকজন সব কোথায়?
সবাই খেলা দেখতে গেছে। তাছাড়া অফিস টাইম তো পেরিয়ে গেছে। কেন, এই নির্জনতা তোমার ভালো লাগছে না?
তা বলছি না। অফিসের পরিবেশ এমন হয়, আমার জানা ছিল না। খেলার কী অবস্থা?
তুমি যখন এসেছো, শুরু করতে দেরি হবে না।
অ্যাই বদমাশ, আমি ক্রিকেট ম্যাচের কথা বলছি।
তাই বলো। আমি তো ভেবেছি, তোমার বুঝি তর সইছে না। পাকিস্তান ছয় উইকেটে তুলেছে তিনশ’ ঊনত্রিশ রান।
পাকিস্তানের বিপক্ষে এত রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড ভারতের নেই। তাই না? ঢাকার মাঠেও কোনো দলের এত রান চেজ করার রেকর্ড নেই। খেলা কি জমবে নাকি একতরফা হবে? কী মনে হয় তোমার?
তুমি যে পরিসংখ্যানের কথা বললে তাতে করে ভারতের জন্য এটা বড় একটা চ্যালেঞ্জ। যদিও ক্রিকেটে কোনো কিছু অসম্ভব নয়। কেউ একজন দাঁড়িয়ে গেলে ম্যাচটা জমবে ভালো। এখন এই ক্রিকেটের চিন্তা বাদ দিয়ে চলো আমরা আমাদের ম্যাচটা জমিয়ে তুলি।
সরো, একদম অসভ্যতামি করবে না। এমনিতেই এভাবে আসাটায় আমার মন সায় দেয়নি। তারপর তুমি এমন করলে আমি কিন্তু এখনই চলে যাবো।
আহ্ রাগ করছো কেন। তোমাকে এভাবে কাছে পেয়েছি, একটু ওয়ার্মআপ তো করতে দেবে। ম্যাচ খেলার বিষয়ে না হয় পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
তোমারে তো আমি রগে রগে চিনি। বসতে দিলে শুতে চাও।
এমনটা তো শুধু তোমার সঙ্গে করি। আর কারো সঙ্গে তো এমন করি না। তবে একটা মনোবাসনা পূরণ করার জন্য আজ এত পরিকল্পনা করে তোমাকে আসতে বলেছি। দিনটি স্মৃতিপটে খোদাই করে রাখতে চাই। এজন্য তোমার সহযোগিতা চাইছি।
আমি তো তোমাকে আগেই বারণ করে দিয়েছি, বদখত কোনো কাজ চলবে না। তোমার কোনো মনোবাসনাও পূরণ করতে পারবো না।
তা তো জানি, বারণ তুমি করবেই। বোলার ব্যাটসম্যানকে ফিরিয়ে দিতে চাইবে আর ব্যাটসম্যান বোলারের ওপর চড়াও হবে, এটাই তো রীতি। তা না হলে তো খেলায় মজা পাওয়া যায় না। একতরফা খেলায় কোনো আনন্দ নেই।
খলের তো ছলের কোনো অভাব হয় না। এই টিভিটা ছাড়ো তো। ভারত কি ব্যাটিং শুরু করেছে?
