স্মৃতিরা বড় অদ্ভুত। বড় রহস্যময়। প্রতারকও। এর কোনও থৈ পাওয়া যায় না। দেখা গেল, অল্প সময়ের আগের স্মৃতি খুব দ্রুত হারিয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও উদ্ধার করা যায় না। পাওয়া যায় না তার ঠিকুজি। আবার এমন সব বিষয় ফিরে আসে, যা মনে থাকার কথা নয়। হয়তো অতীতের কোন গহনে ঘাপটি মেরে ছিল। তবুও বিস্ময়করভাবে মনে পড়ে যায়। অবাক করা ব্যাপার হলো, মধুর স্মৃতিরা হারিয়ে যেতে বেশি সময় নেয় না। অথচ অনেক অপমান, অনেক কষ্ট, অনেক বেদনার স্মৃতি মন থেকে উপড়ে ফেলতে চাইলেও মুছে ফেলা যায় না। আর আমার স্মৃতিশক্তি তো মাশাল্লাহ ‘গোল্ডফিশ মেমোরি’। বলতে গেলে কোনও স্মৃতিই জমা হয় না। এ কারণে মাথাটা ফুটো কলসের মতো খালি পড়ে থাকে। কোনও কাজে আসে না। মাঝে মাঝে স্মৃতির তরণি বেয়ে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে শৈশবে। কেমন ছিল আমার সেই দিনগুলো? হায়! অনেক মাথা খোড়ার পর মনে হয়, আমার বোধহয় কোনও শৈশব ছিল না! না হলে কোনও স্মৃতি কেন মনে পড়ে না? হাল ছেড়ে দিয়ে অসহায়ভাবে বসে থাকি চুপচাপ।
যখন স্মৃতি নিয়ে কোনও নাড়াচাড়া করাই ছেড়ে দেই, তখন দেখি, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মতো কী যেন ভেসে আসছে। তবে সেটা বাস্তব নয়। কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন। কেবলই দেখতে পাই ছায়া ছায়া একটি দৃশ্যপট, একটা শিশু তরোয়াল নিয়ে লড়াই করছে। ভয়ঙ্কর সব সাপ ছুটছে। সেই সঙ্গে একটা উর্দু গানের সুর। গানের লাইনটা বোধকরি এমন, ‘পিয়ারি মা দোয়া করো/ম্যায় জলদ বড়া হো যাউ’। লাইনটা ঠিক লিখলাম কিনা জানি না। আমার জীবনে উর্দু ভাষায় এ একটি লাইনই সম্বল। স্মৃতিতে কুয়াশার মতো জমে থাকা এ লাইনটি ছাড়া আর কিছু মনে করতে পারি না। জোড়াতালি দিয়ে বুঝতে পারি, এটি কোনও উর্দু সিনেমার দৃশ্য ও গান। এই সিনেমাটা কোথায় দেখেছিলাম, আমি নিশ্চিত নই। তবে একটু একটু মনে পড়ে, তখন বোধহয় থাকি মতিঝিল কলোনিতে। সেই সময় বিনোদন বলতে ছিল সিনেমা দেখা।
বাসার কাছে ‘জোনাকী হল’। বড়দের সঙ্গে যেতাম আমিও। আমার তো টিকিট লাগতো না। মা কিংবা অন্য কারও কোলে বসে দেখতাম। কিছু বোঝার কথা নয়। কোনও কিছু মনে থাকারও কথা নয়। কিন্তু স্মৃতির খামখেয়ালি আমাকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তান জমানায় আমার জন্ম। তাছাড়া চলচ্চিত্র যে অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম, সেটা অনুভব করতে পারি। নিজের শৈশবের স্মৃতি খুঁজে পাই না। কিন্তু মা কিংবা কোনও আত্মীয়র কোলে বসে দেখা সিনেমার খণ্ড খণ্ড দৃশ্য কেন যেন মনে পড়ে যায়। নিশ্চয়ই রুপালি পর্দায় তরোয়াল, সাপ, গানের মানুষদের চলমানতা আমার শিশু মনে বিস্ময় হয়ে এসেছিল। এ কারণে হয়তো বুকের ভিতরে আঁচড়ও কেটেছিল। মনে পড়ে যায়, উর্দু থেকে থেকে বাংলায় করা ‘তালাশ’ ছবির কথা। শবনম, রহমান, সুভাষ দত্ত অভিনীত এই ছবির তেমন কিছু মনে নেই। কিন্তু ছবির একাধিক গানের কিছু কিছু লাইন হৃদয়ে দাগ কেটে আছে। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘তুমি আছো আমি আছি এ রঙিন ক্ষণে/কত সুন্দর এ রাত যে/ও মাশাল্লাহ কী বরাত যে’, ‘মওসুম রঙ্গিলা সোনালি হাওয়া/এ সময় মন হায় কেড়ে নিল কে’, ‘আমি রিক্সাওয়ালা মাতওয়ালা’। এই গানগুলোর উর্দু সংস্করণও কানে বেজেছে। অবশ্য পুরনো ঢাকায় থাকার সময় একটি গান মাইকে হররোজ বাজতো, ‘হো লাল মেরি রাখিও বালা ঝুলে লালরে/সিন্দিরিদা দেবর দা সাকি সাবাস কালান্দার/দমাদম মাস্ত কালান্দার আলীদা বম্বে আন্দার/দমাদম মাস্ত কালান্দার আলীদা প্যায়লা নাম্বার’। এ গানের শিল্পী কে ছিল, এটা কী ধরনের গান, কিছুই জানতাম না। পরবর্তীতে রুনা লায়লার কণ্ঠে এ কাওয়ালি গানটি শুনেছি। তবে এই গানের অর্থ এখনও জানি না। এছাড়াও আরও কিছু উর্দু গান কর্ণগোচর হয়েছে। একটু একটু করে সুর ভাসে। কিন্তু গানের কলি মনে পড়ে না। তবে যে গানগুলোর কথা উল্লেখ করলাম, কোনটা আগে, কোনটা পরে শুনেছি, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারবো না। স্মৃতির ধূসর পাতায় দিন-তারিখ দিয়ে তো দিনলিপি জমা থাকে না। কেন যে থাকে না! এখানে এসে মনে হচ্ছে, স্মৃতিরা আমার সঙ্গে বেশ প্রতারণা করছে। আমি ভজকট পাকিয়ে ফেলছি। এখন স্মরণ হচ্ছে, আমরা তো পুরনো ঢাকায় আগে ছিলাম। তারপর না ছিলাম মতিঝিলে। তাহলে আমার প্রথম স্মৃতি কোনটি? তারপরও কথা থেকে যায়। ১৯৭৫ সালের শেষদিকে রেডিওতে ফিরে এসেছিল উর্দু গান। আমি সময়ের হিসেব গুলিয়ে ফেলছি নাতো? যাহোক, টুকরো টুকরো এই স্মৃতিগুলো মনে করিয়ে দেয়, আমরা ‘পরাধীন’ একটি দেশে থাকতাম। যেখানে ছিল উর্দু ভাষার দাপট। ভাষাও যে এক ধরনের সম্প্রসারণবাদের কাজ করে, সেটা তো এখন বুঝতে পারি। হিন্দির আগ্রাসনে কলকাতায় বাংলা ভাষা আজ অনেকটাই পর্যুদস্ত। যদি বাংলাদেশ না পেতাম, তাহলে আমাদের হয়তো আধা উর্দু আর আধা বাংলার সংমিশ্রণে এক জগাখিচুড়ি ভাষায় অভ্যস্ত হতে হতো। স্মৃতির পাতায় ভর করে দেখি জেগে ওঠেছে জাতীয়তাবাদী চেতনাও। অবশ্য স্মৃতিই তো গড়ে তোলে একজন মানুষের মানসভুবন। তাই বোধকরি স্মৃতিরা একদমই হারিয়ে যায় না। কোনও না কোনওভাবে ফিরে ফিরে আসে।