পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

রবিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

স্মৃতিরা একদমই হারিয়ে যায় না

স্মৃতিরা বড় অদ্ভুত। বড় রহস্যময়। প্রতারকও। এর কোনও থৈ পাওয়া যায় না। দেখা গেল, অল্প সময়ের আগের স্মৃতি খুব দ্রুত হারিয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও উদ্ধার করা যায় না। পাওয়া যায় না তার ঠিকুজি। আবার এমন সব বিষয় ফিরে আসে, যা মনে থাকার কথা নয়। হয়তো অতীতের কোন গহনে ঘাপটি মেরে ছিল। তবুও বিস্ময়করভাবে মনে পড়ে যায়। অবাক করা ব্যাপার হলো, মধুর স্মৃতিরা হারিয়ে যেতে বেশি সময় নেয় না। অথচ অনেক অপমান, অনেক কষ্ট, অনেক বেদনার স্মৃতি মন থেকে উপড়ে ফেলতে চাইলেও মুছে ফেলা যায় না। আর আমার স্মৃতিশক্তি তো মাশাল্লাহ ‘গোল্ডফিশ মেমোরি’। বলতে গেলে কোনও স্মৃতিই জমা হয় না। এ কারণে মাথাটা ফুটো কলসের মতো খালি পড়ে থাকে। কোনও কাজে আসে না। মাঝে মাঝে স্মৃতির তরণি বেয়ে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে শৈশবে। কেমন ছিল আমার সেই দিনগুলো? হায়! অনেক মাথা খোড়ার পর মনে হয়, আমার বোধহয় কোনও শৈশব ছিল না! না হলে কোনও স্মৃতি কেন মনে পড়ে না? হাল ছেড়ে দিয়ে অসহায়ভাবে বসে থাকি চুপচাপ। যখন স্মৃতি নিয়ে কোনও নাড়াচাড়া করাই ছেড়ে দেই, তখন দেখি, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মতো কী যেন ভেসে আসছে। তবে সেটা বাস্তব নয়। কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন। কেবলই দেখতে পাই ছায়া ছায়া একটি দৃশ্যপট, একটা শিশু তরোয়াল নিয়ে লড়াই করছে। ভয়ঙ্কর সব সাপ ছুটছে। সেই সঙ্গে একটা উর্দু গানের সুর। গানের লাইনটা বোধকরি এমন, ‘পিয়ারি মা দোয়া করো/ম্যায় জলদ বড়া হো যাউ’। লাইনটা ঠিক লিখলাম কিনা জানি না। আমার জীবনে উর্দু ভাষায় এ একটি লাইনই সম্বল। স্মৃতিতে কুয়াশার মতো জমে থাকা এ লাইনটি ছাড়া আর কিছু মনে করতে পারি না। জোড়াতালি দিয়ে বুঝতে পারি, এটি কোনও উর্দু সিনেমার দৃশ্য ও গান। এই সিনেমাটা কোথায় দেখেছিলাম, আমি নিশ্চিত নই। তবে একটু একটু মনে পড়ে, তখন বোধহয় থাকি মতিঝিল কলোনিতে। সেই সময় বিনোদন বলতে ছিল সিনেমা দেখা।