হু। আজকে বোধহয় মোহাম্মদ হাফিজের দিন। দ্বিতীয় বলেই গৌতম গম্ভীরকে পত্রপাঠ বিদায় করে দিয়েছে।
ভারত ভালোই চাপে পড়ে গেছে। এই চাপ কাটিয়ে ওঠা এত সহজ হবে না। অ্যাই চন্ডু, তুমি কি আমাকে ভারত মনে করছো নাকি? এত চাপাচাপি করছো কেন? হতচ্ছাড়া একটা। কোনো মাত্রাজ্ঞান নেই। কখন যে কে এসে পড়বে। জানালার পর্দা ভালোভাবে টেনে দিয়ে আসো।
আহ্ সোনা, তুমি কত ভালো। তাই আমার জগতটা হয়ে গেছে আলো।
তা তো বলবেই। তোমার তো বদগিরি ভালো লাগে।
টেন্ডুলকারের মুখাবয়বে কেমন যেন বিষণ্নতা ছড়িয়ে আছে। কিন্তু কোহলিকে বেশ ডেসপারেট মনে হচ্ছে। প্রফুল্ল মেজাজেই ব্যাট করছে। বড় টার্গেট চেজ করতে হবে, তা নিয়ে কোনো দুর্ভাবনা আছে বলে মনে হচ্ছে না।
তোমারও তো কোনো দুর্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। ভাবটা এমন, যেন নিজের বাড়িতেই আছো। কোনো হুঁশজ্ঞান নেই। অথচ যে কোনো মুহূর্তে বিপদ আসতে পারে।
খেলা কোথায় হচ্ছে, সেটা তো কোনো বিষয় নয়। খেলায় বিপদ আসতেই পারে। তা নিয়ে ভেবে তো খেলা থেকে বিরত থাকা যাবে না। তবে খেলাটাও একটা সৃজনশীল কাজ। খেলতে হয় অভিনিবেশ সহকারে। দুশ্চিন্তা করলে তো মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। খেলায় ছন্দপতন ঘটে। দেখলা না, মনোনিবেশ করতে না পারায় শূন্য রানে আউট হয়ে গেল গৌতম।
তোমার তো দেখি টেস্ট ম্যাচ খেলার মেজাজ। কিন্তু আসল কাজের সময় তো ছটফট করো। আজ এত সময় নেই। উঠো উঠো।
উঠছিরে বাবা। কিন্তু খেলাটা তো ভালো জমলো না। গৌতম গম্ভীরের মতো পরিণতি হবে, বুঝতে পারিনি। আমার এখন একটা হিন্দি গানের লাইন মনে পড়ছে, ‘ম্যায় আনাড়ি তু খিলাড়ি’। আসলেই নিজেকে আনাড়ি মনে হচ্ছে।
যত ঢঙের কথা। এবার চলো তো। রাত হয়ে যাচ্ছে।
টেন্ডুলকার সহজাত ভঙ্গিমায় ফিফটি করে চলে গেল।
হায়! টেন্ডুলকার আউট! ওয়ানডে ক্রিকেটে সেঞ্চুরির ফিফটি আর হলো না।
সাঈদ আজমলের দোসরা ঠিকমতো বুঝতে পারেনি। স্লিপে ক্যাচ দিয়েছে।
যাই বলো না কেন, মন এক জটিল রহস্যের আধার। যত বড় ব্যাটসম্যান হও না কেন মনঃসংযোগ করতে না পারলে খেলায় সুবিধা করতে পারবে না।
এ কথা বলছো কেন? টেন্ডুলকার তো খুব একটা খারাপ খেলেনি। এই চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়সেও ব্যাটিংয়ে কোনো জড়তা নেই। এখনো দলের অন্যতম স্তম্ভ। দেখলা না তাঁকে আউট করার পর পাকিস্তান দলের যেন ম্যাচ জয়ের উচ্ছ্বাস। তবে টেন্ডুলকার আর কিছুক্ষণ থাকলে ভারত স্বস্তিতে থাকতে পারতো।
শুধু টেন্ডুলকারের কথা বলছি না। এই মুহূর্তে মনের মধ্যে দ্বৈত অনুভূতি কাজ করছে। নিজের তো বটেই, টেন্ডুলকারের জন্যও। হয়তো অনেক প্রত্যাশা, অনেক প্রস্তুতি কিংবা অনেক আয়োজন করা হলো৷ ভিতরে ভিতরে টগবগানি। ছটফটানি। রগরগানি। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে মনটা দপ করে নিভে গেল। তখন সবকিছু কেমন ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। জীবন তো আসলেই এমনই। কখন জ্বলবে, কখন নিভে যাবে, নিশ্চিত করে বলা যায় না। তাই না?
