পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

মঙ্গলবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৩

ট্রাঙ অ্যান : গোপন সৌন্দর্যের আধার


কোনো জায়গা সম্পর্কে আগে থেকে জানা-শোনা থাকলে সেখানে যাওয়ার মজা খানিকটা হলেও কমে যায়। একদমই অচেনা কিংবা অজানাকে চেনা বা জানার মজাই আলাদা। তেমন কোথাও যদি যাওয়া যায় এবং যাওয়ার পর যদি দেখা যায়, সেটি প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর, তার সৌন্দর্য ও মুগ্ধতা হৃদয়ে অন্য রকম দোলা দেয়। আর তাতে পাওয়া যায় নতুন কিছু আবিষ্কারের আনন্দও। ভিয়েতনামকে চিনতাম বিপ্লবের পূণ্যভূমি হিসেবে। সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্পর্কে বলতে গেলে তেমন কোনো রকম ধারণাই ছিল না। বরং ভেবেছি, আমেরিকানরা যেহেতু দেশটিকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে, সেখানে ধ্বংসলীলা ছাড়া দেখার মতো আর কিইবা থাকতে পারে? ধারণাটা যে কত বড় ভুল, সেটা সেখানে যাওয়ার পর পলে পলে অনুভব করেছি। ভিয়েতনাম দেশটাই বদলে গেছে অনেক। উন্নয়নের সোপান বেয়ে এগিয়ে চলেছে দ্রুত। আর তার যে প্রকৃতির অবারিত সৌন্দর্যের আকরখনি, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। অল্প সময়ের মধ্যে যা কিছু দেখেছি, তা-ই ধরা দিয়েছে অনন্ত এক বিস্ময় হয়ে। তবে প্রকৃতঅর্থেই বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষা করছিল ভিয়েতনামের পর্যটন কেন্দ্রগুলো। এরমধ্যে মন ছুঁয়ে যায় বুনো সৌন্দর্যের কেন্দ্রস্থল ‘ট্রাঙ অ্যান’। হ্যানয় থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে। মাইক্রোবাসে ঘণ্টা দুয়েকের পথ। এই স্থানটির প্রচার-প্রচারণা খুব একটা না হওয়ায়, তা অনেকটাই ভ্রমণপিয়াসীদের চোখের আড়ালে পড়ে আছে। তবে আস্তে-ধীরে খুলছে এর অবগুণ্ঠন। বাড়ছে পর্যটকদের সংখ্যাও। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট করার জন্যও চেষ্টা চালানো হচ্ছে। 
 

প্রকৃতির গোপন সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে ট্রাঙ অ্যানে। পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা মসৃণ জলপথ, সবুজ টল টলে পানির বিস্তীর্ণ হ্রদ, চুনাপাথরের নানান আকারের নিস্তব্ধ পাহাড়, বয়ে চলা রঙিন নৌকা, রহস্যময় গুহা, অজানা ফাঁদ, ঐতিহ্যময় রেস্তোরাঁ আর নানান রকম গাছ-গাছালি দিয়ে যেন কোনো চিত্রকর পুরো এলাকাটি সাজিয়ে রেখেছেন। আছে পুরনো মন্দিরও। কোথাও যেন একরত্তি কমতি নেই। সবটাই প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে ভরপুর। আর প্রকৃতির এই ছোঁয়া পেতে হলে নৌকায় করে না ঘুরলে তা অনুভব করতে পারা যায় না। আমি যখন সেখানে ঘুরতে যাই, তখন ছিল বর্ষাকাল। সারা দিনই লেগে ছিল বৃষ্টির উপদ্রব। সাধারণত এই পর্যটনকেন্দ্রটি রূপের পসরা সাজিয়ে খোলতাই হয় শীত ও বসন্তকালে। তখন সেখানে বসে যায় উৎসবের হাট। আমার সেখানে যাওয়া বলা যায় একটু অসময়ে। তারপরও তার রূপমাধুরী আমাকে কম বিহ্বল করেনি। মধ্যা‎হ্ণ ভোজ সেরে নৌকা ভ্রমণে বের হওয়ার সময় প্রচণ্ড গরমে ঘামছিলাম। মাঝে মাঝে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হলেও তাপমাত্রার মোটেও কমতি ছিল না।