বাসার কাছে ‘জোনাকী হল’। বড়দের সঙ্গে যেতাম আমিও। আমার তো টিকিট লাগতো না। মা কিংবা অন্য কারও কোলে বসে দেখতাম। কিছু বোঝার কথা নয়। কোনও কিছু মনে থাকারও কথা নয়। কিন্তু স্মৃতির খামখেয়ালি আমাকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তান জমানায় আমার জন্ম। তাছাড়া চলচ্চিত্র যে অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম, সেটা অনুভব করতে পারি। নিজের শৈশবের স্মৃতি খুঁজে পাই না। কিন্তু মা কিংবা কোনও আত্মীয়র কোলে বসে দেখা সিনেমার খণ্ড খণ্ড দৃশ্য কেন যেন মনে পড়ে যায়। নিশ্চয়ই রুপালি পর্দায় তরোয়াল, সাপ, গানের মানুষদের চলমানতা আমার শিশু মনে বিস্ময় হয়ে এসেছিল। এ কারণে হয়তো বুকের ভিতরে আঁচড়ও কেটেছিল। মনে পড়ে যায়, উর্দু থেকে থেকে বাংলায় করা ‘তালাশ’ ছবির কথা। শবনম, রহমান, সুভাষ দত্ত অভিনীত এই ছবির তেমন কিছু মনে নেই। কিন্তু ছবির একাধিক গানের কিছু কিছু লাইন হৃদয়ে দাগ কেটে আছে। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘তুমি আছো আমি আছি এ রঙিন ক্ষণে/কত সুন্দর এ রাত যে/ও মাশাল্লাহ কী বরাত যে’, ‘মওসুম রঙ্গিলা সোনালি হাওয়া/এ সময় মন হায় কেড়ে নিল কে’, ‘আমি রিক্সাওয়ালা মাতওয়ালা’। এই গানগুলোর উর্দু সংস্করণও কানে বেজেছে। অবশ্য পুরনো ঢাকায় থাকার সময় একটি গান মাইকে হররোজ বাজতো, ‘হো লাল মেরি রাখিও বালা ঝুলে লালরে/সিন্দিরিদা দেবর দা সাকি সাবাস কালান্দার/দমাদম মাস্ত কালান্দার আলীদা বম্বে আন্দার/দমাদম মাস্ত কালান্দার আলীদা প্যায়লা নাম্বার’। এ গানের শিল্পী কে ছিল, এটা কী ধরনের গান, কিছুই জানতাম না। পরবর্তীতে রুনা লায়লার কণ্ঠে এ কাওয়ালি গানটি শুনেছি। তবে এই গানের অর্থ এখনও জানি না। এছাড়াও আরও কিছু উর্দু গান কর্ণগোচর হয়েছে। একটু একটু করে সুর ভাসে। কিন্তু গানের কলি মনে পড়ে না। তবে যে গানগুলোর কথা উল্লেখ করলাম, কোনটা আগে, কোনটা পরে শুনেছি, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারবো না। স্মৃতির ধূসর পাতায় দিন-তারিখ দিয়ে তো দিনলিপি জমা থাকে না। কেন যে থাকে না! এখানে এসে মনে হচ্ছে, স্মৃতিরা আমার সঙ্গে বেশ প্রতারণা করছে। আমি ভজকট পাকিয়ে ফেলছি। এখন স্মরণ হচ্ছে, আমরা তো পুরনো ঢাকায় আগে ছিলাম। তারপর না ছিলাম মতিঝিলে। তাহলে আমার প্রথম স্মৃতি কোনটি? তারপরও কথা থেকে যায়। ১৯৭৫ সালের শেষদিকে রেডিওতে ফিরে এসেছিল উর্দু গান। আমি সময়ের হিসেব গুলিয়ে ফেলছি নাতো? যাহোক, টুকরো টুকরো এই স্মৃতিগুলো মনে করিয়ে দেয়, আমরা ‘পরাধীন’ একটি দেশে থাকতাম। যেখানে ছিল উর্দু ভাষার দাপট। ভাষাও যে এক ধরনের সম্প্রসারণবাদের কাজ করে, সেটা তো এখন বুঝতে পারি। হিন্দির আগ্রাসনে কলকাতায় বাংলা ভাষা আজ অনেকটাই পর্যুদস্ত। যদি বাংলাদেশ না পেতাম, তাহলে আমাদের হয়তো আধা উর্দু আর আধা বাংলার সংমিশ্রণে এক জগাখিচুড়ি ভাষায় অভ্যস্ত হতে হতো। স্মৃতির পাতায় ভর করে দেখি জেগে ওঠেছে জাতীয়তাবাদী চেতনাও। অবশ্য স্মৃতিই তো গড়ে তোলে একজন মানুষের মানসভুবন। তাই বোধকরি স্মৃতিরা একদমই হারিয়ে যায় না। কোনও না কোনওভাবে ফিরে ফিরে আসে।

বুধবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

কবিতা যেন অধরা এক মাধুরী

শুরুতেই কবুল করে নেওয়া ভালো, কবিতার সঙ্গে আমার বোঝাপড়া আজ অব্দি হলো না। আমার কাছে কবিতা যেন অধরা এক মাধুরী। যার মাধুর্য কিছুটা অনুভব করতে পারি। তবে ঠিকমতো বুঝতে পারি না। আর যে কবিতা বুঝতে পারে না, তার কাছে তো জীবনানন্দ দাশ দূর আকাশের অচেনা কোনও নক্ষত্র হয়ে থাকার কথা। এই বোধটুকু অন্তত আছে, জীবন বাবুর নাগাল পেতে হলে প্রথমে গভীরভাবে বুঝতে হয় কবিতা। তারপরই না অবগাহন করা যায় ধানসিঁড়ি নদীতে। বড়ই জটিল জটিল লাগে। এমন এক জটিলতায় তাঁকে আপন ভাবার সুযোগ কোথায়? অবশ্য এর উত্তর তো তিনিই দিয়েছেন, ‘আরো এক বিপন্ন বিস্ময়/আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতর/খেলা করে’। এটা যে কীভাবে খেলা করে, তার ব্যাখা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তারপরও কী এক দুর্জ্ঞেয় কারণে প্রিয় কবি হয়ে যান তিনি। বুঝতে না পারলেও তাঁর কবিতা ‘অন্তর্গত রক্তের ভিতর’ যেভাবে দোলা দেয়, যেভাবে সম্মোহিত করে, তেমনভাবে আর কেউ পারেন না। এটাই বোধকরি তাঁর মুন্সিয়ানা। সেই কৈশোরে তাঁর কবিতার সঙ্গে যখন পরিচয় হয়, তখন থেকেই কেন জানি মনে হয়, সবাই কবিতা লেখেন কলমের কালি দিয়ে। আর তিনি লেখেন আঙুলের রক্ত দিয়ে। এমন মনে হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কোনও কারণ আমি বলতে পারবো না। সব কিছু তো যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায় না। তিনিই তো কোনও কিছু যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চান নি। জীবিতকালে কেউ তাঁকে বুঝতেও পারে নি। না বোঝার অভিযোগ আর অভিমান নিয়ে চলে গেছেন তিনি। এখন কিন্তু তাঁকে বুঝতে চাওয়ার ঝোঁক বাড়ছে। যতই দিন যাচ্ছে, ততই যেন তিনি কবিতানুরাগীদের আপন হয়ে ওঠছেন।

শুধু তোমাকে

স্মৃতি থেকে সবটাই কি হারিয়ে যায়? আমি ঠিক জানি না। তবে কিছু কিছু স্মৃতি হারিয়ে যেতে যেতে আবার বোধকরি ফিরেও আসে। অন্তত প্রতিটি প্রজন্মের স্মৃতিতে তার সময়ের একটা ছাপ থেকেই যায়। নিজের সময়টাকে সবার কাছেই অত্যন্ত তাৎপর্যময় মনে হয়। মনে হয় অনেক রঙিন। অনেক বর্ণিল। অনেক মাদকতাময়। অন্য সময়ের মানুষের কাছে হয়তো সেটা তেমন গুরুত্ব পায় না। এটাই স্বাভাবিক। এভাবেই তো পেরিয়ে যাচ্ছে জীবন। তবে চিরকালীন যে বিষয়গুলো আছে, তা সব সময়ই বরিত হয়ে আসছে। কম কিংবা বেশি। তবে সময়ের পালাবদলে বাড়ে বৈভব। বাড়ে বৈচিত্র্য। আজ পয়লা ফাল্গুন। চারপাশটা কেমন রঙিন হয়ে ওঠে। হলুদ, লাল, সবুজের বাহারি সাজ আর বাসন্তী হাওয়ায় মনের মধ্যে গেয়ে ওঠে দুষ্টু কোকিল। তাতে টোকা পড়ে হৃদয়ের গহিনে। হঠাৎ কেন জানি বুকের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে গুঞ্জন তুলতে থাকে স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়া আমাদের সময়ের কিছু গানের কলি। ধরি ধরি করেও ঠিকমতো ধরতে পারছিলাম না। কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে গেছে। সুরটা আলতোভাবে অনুরণন তুললেও কোথাও যেন একটা গ্যাপ থেকে যাচ্ছিল। অনেকক্ষণ মনের মধ্যে মেঘ আর রোদের মতো লুকোচুরি খেলার পর একে একে মনে পড়তে থাকে স্মৃতিময় সেই গানের কলিগুলো, ‘এক ডালি ফুল তোমার হাতে দিয়ে আমি বলেছিলাম ভালোবাসি ভালোবাসি সবচেয়ে বেশি শুধু তোমাকে শুধু তোমাকে শুধু তোমাকে।’ ‘ভালোবাসা যদি তুমি নাইবা দিলে এতটুকু ব্যথা ওগো দিয়ে যাও মোরে।’ ‘চলেই যদি যাবে তুমি তবে, এসেছিল কেন আমারই অন্তরে।’ ‘আমি তোমাকে ভালোবেসেছি তুমি আমাকে ভুলে যেও না।’ ‘যাই বলে যেতে নাইরে আরেকটু বসে যা নারে।’ ‘এই তো সেদিন তুমি ছিলে আমারই হৃদয়জুড়ে জানি না কীসের আসায় গেলে চলে মনের দেওয়ালে আজও পড়ে তোমারই ছায়া তাইতো লাগে আজও এত বেশি মায়া এইভাবে দিন যদি যায় চলে স্মৃতির মালা গেঁথে গেঁথে তবে রবে না কোনই ব্যথা এ মনেরও মাঝেতে।’


 জুয়েলের গাওয়া এই গানগুলো এখন আর শোনা যায় না। শিল্পীও এখন অনেকটাই বিস্মৃত। আমাদের প্রজন্মের কারও কারও স্মৃতিতে হয়তো হঠাৎ হঠাৎ ভেসে ওঠেন। অথচ একটা সময় তাঁর গানগুলো ছিল তরুণদের মুখে মুখে। ক্যাসেট প্লেয়ারে কোথাও না কোথাও এই গানগুলো হরদম বাজতো। আশির দশকের শুরুর দিকে আমরা যখন কলেজে পড়ি, তখন স্বভাবতই মনটা ছিল উড়ৃ উড়ৃ, সেই সময় তাঁর গানগুলো আমাদের ভালোবাসার গান হয়ে ওঠে। তখন তো ভালোবাসা এখনকার মতো এত সুলভ ছিল না, এই ধরনের গানেই আমার পেতাম ভালোবাসার সুখ। ভালোবাসার দুখ। এই শিল্পী খুব অল্প বয়সেই জয় করে নেন আমাদের মতো তরুণদের হৃদয়। তাঁর গানে ছিল ভালোবাসার তুমুল আকুতি আর না পাওয়ার তীব্র বেদনা। তখন তো আর আমাদের দেশে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ উদযাপিত হতো না। হলে তাঁর গানগুলো হতে পারতো এই দিনটির অন্যতম অনুষঙ্গ। ভালোবাসার মানুষের হাতে এক ডালি ফুল তুলে দিয়ে বলা যেত, ভালোবাসি সবচেয়ে বেশি, শুধু তোমাকে। তবে শিল্পী পেয়েছিলেন অনেক তরুণ-তরুণীর ভালোবাসা। হৃদয়ের নৈবেদ্য। কিন্তু নিজেকে পরিপূর্ণভাবে মেলে ধরার আগেই একবুক ভালোবাসা নিয়ে একদমই অকালে ঝরে যান প্রতিভাবান এই শিল্পী। চলে গিয়েও তিনি রয়ে গেছেন আমাদের স্মৃতিতে। আমাদের অন্তরে। আমাদের ভালোবাসায়।

 (জাহিদুল ইসলাম জুয়েল। জন্ম : ২৩ জানুয়ারি ১৯৬৫। মৃত্যু : ১৪ জানুয়ারি ১৯৮৫। তাঁর প্রথম ক্যাসেট বাজারে আসে ১৯৮৩ সালে।)