হঠাৎ দেখি দার্শনিক হয়ে গেলে! চলো চলো। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে।
হুম, চলো। কোহলি তো একাই ফাটিয়ে দিচ্ছে। কিছু একটা করে ফেলবে বলে মনে হচ্ছে। রোহিত শর্মা অবশ্য ভালোই সাপোর্ট দিচ্ছে।
সাপোর্ট দিলেই কেবল জ্বলে ওঠা যায় না। খেলায় ভালো করতে হলে কোহলির মতো একাগ্রতা ও গভীর মনঃসংযোগ থাকতে হয়। না হলে চুপসে যেতে হয়। কোনো কাজে তোমার মতো অস্থির হলে চলে না।
তা তো অবশ্যই। কিন্তু সবাই তো আর বিরাট কোহলির মতো ড্যাশিং ব্যাটসম্যান হতে পারে না।
জান, তোমার কি কোনো কারণের মন খারাপ হয়ে গেছে? তোমাকে এত নিষ্প্রভ লাগছে কেন? টেলিফোনে তো তোমাকে দারুণ প্রাণচঞ্চল লাগছিল। নিশ্চয়ই খুশি হতে পারোনি। আসলে সব দিন তো সবকিছু ঠিকমতো হয় না। মনের মধ্যে অস্থিরতা থাকলে কোনো কাজ ঠিকভাবে সম্পন্ন করা যায় না। যে কারণে হোক আজ হয়তো মনঃসংযোগ ব্যাহত হয়েছে। যেমনটা প্রত্যাশা করেছিলে, তেমনটা হয়নি। আরেক দিন নিশ্চয়ই হবে। এ নিয়ে মন খারাপ করার কী আছে?
তোমার কথাই ঠিক। না হওয়ার কারণ তো একটা আছেই। তোমাকে বলেছিলাম না আজকের দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে চাই। এ কারণে তোমাকে আসার জন্য এত পীড়াপীড়ি করেছি। কেন করেছি জানো? আমার দিকে মনোযোগী হওয়ায় তুমি হয়তো খেয়াল করতে পারোনি। আজ শেষ ওয়ানডে ক্রিকেট ম্যাচ খেললো শচীন টেন্ডুলকার।
তাই না-কি? আর এমন একটা ম্যাচ তুমি দেখতে গেলে না! আমাকেও ভালোভাবে দেখতে দিলে না। অনেক বড় একটা ঘটনা থেকে বঞ্চিত হতে হলো।
আসলে আমি ইচ্ছে করেই খেলা দেখতে যাইনি। এই ম্যাচটা সামনা-সামনি দেখতে চাইনি। যে কোনো বিদায় আমাকে মথিত করে। আর টেন্ডুলকারের মতো একজন ক্রিকেটারের বিদায় খুব কষ্টকর। এই কষ্টটা তোমার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চেয়েছি। অদ্ভুত ব্যাপার কি জানো, টেন্ডুলকার শূন্য দিয়ে শুরু করেছিলেন ওয়ানডে ক্রিকেট। সেদিন কি তিনি ভাবতে পেরেছিলেন কেমন হবে তাঁর ক্যারিয়ার? পারেননি। কিন্তু শূন্যতাকে তিনি যেভাবে পূর্ণতা দিয়েছেন, তার কোনো তুলনা চলে না। ২২ বছরের বেশি বর্ণাঢ্য ওয়ানডে ক্রিকেট ক্যারিয়ার। তা কানায় কানায় পরিপূর্ণ। গত ম্যাচেও বাংলাদেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেঞ্চুরির শতক পূরণ করেন। তার মতো জাত ক্রিকেটার সহসা দেখতে পাওয়া যায় না। এই প্রজন্মে এমন একজন ক্রিকেটারকে পেয়েছে, তা অত্যন্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর কত কত স্মৃতি। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে, আর কখনো রঙিন পোশাকে উইলো হাতে তাঁকে দেখা যাবে না। অবসান ঘটলো গৌরবময় এক অধ্যায়ের। সেটাও কি-না ঢাকার মাঠে! তাঁর বিদায়ে অনেকটাই রঙ হারাবে ক্রিকেটের ক্যানভাস।
বয়সের কারণে টেন্ডুলকার এখন অনেকটাই অস্তমিত সূর্য। এখন সময় বিরাট কোহলিদের। এটাই তো জগতের নিয়ম। তাই না?
এই নিয়ম অনুসারে আমরাও জানি না, আমাদের এই সম্পর্কের পরিণতি কী? জীবনের বাঁকে বাঁকে কত যে রহস্য ছড়ানো। তার হদিস আমরা কতটুকু জানি? তবে মানুষ বেঁচে থাকে স্মৃতি নিয়ে। টেন্ডুলকারের শেষ ওয়ানডে ম্যাচটির কথা যখন আমাদের স্মৃতিতে ভেসে ওঠবে, তখন আমরা কে কোথায় থাকবো জানি না। কিন্তু এই দিনটির কথা তুমি কিংবা আমি কখনো কি ভুলতে পারবো?