নৌকায় ওঠার পর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় একটি রঙধনু ছাতা, একটি মনোরম পাখা আর রূপবতী একজন গাইড। নৌকার চালকও ছিলেন একজন নারী। তাঁর মাথায় ছিল ভিয়েতনামিস কৃষকদের চির পরিচিত মাথাল। আর মেঘের লুকোচুরি খেলা তো ছিলই। কখনো বৃষ্টি। কখনো রোদ। বেশ একটা রোমান্টিক পরিবেশ। নৌকা ছাড়ার পর দেখতে পেলাম, সারিবদ্ধভাবে বয়ে চলেছে পর্যটকদের অসংখ্য ছোটো ছোটো নৌকার বহর। এতে যে দৃশ্যপট তৈরি হয়, তাতে জুড়িয়ে যায় চোখ। যতই এগিয়ে যেতে থাকি, ততই অবাক হচ্ছিলাম। প্রকৃতির খেয়ালিপনার চমৎকার নিদর্শন উন্মোচিত হচ্ছিল একে একে। পাহাড়ের নিচ দিয়ে সহজাতভাবে গড়ে ওঠেছে টানেলের মতো বিচিত্র সব গুহা। এই ওয়াটার-কেভ-এর উচ্চতা খুব বেশি নয়। একটুখানি অসতর্ক হলেই যে কোনো সময়ই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এ কারণে গুহায় প্রবেশের আগেই নৌকার মাঝি ও গাইড সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য সতর্ক করে দেন।


মাথা নিচু করে গুহা অতিক্রম করতে হয়। তখন সারা দেহ-মনে কেমন যেন রোমাঞ্চকর স্পন্দন হতে থাকে। জীবনে এমন অভিজ্ঞতা খুবই কম এসেছে। অবাক করা এমন বিস্ময়ের সামনে কতক্ষণ আর মাথা নত করে থাকা যায়! একটুখানি সাহস দেখাতে গিয়ে পাহাড়ের পাথরের সঙ্গে ঠোকর খেয়ে একটু-আধটু ভুগতেও হয়েছে। সেটাকে ‘ভালোবাসার ব্যথা’ মনে করা যেতে পারে। তবে গহিন অন্ধকারে কোথাও কোথাও টিম টিম করে জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে হ্যারিকেনের মতো আলো। এক একটি গুহা যেন অপরটিকে হারিয়ে দেওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ। গুহার ভিতর ঢুকলে পাওয়া যায় আদিম যুগের অনুভূতি। কেমন যেন গা ছম ছম করে। একাকী কিংবা দিনের আলো নিভে এলে, সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।


দিনের বেলায়ই যেমন ভৌতিক পরিবেশ, রাতের বেলা কেমন হয়, কে জানে? নানান রকম ফাঁক-ফোকর দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়া পানি ভিজিয়ে দিতে থাকে। অবশ্য গরমের মধ্যে শীতল পানির পরশে জুড়িয়ে যায় শরীর। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য ভিয়েতনামের সরকারের উদ্যোগের কমতি নেই। সমাজতান্ত্রিক দেশ হলেও বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকারের উদারতা লক্ষ্য করা যায়। পর্যটকদের মোহিত করার জন্য তাদের চেষ্টায় কোনো ঘাটতি নেই। আর এই উদারতার ভাগিদার হই আমিও। চেরি নামে তরুণী গাইড পাশে থাকায় নৌকাভ্রমণটা হয়ে ওঠে আরো বেশি আনন্দদায়ক। মেয়েটির কর্মক্ষেত্র পর্যটন কর্পোরেশনে। বেশ স্মার্ট। ইংরেজি ভাষাতে বেশ সাবলীল। প্রায় প্রতিদিনই তাঁকে অতিথি পর্যটকদের সঙ্গে নৌকাভ্রমণ করতে হয়। হাস্যোজ্জ্বল এই মেয়েটি পাশে বসে যেভাবে পাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকে, তাতে মনে হয়, আমি যেন তাঁর কত আপনজন। মাঝে-মধ্যে জানাতে থাকে টুকরো টুকরো মজার তথ্য। তাঁর খুনসুটিতে পাওয়া যায় মিষ্টি প্রেমের আমেজ। যদিও ক্ষণিকের জন্য, তারপরও সেই সময়টাতে মনটা কেমন জানি উচাটন করতে থাকে। ইচ্ছে হয় প্রেমের কবিতা আবৃত্তি করতে। পুরো এলাকাটি ঘুরতে হলে হাতে বেশ সময় নিয়ে যেতে হয়। তাছাড়া বর্ষার কারণে অনেক স্থানে যাওয়াও খুবই বিপজ্জনক। পানি বেড়ে যাওয়ায় অনেক ওয়াটার-কেভে যাওয়া যায় না। তবে ট্রাঙ অ্যানের রহস্য এখনও পুরোপুরিভাবে আবিস্কার করা যায়নি। কুমারী তরুণীর মতো অনাঘৃত রয়েছে তার গোপন অনেক সৌন্দর্য। ‘নিউ সেভেন ওয়ান্ডারার্স অব ন্যাচার’-এর অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হা লঙ বে’র পর ভিয়েতনামিজরা গর্ব করেন ‘ট্রাঙ অ্যান’কে নিয়ে। হাজার হাজার বছরের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সেখানে যেন মিলেছে একই বন্ধনে।


নিন বিন প্রদেশের হোয়া লু জেলার বিস্ময়কর এই ভূদৃশ্যসমৃদ্ধ এলাকাটি গড়ে ওঠেছে ২১৬৮ একর জমি নিয়ে। ইকোট্যুরিজম এই এলাকাটি পরিবেষ্টিত চুনাপাথরের পাহাড়, হ্রদ, গুহা আর শত শত ভিন্ন প্রজাতির সমৃদ্ধ ইকোসিস্টেম দিয়ে। বিজ্ঞানীরা এই এলাকাটিকে ‘আউটডোর ভূতাত্ত্বিক জাদুঘর’ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। আর এই জাদুঘরে শোভা পাচ্ছে আশ্চর্য সব বিষয়। এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেছে ৩১টি উপত্যকা, ৫০টি ক্রস-ওয়াটার গুহা, ৬০০ প্রজাতির উদ্ভিদ ও ২০০ রকমের প্রাণী। আছে হরেক রকম পাথর। যা দিয়ে গবেষকরা নিচ্ছেন প্রাকৃতিক ইতিহাসের পাঠ। প্রতিনিয়তই উদঘাটিত হচ্ছে নতুন নতুন সৌন্দর্য। প্রকৃতির এই নন্দনকানন থেকে পড়ন্ত বিকেলে ফিরে আসার সময় দেখতে পাচ্ছিলাম আলো-ছায়ার মায়াবী এক জগতকে। বুকের মধ্যে দুই রকম অনুভূতি হচ্ছিল। একদিকে ভালো লাগার আবেশে বিভোর হয়েছিলাম। অন্যদিকে আর কখনো এখানে আসা হবে কিনা, সে কারণে ছুঁয়ে যাচ্ছিল একটা কষ্টবোধ। সেইসঙ্গে চেরি ফুলের সুরভি তো ছিলই। সব মিলিয়ে বার বার পিছু ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলাম।

হো চি মিনের দেশে


বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম বিপ্লবী নেতা হো চি মিনের দেশ ভিয়েতনাম নিয়ে আছে একটা রোমান্টিক আবেগ। হৃদয়ে দাগ কেটে আছে আমেরিকানদের বিপক্ষে ভিয়েতনামিদের গেরিলাযুদ্ধ। উত্তর ভিয়েতনামের প্রায় প্রতি ইঞ্চি জমিতে বোমা ফেলার পরও মার্কিনীদের পরাজয় ইতিহাসের একটি বড় শিক্ষা হয়ে আছে। পরাক্রমশালী হলেই যে কোনো দেশ দখল করা যায় না, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে ভিয়েতনামিরা। তাদের এই শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ে দেশে দেশে। অনুপ্রাণিত হয়েছে বাংলাদেশও। এ কারণে ছোট বেলা থেকে দেয়াল লিখনে দেখেছি কিংবা মিছিলের শ্লোগানে শুনেছি, ‘....... পরিণাম, বাংলা হবে ভিয়েতনাম’। কিন্তু কখনোই ভাবিনি বিপ্লবী এই দেশটিতে যাওয়ার কথা। আর বর্ষা মৌসুমে তো নয়ই। ছিচকাঁদুনে বৃষ্টির মধ্যে কে আর সেখানে ঘুরতে যায়? ঘটনাচক্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটিতে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যখন গেলাম, মনটা আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত দেশটি এখন অনেক বদলে গেছে। কোথাও ধ্বংসের ছোঁয়া নেই। যেন ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠেছে সমাজতান্ত্রিক এই প্রজাতন্ত্রটি। কৃষি প্রধান দেশটি এখন বাজার অর্থনীতির দিকে হাত বাড়িয়েছে। মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে ভিয়েতনামের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে। এশিয়ার নতুন অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তুলছে নিজেদের।


রাজধানী হ্যানয়ে পা দিয়ে সবার আগে দৃষ্টি কেড়ে নেয় মেয়েদের অবাধ স্বাধীনতা। তারা যেন মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ছেন। চলাচলের প্রধান বাহন মোটর সাইকেল ও ভেসপা। সমস্ত পথজুড়ে তাদের অবারিত দাপট। বড় যানবাহন খুব একটা দেখা যায় না। যানজটও নেই। মোটর সাইকেল ও ভেসপা চালকদের বড় একটা অংশই মেয়েরা। এমনকি তাদের পেছনে দিব্যি বসে থাকেন ছেলেরা। রাত অব্দি স্বাচ্ছন্দে ও সাবলীলভাবে মেয়েদের চলাচল। পোশাক-আশাকেও মেয়েরা যথেষ্ট ফাস্ট ও ফ্যাশনেবল। হট প্যান্ট আর স্লিভলেস জামা গায়ে দিব্যি ছুটছেন। জানতে পারলাম, মেয়েদের এই স্বাধীনতাই ভিয়েতনামকে এগিয়ে নেওয়ার অন্যতম চাবিকাঠি। যুদ্ধের সময়ও মেয়েদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। ভিয়েতনামের আবহাওয়া ও প্রকৃতি অনেকটাই বাংলাদেশের মতো। বর্ষাকালে এই রোদ, এই বৃষ্টি। গরমও একই রকম।

গাছ-গাছালি, ফুল-পাখিরও যথেষ্ট সামঞ্জস্য আছে। শহরের রাস্তায় শোভা বর্ধন করছে কৃষ্ণচুড়া, হিজল-তমাল জাতীয় পরিচিত গাছ। জিনিস-পত্রের দামও অনেকটাই আমাদের দেশের মতো। তবে কারো যদি কোটিপতি হতে না পারার আক্ষেপ থেকে থাকে, তার সেই মনোবাসনা সহজেই পূরণ করা সম্ভব ভিয়েতনামে গিয়ে। এক মার্কিন ডলার ভাঙালেই পাওয়া যায় ২০ হাজারেরও বেশি ভিয়েতনামিজ ডঙ। তবে কেনাকাটি করতে গেলে চোখের পলকেই উড়ে যায় লাখ লাখ ডঙ। আসলে এই পৃথিবীটা আর কতটুকুবা চিনি? সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সৌন্দর্য আর বিস্ময়। ভিয়েতনামও প্রাকৃতিক রুপ-রস থেকে বঞ্চিত হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তা তাদের দিয়েছেন অকৃপণভাবে। তাদের আছে হা লঙ বে’র মতো প্রাকৃতির সৌন্দর্যের লীলাভূমি। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে প্রিয় এই গন্তব্যটি। ‘নিউসেভেনওয়ান্ডার্স অব নেচার’-এর একটি এই পর্যটনকেন্দ্রে না গেলে ভিয়েতনাম সফরই বৃথা হয়ে যেত। এজন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের যুগ্ন-সচিব জনাব এ টি এম মোস্তাফিজুর রহমানকে। তাঁরই আগ্রহ ও উৎসাহে সেখানে যাওয়া। হ্যানয় থেকে প্রায় চার ঘন্টার বাস জার্নি করে যখন হা লঙ বে’তে পৌঁছালাম, আমার জন্য অপেক্ষা করছিল অবাক করা এক পৃথিবী। প্রকৃতির এক অনুপম ও বিস্ময়কর নিদর্শন উন্মোচিত হয় আমার চোখে। যাওয়ার পথে দেখতে পেলাম ভিয়েতনামের ঘর-বাড়ি, জীবনযাত্রার চলমান ছবি। হাইরাইজ বিল্ডিং খুব একটা নেই। বাড়ি-ঘর গড়ে ওঠেছে ছোট ছোট পরিসরে। এ ক্ষেত্রে মনে হলো সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।


পথিমধ্যে আমাদের বাস কিছুক্ষণের জন্য যেখানে থামানো হয়, সেটা ছিল কুটিরশিল্পের প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র। বিশেষ করে চিনামাটির আকর্ষণীয় তৈজসপত্র সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয়। পর্যটকরা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে লুফে নিচ্ছিলেন কিছু না কিছু। কুয়াঙ নিন প্রদেশের বাই চে ট্যুরিস্ট জাহাজঘাট থেকে তপ্ত রোদ মাথায় নিয়ে ছোট স্টিমারে করে মেকং নদী দিয়ে যেতে থাকি হা লঙ বে। গরমের তাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পর্যটকদের কাছে আর্কষণীয় হয়ে ওঠে কৃষকদের মাথাল, ভিয়েতনামি ভাষায় বলা হয়, ‘নন’। চারপাশের দৃশ্য ভরিয়ে দিচ্ছিল মুগ্ধতায়। পেশাদার গাইডের বর্ণনায় জানতে পারছিলাম ইতিহাসের নানান আখ্যান। মাঝপথে সামুদ্রিক মাছ দিয়ে জম্পেশ মধ্যাহ্নভোজ। খাবারের স্বাদ আমাদের দেশের মতোই। তবে তেল-ঝালের অতিশয়োক্তি নেই। এ কারণে কিনা জানি না, মোটাসোটা কোনো ভিয়েতনামি একদমই চোখে পড়েনি। বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠেছে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হা লঙ বে। দেড় সহস্রাধিক কিলোমিটার নিয়ে এলাকাটি। তাতে আছে প্রায় হাজার দুয়েক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ। এই দ্বীপগুলোকে চুনাপাথরের খনি বললে অত্যুক্তি হবে না। নানান আকারের। নানান গড়নের। ভিয়েতনামজুড়ে যে ক্রিস্টালের রমরমা, তার উৎস হলো এই হা লঙ বে। সাধারণত তিন কিংবা সাত দিনের প্যাকেজ প্রোগ্রামে পর্যটকরা সেখানে ব্যাগ-বোচকা নিয়ে ঘাটি গাড়েন। না হলে এর সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করা যায় না। আমরা যেহেতু দিনে দিনে আবার ফিরে আসি, তাই সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্পটসমূহ ছিল আমাদের টার্গেট। সবুজ পানি। সবুজ পাহাড়। সবুজে মোড়া হা লঙ বে। পানি পরিবেষ্টিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র পাহাড়। নানান আকারের। ‘দ্য কিসিং রকস’ দেখে মনে হলো, গভীর ভালোবাসা নিয়ে একে অপরের দিকে ঝুঁকে আছে দু’টি পাহাড়। একটি পাহাড় দেখতে অবিকল একটি মুরগীর মতো। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম একটি ব্রিজ। গাইড জানালেন, এটির নাম ‘লাভব্রিজ’। প্রতি বছর অনেক তরুণ-তরুণী ভালোবাসার জন্য এই ব্রিজ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। আমাদের প্রথমে নিয়ে যাওয়া হলো ভাসমান জেলে গ্রামে। বেশ কিছু জেলে পরিবার সেখানে ঠাঁই করে নিয়েছেন। নৌকার মধ্যে তাদের থাকা-খাওয়া। আমরাও ঘুরতে বের হই ভাড়া করা নৌকায়। বিপদের ঝুঁকি থাকায় আমাদেরকে পরানো হয় লাইফ জ্যাকেট। প্রচণ্ড গরম। দর দর করে ঘামছিলাম। রোদের তাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রত্যেককে একটি করে ছাতা দেওয়া হয়। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখতে পাই ‘ভূগর্ভস্থ নদী’।


পাহাড়ের নিচ দিয়ে চলে গেছে গুহার মতো পথ। প্রাকৃতিকভাবে সহজাতভাবে গড়ে ওঠেছে এটি। সেই গুহার মধ্যে দিয়ে আমাদের নৌকা ঢুকে পড়ে। সে এক শিহরণজাগানো অনুভব ও অনুভূতি। চারপাশে পাহাড় দিয়ে ঘেরা জলভাগ। শীতল আমেজ পেতে থাকি। পানি বেড়ে গিয়ে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেলে এখান থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে কেউ কখনো ‘প্রাকৃতিক এই জেলখানা’য় আটকা পড়েছেন কিনা জানতে পারিনি। স্টিমারে ফিরে আসার পর আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় গুহার রঙের ভুবন ‘থিয়েন কাঙ’য়ে। কিছুটা বিপজ্জনক সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে আমরা প্রবেশ করি ‘রঙধনু গুহা’য়। মনে হলো, আমরা যেন কোনো চিত্রকলা প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছি। পাহাড়ের গুহার মধ্যে প্রকৃতি যে এমনভাবে চিত্রকলা সাজিয়ে রেখেছে, এটা না দেখলে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না।


ফাঁক-ফোকর দিয়ে আসা আলোয় গুহার ভিতরে নির্মিত হয়েছে বর্ণিল ও রঙিন জগত। কখনো-সখনো ভুলবশত মনে হয় অ্যাকুরিয়াম। চোখ ও মন জুড়িয়ে যায়। দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে বেশ দীর্ঘ গুহা। ঝিরি ঝিরি পানি আমাদের গায়ে পড়তে থাকলে বেশ মজাই লাগে। প্রাকৃতিক এই চিত্রকলা জাদুঘরে আছে হরেক রকম ভাস্কর্যও। পাথর ও মাটি দিয়ে গড়া। অনেক অবয়ব ও কাঠামো এমনভাবে গড়ে ওঠেছে, তা নিয়ে আছে নানান লৌকিক উপাখ্যান। অধিকাংশই কাহিনী ড্রাগন কিংকে নিয়ে। আছে অনেক প্রেম কাহিনীও। আর এমন অনেক কিছুই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর হা লঙ বে’র পরতে পরতে। সে আকর্ষণকে পেছনে ফেলে আমরা ফিরতে থাকি গন্তব্যে। গোধূলিলগ্নে হা লঙ বে’কে মনে হচ্ছিল চোখজুড়ানো একটি ভিউকার্ড।

শনিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১৩

সেই স্মৃতি, সেই ছবি


১. প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে যখন শের-এ-বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কথা হচ্ছিল, তখন খুব একটা স্বস্তিতে ছিলাম না। না থাকার অন্যতম কারণ, সিনিয়র ভাইদের কাছে জানতে পারি, স্কুলের শিক্ষকরা নাকি খুবই কঠোর। ছাত্রদের শাসন করেন কড়া হাতে। একজন শিক্ষক আছেন, কোনো ছাত্র বেগড়বাই করলে তিনি নাকি শরীর থেকে রক্ত না ঝরানো পর্যন্ত ক্ষান্ত হন না। অনবরত পেটাতেই থাকেন। রক্ত বের হওয়ার পর ক্লাসের দেয়ালকে ক্যানভাস বানিয়ে সেই রক্ত দিয়ে ছবি আঁকাতেন। যাতে রক্তে আঁকা সেই ছবি দেখে অন্যরা সাবধানে হয়ে যায়। এমন ভীতিকর কথা আগে-ভাগেই যদি কানে ভাসতে থাকে, তাহলে কে আর সেই স্কুলে যেতে চায়? কিন্তু না গিয়েও তো উপায় ছিল না। তখন তো বাসার কাছের স্কুল ছাড়া দূরের কোনো স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা সাধারণত কেউ ভাবতেই পারতো না। অভিভাবকরা সেটা চাইতেনও না। তাছাড়া বর্তমান সময়ের মতো বেসরকারি স্কুলের এত রমরমা ছিল না। অগত্যা, জেনে-শুনে বিষ পান করতেই হতো। তবে এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর আমার মতো কেউ কেউ পেয়েছিল ‘স্বাধীনতা’ অর্জনের আনন্দ। ঘটনাচক্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শেষ তিনটি বছর আমাকে ক্লাস করতে হয় বাসার পাশের শের-এ-বাংলা নগর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে। আমি ভুল লিখছি না। হ্যাঁ, বালিকা বিদ্যালয়েই কেটেছে কৈশোরের অনেকগুলো দিন। নারী রাজত্বে সংখ্যালঘু হয়ে থাকার কি যে যন্ত্রণা, সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছিলাম। স্কুলে যতক্ষণ থাকতাম, ততক্ষণ রোবটের মতো বসে থাকতাম। মনের সুখে হৈ-হুল্লোড় করার সুযোগ ছিল না। পান থেকে একটুখানি চুন খসলেই নেমে আসতো শাস্তির খড়গ। অথচ সহপাঠী মেয়েরা ইচ্ছেমতো ঘুরতে পারতো। ছুটতে পারতো। এমনকি চাইলে ডানা মেলেও উড়তে পারতো। আর সেটা দেখে বুকের মধ্যে বইতো দীর্ঘশ্বাস। পলে পলে অনুভব করতাম, পরাধীনতার গ্লানি। মনে মনে ভাবতাম, ওরা পারলে আমরা কেন তাদের মতো চলতে-ফিরতে-ঘুরতে পারি না?
সেই বয়সে তো আর এই ‘বৈষম্য’র কারণ বুঝতে পারতাম না। এখনকার জেনারেশনের মতো চালাক-চতুরও ছিলাম না। তাই সব কিছু হজম করতাম নীরবে। যে কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সীমানা অতিক্রম করার পর মনে হতে থাকে, যেন ‘কারাগার’ থেকে মুক্তি পেয়েছি। আসলেই সেটা ছিল বাঁধনছেঁড়া মুক্তির আনন্দ। ১৯৭৬ সালে শের-এ-বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার পর মনে হতে থাকে, শুরু হলো জীবনের নতুন অধ্যায়। ভর্তি হওয়ার আগেই সিনিয়র ভাইরা বুকের মধ্যে যে ভীতির সঞ্চার করে দেন, তা ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে। হাইস্কুলের ছাত্র হওয়ার একটা আত্মতৃপ্তি তো ছিলই। খুব সহজেই স্কুলটির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে মোটেও বেগ পেতে হয়নি। তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই তো লাল ইটের এই স্কুলটিকে দেখে আসছি। সে কারণে আগে থেকেই একটা মানসিক সখ্যতা ছিল। একদিন এই স্কুলের ছাত্র হবো, সেটাও তো মনের মধ্যে ছিল। এ কারণে স্কুলে পা দিয়ে মনে হতে থাকে, আরে, এ তো আমার নিজেরই স্কুল। স্কুলের পরিবেশও খুবই আপন মনে হয়। সব মিলিয়ে বুকের মধ্যে উড়তে থাকে রঙ-বেরঙের ঘুড়ি। তার মানে এই নয় যে, আমরা মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে ছুটেছি। যা কিছু করেছি, সবটাই স্কুলের সীমানার মধ্যেই। তখন স্কুলের চারপাশে ইট-বালু-সিমেন্টের বাউন্ডারি না থাকলেও অলিখিত একটা বাউন্ডারির মধ্যেই আমরা আবদ্ধ থাকতাম। পারতপক্ষে সেই বাউন্ডারি আমরা লংঘন করতাম না। করলেও শিক্ষকদের চোখ ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। যে কারণে অবাধ্য হওয়া কিংবা ভুল পথে পা বাড়ানোর ঘটনা খুব একটা ঘটতো না। শিক্ষকরা অভিভাবকের মতো একদিকে যেমন শাসন করতেন, অন্যদিকে আবার ভালোও বাসতেন। ক্লাসে পড়া না পারলে, হোমওয়ার্ক ঠিকমতো না করে আনলে কিংবা কোনো অন্যায় করলে শিক্ষকরা কোনো ছাড় দিতেন না। শিক্ষকদের ভয়ে আমরা তটস্থ থাকতাম। তারপরও যে সবাই সুবোধ বালক হয়ে থাকতো, সেটাও বলা যাবে না। কেউ না কেউ তো নিয়ম ভেঙেই মজা পেতো। সংগত কারণে পেতে হতো সাজাও।
এক এক জন্য শিক্ষকের শাস্তি প্রদানের কায়দা ছিল এক এক রকম। ছোট-খাট গড়নের বাংলার মফিজ স্যার যাকে সাজা দিতেন, তার মাথা নীচের দিকে নামিয়ে এনে পিঠে কনুই দিয়ে এমনভাবে গুঁতা মারতেন, সেই ব্যথা সপ্তাহখানেকের আগে সারতো না। অঙ্কের কোঁকড়া চুলের আবুল বাশার স্যার লাঠি দিয়েই মারতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। লাঠি ভাঙলে তিনি মনে করতেন, ঠিকমতো শাস্তি দেওয়া হলো। ইংরেজির রাগী চেহারার রফিক স্যারের চড়ের ওজন ছিল কমছে কম সোয়া সের। মারার সময় তিনি ডাস্টারও কাজে লাগাতেন। কোনো ক্লাসের কোনো ছাত্র যদি দুষ্টুমি করতো, বাংলা ব্যাকরণের মোটা-সোটা দেহের সিদ্দিকুর রহমান স্যার সেই ছাত্রকে চিহ্ণিত করতে না পারলে, সবাইকে গণহারে বেঞ্চের ওপর দাঁড় করাতেন। ভালো ছাত্র কিংবা মন্দ ছাত্রের কোনো বিভাজন করতেন না। সবার হাতে একটা করে করে বেত মেরে তিনি তৃপ্তি পেতেন। ইংরেজির হালকা-পাতলা গড়নের মোখলেস স্যার ছিলেন খুবই শান্ত-শিষ্ট। শারীরিকভাবে তিনি কিছুটা অসুস্থ ছিলেন। এ কারণে একটু বাঁকা হয়ে হাঁটতেন। কিন্তু একবার যদি তিনি কোনো ছাত্রের ওপর রেগে যেতেন, সেদিন সেই ছাত্রের খবর হয়ে যেত। বেত দিয়ে মারতেই থাকতেন। সহজে থামতেন না। অসুস্থতার কারণে একটানা মারতে পারতেন না। দম নিয়ে থেমে থেমে মারতেন। দশম শ্রেণীর ইংরেজির শিক্ষক শামসুল হক স্যার পড়া না পারলে হাসতে হাসতে পেটের চামড়া ধরে এমন মোচড় দিতেন, পড়া না শিখে কেউ তাঁর পরের ক্লাসে আসতো না। তবে বেশি মজা হতো ইকবাল স্যারকে নিয়ে। তিনি পড়াতেন রসায়ন। খুবই মেধাবী ছিলেন। কেন জানি না, বেশি মেধাবীরা সাধারণত একটু অন্য রকম হয়। ইকবাল স্যার ছিলেন অনেকটাই অ্যাবসেন্ড মাইন্ডেড। এই জগত যেন তাঁর নয়। তাঁকে দেখে মনে হতো, তিনি যেন বিচরণ করছেন অন্য কোনো জগতে। এই কারণে তাঁর এই সরলতার সুযোগ নিতেন ক্লাসের দুষ্টু ছেলেরা। কেউ কেউ ইচ্ছে করেই স্যারকে বিরক্ত করতেন। বিরক্তি করার কত রকম কৌশল যে প্রয়োগ করা হতো, সেটা আর নাইবা লিখলাম। কিন্তু স্যার কখনোই দুষ্ট ছাত্রকে সনাক্ত করতে পারতেন না। তখন তাঁর যাকে সন্দেহ হতো, তাকেই তিনি পিটাতেন। কেউ তাঁর ভুল ধরিয়ে দিলে তাকেও ছাড় দিতেন না। এ কারণে ভালো ছাত্ররাও তাঁর হাত থেকে রেহাই পেতো না। পরীক্ষার আগে স্যারের কাছে সাজেশন চাইলে সহসা সেটা তিনি দিতে চাইতেন না। সবাই সম্মিলিতভাবে অনুরোধ জানালে তখন বোধকরি তাঁর মন খানিকটা নরম হয়ে যেত। তাঁর সাজেশন দেওয়ার ধরন ছিল অন্যদের চেয়ে একদমই আলাদা। কোনো চ্যাপ্টারে হয়তো ১০টি প্রশ্ন। তিনি একটি কিংবা দু’টি প্রশ্ন বাদ দিয়ে বাদবাকি প্রশ্নগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে সাজেশন দিতেন। তখন কেউ কেউ ফাজলামি করে স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতো, স্যার দু’টি প্রশ্ন বাদ পড়েছে। অমনি স্যার রেগে যেতেন। তবে স্যার পড়াতেন মন দিয়ে। তিনি এমনভাবে পড়তেন, যাতে ছাত্রদের বুঝতে কোনো সমস্যা না হয়। এ কারণে তিনি প্রাইভেট পড়ানোর পক্ষপাতি ছিলেন না।
স্যাররা মারধর করলেও আদরও করতেন। ছাত্রদের বুক দিয়ে আগলে রাখতেন। জীববিজ্ঞানের জাহিদ স্যার ছিলেন অসম্ভব সাহসী। একবার আন্তঃ স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় আমাদের স্কুলের খেলা পড়ে মোহাম্মদপুর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে। খেলার এক পর্যায়ে গণ্ডগোল বেধে যায়। মোহাম্মদপুরের স্কুলের ছাত্ররা লাঠি-সোটা নিয়ে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন জাহিদ স্যার বলতে গেলে সব ছাত্রকে একাই বুক দিয়ে আগলে রাখেন। নতুবা বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো। স্যারদের এই আন্তরিকতা, এই ভালোবাসা, এই আত্মত্যাগের কারণে শের-এ-বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রদের অনেকেই আজ নানানভাবে প্রতিষ্ঠিত। চারিদিকেই ছড়িয়ে পড়েছে স্কুলের সুনাম ও সুখ্যাতি। এটা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য গর্ব ও আনন্দের।
 
২. ১৯৮১ সালে এসএসসি পাস করার পর স্কুলের সঙ্গে ছিন্ন হয়ে যায় প্রাত্যহিক বন্ধন। বলতে গেলে এরপর স্কুলে আর যাওয়া হয়নি। সহপাঠী বন্ধুদের কারো সঙ্গেই তেমনভাবে যোগাযোগ নেই। ছিন্ন ফুলের মালার মতো আমরা ছড়িয়ে পড়ি নানান দিকে। অনেকেই তো দেশের সীমানা ছাড়িয়ে স্থায়ীভাবে চলে গেছে কোন সুদূরে। আর যারা দেশে আছে, তারা তো কাছে থেকেও যেন কত দূরে। জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ে সবাই কম-বেশি এতটাই ব্যতিব্যস্ত, দেখা-সাক্ষাৎ করার সুযোগই হয় না। এমনকি হয় না একটু হাই-হ্যালোও করাও। সেটা হবে কী করে? পাশ দিয়ে চলে গেলেও হয়তো আমরা কেউ কাউকে চিনতে পারছি না। হায়, জীবন কেন এমন? যারা ছিল খুব কাছের, তারাই হয়ে গেছে অনেক দূরের। এর কোনো হিসাব আমি মিলাতে পারি না। তখন খুব অসহায় লাগে। বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে কষ্টের জলপ্রপাত।
কণ্ঠে বাজে সায়ানের গান,
 কেন বাড়লে বয়স ছোট্টবেলার বন্ধু হারিয়ে যায়
কেন হারাচ্ছে সব বাড়াচ্ছে ভিড় হারানোর তালিকায়।
আজ কে যে কোথায় আছি কোনো খবর নেই তো কারো
অথচ তোর ঐ দুঃখগুলোতে অংশ ছিল আমারও।
............................. দ্যাখ্ নীল নীল নীল আকাশের মতো অনন্ত হাহাকার
আজ বুকের ভিতর ভাঙছে ভাঙছে ভেঙে সব চুরমার।
 কোনো শত্রুরও যেন প্রাণের বন্ধু এমন দূরে না যায় শোনো
বন্ধু কখনো কোনো বন্ধুকে বলো না যেন বিদায়।
 জীবনের সেরা সময়ে, পাঁচটি বছর একই চত্বরে আমরা হেসে-খেলে কাটিয়েছি, ভাগ করে নিয়েছি যাবতীয় সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, সেই আমরাই পরস্পরের কাছ থেকে হয়ে পড়েছি বিচ্ছিন্ন। আমার কাছে এটা খুব কষ্টকর মনে হয়। জানি না, আমাদের স্কুলের সেই বন্ধুদের বুকের মধ্যে এই কষ্টটা কখনো দোলা দেয় কিনা? তবে আমরা খুবই সৌভাগ্যবান যে, এসএসসি পরীক্ষার আগে আমাদের ব্যাচের একটি গ্রুপ ছবি তোলা হয়। সাদা-কালো দুর্লভ সেই ছবিটিতে ধরা আছে আমাদের সেই উজ্জ্বল সময়খণ্ড। ছবিতে সবাই নেই। যারা আছে, তাদের অনেককেই এখন দেখলে হয়তো চিনতে পারবো না। মিলাতেও পারবো না মনের সঙ্গে মন। সময় নামক অন্তহীন স্রোত আমাদের মধ্যে গড়ে দিয়েছে বিশাল ব্যবধান। কিন্তু ছবিটা দেখলে অনুধাবন করতে পারি সেই সময়টাকে, সেই বয়সটাকেও। বন্ধুত্বের অমলিন স্মৃতির প্রতীক হয়ে আছে এই ছবিটা। স্কুল জীবনের কথা মনে পড়লে এই ছবিটা দেখি ফিরে ফিরে। সেইসঙ্গে মনে পড়ে যায় জীবনের সোনালি দিনগুলোর কথা। তাই তো এখনও স্বপ্ন দেখি, স্কুলের সেই বন্ধুদের নিয়ে। কেউ যদি কবীর সুমনের মতো ‘হঠাৎ রাস্তার অফিস অঞ্চলে’ কিংবা ‘হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিয়ে বলে’ ‘বন্ধু, কী খবর বল? কত দিন দেখা হয়নি.....’ আমি তো সেই দিনটির অপেক্ষায় আছি।
 
(শের-এ-বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯৮১ সালের এসএসসি ব্যাচের ছাত্র।)