স্মৃতি থেকে সবটাই কি হারিয়ে যায়? আমি ঠিক জানি না। তবে কিছু কিছু স্মৃতি হারিয়ে যেতে যেতে আবার বোধকরি ফিরেও আসে। অন্তত প্রতিটি প্রজন্মের স্মৃতিতে তার সময়ের একটা ছাপ থেকেই যায়। নিজের সময়টাকে সবার কাছেই অত্যন্ত তাৎপর্যময় মনে হয়। মনে হয় অনেক রঙিন। অনেক বর্ণিল। অনেক মাদকতাময়। অন্য সময়ের মানুষের কাছে হয়তো সেটা তেমন গুরুত্ব পায় না। এটাই স্বাভাবিক। এভাবেই তো পেরিয়ে যাচ্ছে জীবন। তবে চিরকালীন যে বিষয়গুলো আছে, তা সব সময়ই বরিত হয়ে আসছে। কম কিংবা বেশি। তবে সময়ের পালাবদলে বাড়ে বৈভব। বাড়ে বৈচিত্র্য। আজ পয়লা ফাল্গুন। চারপাশটা কেমন রঙিন হয়ে ওঠে। হলুদ, লাল, সবুজের বাহারি সাজ আর বাসন্তী হাওয়ায় মনের মধ্যে গেয়ে ওঠে দুষ্টু কোকিল। তাতে টোকা পড়ে হৃদয়ের গহিনে। হঠাৎ কেন জানি বুকের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে গুঞ্জন তুলতে থাকে স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়া আমাদের সময়ের কিছু গানের কলি। ধরি ধরি করেও ঠিকমতো ধরতে পারছিলাম না। কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে গেছে। সুরটা আলতোভাবে অনুরণন তুললেও কোথাও যেন একটা গ্যাপ থেকে যাচ্ছিল। অনেকক্ষণ মনের মধ্যে মেঘ আর রোদের মতো লুকোচুরি খেলার পর একে একে মনে পড়তে থাকে স্মৃতিময় সেই গানের কলিগুলো,
‘এক ডালি ফুল তোমার হাতে দিয়ে আমি
বলেছিলাম ভালোবাসি
ভালোবাসি সবচেয়ে বেশি
শুধু তোমাকে
শুধু তোমাকে
শুধু তোমাকে।’
‘ভালোবাসা যদি তুমি নাইবা দিলে
এতটুকু ব্যথা ওগো দিয়ে যাও মোরে।’
‘চলেই যদি যাবে তুমি
তবে, এসেছিল কেন
আমারই অন্তরে।’
‘আমি তোমাকে ভালোবেসেছি
তুমি আমাকে ভুলে যেও না।’
‘যাই বলে যেতে নাইরে
আরেকটু বসে যা নারে।’
‘এই তো সেদিন তুমি ছিলে আমারই হৃদয়জুড়ে
জানি না কীসের আসায় গেলে চলে
মনের দেওয়ালে আজও পড়ে তোমারই ছায়া
তাইতো লাগে আজও এত বেশি মায়া
এইভাবে দিন যদি যায় চলে স্মৃতির মালা গেঁথে গেঁথে
তবে রবে না কোনই ব্যথা এ মনেরও মাঝেতে।’
জুয়েলের গাওয়া এই গানগুলো এখন আর শোনা যায় না। শিল্পীও এখন অনেকটাই বিস্মৃত। আমাদের প্রজন্মের কারও কারও স্মৃতিতে হয়তো হঠাৎ হঠাৎ ভেসে ওঠেন। অথচ একটা সময় তাঁর গানগুলো ছিল তরুণদের মুখে মুখে। ক্যাসেট প্লেয়ারে কোথাও না কোথাও এই গানগুলো হরদম বাজতো। আশির দশকের শুরুর দিকে আমরা যখন কলেজে পড়ি, তখন স্বভাবতই মনটা ছিল উড়ৃ উড়ৃ, সেই সময় তাঁর গানগুলো আমাদের ভালোবাসার গান হয়ে ওঠে। তখন তো ভালোবাসা এখনকার মতো এত সুলভ ছিল না, এই ধরনের গানেই আমার পেতাম ভালোবাসার সুখ। ভালোবাসার দুখ। এই শিল্পী খুব অল্প বয়সেই জয় করে নেন আমাদের মতো তরুণদের হৃদয়। তাঁর গানে ছিল ভালোবাসার তুমুল আকুতি আর না পাওয়ার তীব্র বেদনা। তখন তো আর আমাদের দেশে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ উদযাপিত হতো না। হলে তাঁর গানগুলো হতে পারতো এই দিনটির অন্যতম অনুষঙ্গ। ভালোবাসার মানুষের হাতে এক ডালি ফুল তুলে দিয়ে বলা যেত, ভালোবাসি সবচেয়ে বেশি, শুধু তোমাকে। তবে শিল্পী পেয়েছিলেন অনেক তরুণ-তরুণীর ভালোবাসা। হৃদয়ের নৈবেদ্য। কিন্তু নিজেকে পরিপূর্ণভাবে মেলে ধরার আগেই একবুক ভালোবাসা নিয়ে একদমই অকালে ঝরে যান প্রতিভাবান এই শিল্পী। চলে গিয়েও তিনি রয়ে গেছেন আমাদের স্মৃতিতে। আমাদের অন্তরে। আমাদের ভালোবাসায়।
(জাহিদুল ইসলাম জুয়েল। জন্ম : ২৩ জানুয়ারি ১৯৬৫। মৃত্যু : ১৪ জানুয়ারি ১৯৮৫। তাঁর প্রথম ক্যাসেট বাজারে আসে ১৯৮৩ সালে।)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন