কোনো জায়গা সম্পর্কে আগে থেকে জানা-শোনা থাকলে সেখানে যাওয়ার মজা খানিকটা হলেও কমে যায়। একদমই অচেনা কিংবা অজানাকে চেনা বা জানার মজাই আলাদা। তেমন কোথাও যদি যাওয়া যায় এবং যাওয়ার পর যদি দেখা যায়, সেটি প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর, তার সৌন্দর্য ও মুগ্ধতা হৃদয়ে অন্য রকম দোলা দেয়। আর তাতে পাওয়া যায় নতুন কিছু আবিষ্কারের আনন্দও। ভিয়েতনামকে চিনতাম বিপ্লবের পূণ্যভূমি হিসেবে। সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্পর্কে বলতে গেলে তেমন কোনো রকম ধারণাই ছিল না। বরং ভেবেছি, আমেরিকানরা যেহেতু দেশটিকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে, সেখানে ধ্বংসলীলা ছাড়া দেখার মতো আর কিইবা থাকতে পারে? ধারণাটা যে কত বড় ভুল, সেটা সেখানে যাওয়ার পর পলে পলে অনুভব করেছি। ভিয়েতনাম দেশটাই বদলে গেছে অনেক। উন্নয়নের সোপান বেয়ে এগিয়ে চলেছে দ্রুত। আর তার যে প্রকৃতির অবারিত সৌন্দর্যের আকরখনি, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। অল্প সময়ের মধ্যে যা কিছু দেখেছি, তা-ই ধরা দিয়েছে অনন্ত এক বিস্ময় হয়ে। তবে প্রকৃতঅর্থেই বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষা করছিল ভিয়েতনামের পর্যটন কেন্দ্রগুলো। এরমধ্যে মন ছুঁয়ে যায় বুনো সৌন্দর্যের কেন্দ্রস্থল ‘ট্রাঙ অ্যান’। হ্যানয় থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে। মাইক্রোবাসে ঘণ্টা দুয়েকের পথ। এই স্থানটির প্রচার-প্রচারণা খুব একটা না হওয়ায়, তা অনেকটাই ভ্রমণপিয়াসীদের চোখের আড়ালে পড়ে আছে। তবে আস্তে-ধীরে খুলছে এর অবগুণ্ঠন। বাড়ছে পর্যটকদের সংখ্যাও। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট করার জন্যও চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
প্রকৃতির গোপন সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে ট্রাঙ অ্যানে। পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা মসৃণ জলপথ, সবুজ টল টলে পানির বিস্তীর্ণ হ্রদ, চুনাপাথরের নানান আকারের নিস্তব্ধ পাহাড়, বয়ে চলা রঙিন নৌকা, রহস্যময় গুহা, অজানা ফাঁদ, ঐতিহ্যময় রেস্তোরাঁ আর নানান রকম গাছ-গাছালি দিয়ে যেন কোনো চিত্রকর পুরো এলাকাটি সাজিয়ে রেখেছেন। আছে পুরনো মন্দিরও। কোথাও যেন একরত্তি কমতি নেই। সবটাই প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে ভরপুর। আর প্রকৃতির এই ছোঁয়া পেতে হলে নৌকায় করে না ঘুরলে তা অনুভব করতে পারা যায় না। আমি যখন সেখানে ঘুরতে যাই, তখন ছিল বর্ষাকাল। সারা দিনই লেগে ছিল বৃষ্টির উপদ্রব। সাধারণত এই পর্যটনকেন্দ্রটি রূপের পসরা সাজিয়ে খোলতাই হয় শীত ও বসন্তকালে। তখন সেখানে বসে যায় উৎসবের হাট। আমার সেখানে যাওয়া বলা যায় একটু অসময়ে। তারপরও তার রূপমাধুরী আমাকে কম বিহ্বল করেনি। মধ্যাহ্ণ ভোজ সেরে নৌকা ভ্রমণে বের হওয়ার সময় প্রচণ্ড গরমে ঘামছিলাম। মাঝে মাঝে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হলেও তাপমাত্রার মোটেও কমতি ছিল না।
নৌকায় ওঠার পর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় একটি রঙধনু ছাতা, একটি মনোরম পাখা আর রূপবতী একজন গাইড। নৌকার চালকও ছিলেন একজন নারী। তাঁর মাথায় ছিল ভিয়েতনামিস কৃষকদের চির পরিচিত মাথাল। আর মেঘের লুকোচুরি খেলা তো ছিলই। কখনো বৃষ্টি। কখনো রোদ। বেশ একটা রোমান্টিক পরিবেশ। নৌকা ছাড়ার পর দেখতে পেলাম, সারিবদ্ধভাবে বয়ে চলেছে পর্যটকদের অসংখ্য ছোটো ছোটো নৌকার বহর। এতে যে দৃশ্যপট তৈরি হয়, তাতে জুড়িয়ে যায় চোখ। যতই এগিয়ে যেতে থাকি, ততই অবাক হচ্ছিলাম। প্রকৃতির খেয়ালিপনার চমৎকার নিদর্শন উন্মোচিত হচ্ছিল একে একে। পাহাড়ের নিচ দিয়ে সহজাতভাবে গড়ে ওঠেছে টানেলের মতো বিচিত্র সব গুহা। এই ওয়াটার-কেভ-এর উচ্চতা খুব বেশি নয়। একটুখানি অসতর্ক হলেই যে কোনো সময়ই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এ কারণে গুহায় প্রবেশের আগেই নৌকার মাঝি ও গাইড সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য সতর্ক করে দেন।
মাথা নিচু করে গুহা অতিক্রম করতে হয়। তখন সারা দেহ-মনে কেমন যেন রোমাঞ্চকর স্পন্দন হতে থাকে। জীবনে এমন অভিজ্ঞতা খুবই কম এসেছে। অবাক করা এমন বিস্ময়ের সামনে কতক্ষণ আর মাথা নত করে থাকা যায়! একটুখানি সাহস দেখাতে গিয়ে পাহাড়ের পাথরের সঙ্গে ঠোকর খেয়ে একটু-আধটু ভুগতেও হয়েছে। সেটাকে ‘ভালোবাসার ব্যথা’ মনে করা যেতে পারে। তবে গহিন অন্ধকারে কোথাও কোথাও টিম টিম করে জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে হ্যারিকেনের মতো আলো। এক একটি গুহা যেন অপরটিকে হারিয়ে দেওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ। গুহার ভিতর ঢুকলে পাওয়া যায় আদিম যুগের অনুভূতি। কেমন যেন গা ছম ছম করে। একাকী কিংবা দিনের আলো নিভে এলে, সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
দিনের বেলায়ই যেমন ভৌতিক পরিবেশ, রাতের বেলা কেমন হয়, কে জানে? নানান রকম ফাঁক-ফোকর দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়া পানি ভিজিয়ে দিতে থাকে। অবশ্য গরমের মধ্যে শীতল পানির পরশে জুড়িয়ে যায় শরীর। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য ভিয়েতনামের সরকারের উদ্যোগের কমতি নেই। সমাজতান্ত্রিক দেশ হলেও বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকারের উদারতা লক্ষ্য করা যায়। পর্যটকদের মোহিত করার জন্য তাদের চেষ্টায় কোনো ঘাটতি নেই। আর এই উদারতার ভাগিদার হই আমিও। চেরি নামে তরুণী গাইড পাশে থাকায় নৌকাভ্রমণটা হয়ে ওঠে আরো বেশি আনন্দদায়ক। মেয়েটির কর্মক্ষেত্র পর্যটন কর্পোরেশনে। বেশ স্মার্ট। ইংরেজি ভাষাতে বেশ সাবলীল। প্রায় প্রতিদিনই তাঁকে অতিথি পর্যটকদের সঙ্গে নৌকাভ্রমণ করতে হয়। হাস্যোজ্জ্বল এই মেয়েটি পাশে বসে যেভাবে পাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকে, তাতে মনে হয়, আমি যেন তাঁর কত আপনজন। মাঝে-মধ্যে জানাতে থাকে টুকরো টুকরো মজার তথ্য। তাঁর খুনসুটিতে পাওয়া যায় মিষ্টি প্রেমের আমেজ। যদিও ক্ষণিকের জন্য, তারপরও সেই সময়টাতে মনটা কেমন জানি উচাটন করতে থাকে। ইচ্ছে হয় প্রেমের কবিতা আবৃত্তি করতে। পুরো এলাকাটি ঘুরতে হলে হাতে বেশ সময় নিয়ে যেতে হয়। তাছাড়া বর্ষার কারণে অনেক স্থানে যাওয়াও খুবই বিপজ্জনক। পানি বেড়ে যাওয়ায় অনেক ওয়াটার-কেভে যাওয়া যায় না। তবে ট্রাঙ অ্যানের রহস্য এখনও পুরোপুরিভাবে আবিস্কার করা যায়নি। কুমারী তরুণীর মতো অনাঘৃত রয়েছে তার গোপন অনেক সৌন্দর্য। ‘নিউ সেভেন ওয়ান্ডারার্স অব ন্যাচার’-এর অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হা লঙ বে’র পর ভিয়েতনামিজরা গর্ব করেন ‘ট্রাঙ অ্যান’কে নিয়ে। হাজার হাজার বছরের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সেখানে যেন মিলেছে একই বন্ধনে।
নিন বিন প্রদেশের হোয়া লু জেলার বিস্ময়কর এই ভূদৃশ্যসমৃদ্ধ এলাকাটি গড়ে ওঠেছে ২১৬৮ একর জমি নিয়ে। ইকোট্যুরিজম এই এলাকাটি পরিবেষ্টিত চুনাপাথরের পাহাড়, হ্রদ, গুহা আর শত শত ভিন্ন প্রজাতির সমৃদ্ধ ইকোসিস্টেম দিয়ে। বিজ্ঞানীরা এই এলাকাটিকে ‘আউটডোর ভূতাত্ত্বিক জাদুঘর’ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। আর এই জাদুঘরে শোভা পাচ্ছে আশ্চর্য সব বিষয়। এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেছে ৩১টি উপত্যকা, ৫০টি ক্রস-ওয়াটার গুহা, ৬০০ প্রজাতির উদ্ভিদ ও ২০০ রকমের প্রাণী। আছে হরেক রকম পাথর। যা দিয়ে গবেষকরা নিচ্ছেন প্রাকৃতিক ইতিহাসের পাঠ। প্রতিনিয়তই উদঘাটিত হচ্ছে নতুন নতুন সৌন্দর্য। প্রকৃতির এই নন্দনকানন থেকে পড়ন্ত বিকেলে ফিরে আসার সময় দেখতে পাচ্ছিলাম আলো-ছায়ার মায়াবী এক জগতকে। বুকের মধ্যে দুই রকম অনুভূতি হচ্ছিল। একদিকে ভালো লাগার আবেশে বিভোর হয়েছিলাম। অন্যদিকে আর কখনো এখানে আসা হবে কিনা, সে কারণে ছুঁয়ে যাচ্ছিল একটা কষ্টবোধ। সেইসঙ্গে চেরি ফুলের সুরভি তো ছিলই। সব মিলিয়ে বার বার পিছু ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলাম।