মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি
এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

রবিবার, ১ এপ্রিল, ২০১৮
বুধবার, ১৪ মার্চ, ২০১৮
তোমার দেওয়া গিফটগুলো
সোমবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮
তারে বুঝিতে পারি নি
এরআগেও তো কত কবির কত কবিতা পড়েছি। কত রকম অনুভূতি হয়েছে। কখনও ইচ্ছে হয়েছে উড়তে। কখনও মন চেয়েছে প্রেমে পড়তে। কখনও উদাসী হয়েছি। কখনও নিছকই চুপচাপ বসে থেকেছি। কখনও নাম না জানা কোনো অচিনপুরে হারিয়ে গিয়েছি। কিন্তু এমন তো কখনও হয় নি। এ কেমন অনুভূতি? আমি ঠিক বুঝতে পারি না। কেমন বিবশ বিবশ লাগে। মেয়েরা প্রথম ঋতুমতী হলে কি এমন অনুভূতি হয় কিংবা প্রথম প্রেমে পড়লে কি এমন লাগে? না বোধহয়। এরসঙ্গে যেন কিছুই মেলে না। মিলতে পারে না। এ এক ব্যাখ্যাতীত অনভূতি। কোনও কিছুর সঙ্গে তুলনীয় নয়।
এই কবিতা পড়লে বোধের মধ্যে কেমন কেমন করে। ‘আরো এক বিপন্ন বিস্ময়/আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে/খেলা করে’। এর উপমা, এর উৎপ্রেক্ষা, এর চিত্রকল্প একদমই অন্যরকম। কেমন যেন আবেশ ছড়িয়ে দেয়। আচ্ছন্ন করে রাখে। ডুবিয়ে দেয় আলো-আঁধারির মায়াবী এক জগতে। অন্ধকারে হারিয়ে যেতে যেতে কখনো কখনো দেখা যায় আলোর রেখা। চেতন আর অবচেতনায় কী যেন দোলা দিয়ে যায়। বেঁধে ফেলে মায়াঘোরে। অনুভূতির তারে তারে বাজতে থাকে নানান সুর। কখনও ছুঁয়ে যায় বেদনা। কখনও বিষণ্নতা। মৃত্যুচেতনাও নয় কি?
এমন লোকাতীত পংক্তি যাঁর অনুভূতিতে সংকুলান হয়েছে, তাঁকেও তো ধরা যায় না। ছোঁয়া যায় না। কোনও নির্দিষ্ট ছকে আবদ্ধ রাখা যায় না। তিনি বরাবরই অধরা হয়ে আছেন। যেন অলীক এক ভুবনের বাসিন্দা। বিচরণ করেছেন স্বপ্নালোকে। চির রহস্যময়তা যাঁর কবিতায় এবং যাঁকে ঘিরে রেখেছে অদ্ভুত এক আঁধার, তিনি জীবনানন্দ দাশ। জীবনে যেমন তিনি দুর্বোধ্য থেকেছেন, মৃত্যুতেও হয়ে আছেন বোধাতীত। তাঁকে ঠিক বুঝতে পারা যায় না। কিন্তু তাঁকে নিয়ে কৌতূহল কখনও নিবৃত্ত হয় না।
তাঁর কবিতা পড়ার পর কিছুই যেন বোঝা যায় না। কেমন অবোধ্য থেকে যায়। দুরূহ দুরূহ লাগে। ধোঁয়ার মতো অস্পষ্ঠ হয়ে ওঠে। মরীচিকার মতো শূন্যে মিলিয়ে যায়। তবুও বার বার পড়তে ইচ্ছে করে। শব্দগুলোর মর্ম ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। একদম গভীরে অবগাহন করতে ইচ্ছে করে। কেন এমন হয়? কী আছে তাঁর কবিতায়? কেউ কি তা অনুধাবন করতে পারেন? কতভাবেই না তাঁকে নিয়ে, তাঁর কবিতা নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। তিনি প্রতিনিয়তই নতুন নতুন রূপে ধরা দেন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌছানো যায় নি। কীভাবে যাবে?
তিনি যে অলৌকিক জগৎ নির্মাণ করেছেন, সেখানে সহজে ঢুকতে পারা যায় না। তিনি শব্দে শব্দে যে চিত্র এঁকেছেন, তা আর কারও পক্ষে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয় নি। তিনি রূপের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার মাধুর্য আর কোথাও পাওয়া যায় নি। তিনি যে গন্ধ পেয়েছেন, তা আর কেউ অনুভব করতে পারেন নি। তাঁর অনুভব, তাঁর অনুভূতি, তাঁর অনুধাবন যেন প্রহেলিকাময়। সে অপার্থিব এক জগত। তাতে কুহক আছে। হেঁয়ালি আছে। আছে অধরা মাধুরীও। তিনি তো জীবনের ‘নিভৃত কুহক’কে তুলে ধরেছেন। কিন্তু তাঁর কবিতার অবগুণ্ঠন পুরোপুরিভাবে উম্মোচন করা যায় না। কুয়াশার মতো একটা আচ্ছাদন তৈরি করে। ‘তারপর দূরে নিরুদ্দেশে চ’লে যায় কুয়াশায়’।
তাঁর অস্তিত্বের মধ্যে, তাঁর চৈতন্যের মধ্যে, তাঁর রক্তের মধ্যে যা কিছু প্রবাহিত হয়েছে কিংবা আন্দোলিত করেছে, তাকে শব্দ ও বাক্যের ব্যঞ্জন দিয়ে যেভাবে দক্ষতার সঙ্গে প্রক্রিয়াজাত করেছেন, তেমনটি বোধহয় ‘দেখিব না আর’। কাব্যের মায়াকানন গড়ে তোলার জন্য তিনি যেন কলম-কালি নয়, ঢেলে দিয়েছেন নিজের লহু। যে কারণে তাঁর কবিতা রয়ে গেছে অনধিগম্য, অপ্রাকৃত ও স্পর্শাতীত।
বোধ ও বোধাতীতের কাব্যিক ব্যাখ্যাকার হলেও জীবনানন্দ দাশ রূপসী বাংলারও কবি। তাঁর কবিতায় চিত্ররূপময়তা আছে। বর্ণময়তা আছে। রূপকাভাস আছে। তাঁর মতো প্রকৃতিকে এত ব্যঞ্জনাময় আর কে করতে পেরেছে? তিনি ছিলেন প্রকৃতির অতুলনীয় রূপকার। গ্রামের চিরায়ত রূপকে তিনি অবিনশ্বর করে রেখেছেন। যা কখনই হারিয়ে যাবে না।
তাঁর কবিতায় কত কত পাখি। সব চেনা পাখি হলেও তা নিয়ে আসে অন্যরকম ব্যঞ্জনা। চিল, শালিখ, বুনোহাঁস, দোয়েল, বুলবুলি, কোকিল, মাছরাঙা, রাজহাঁস, গাংশালিখ, পায়েরা, খঞ্জনা, ডাহুক, কাকাতুয়া, ঘুঘু, পেঁচা, লক্ষীপেঁচা, শ্যামা, বক, দাঁড়কাক, বাদুর, বউ কথা কওসহ আরও কত কি। এই পাখিরা কতভাবেই না উপমা হয়ে আছে। ‘লক্ষীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষীটির তরে?’ আহা! কী যে মাধুর্য ছড়িয়ে দেয়!
কত কত ফল। চালতা, জাম, বট, কাঁঠাল, হিজল, তমাল, ডুমুর, ধুন্দুল, তালসহ বিচিত্র ফল। প্রকৃতির অকৃপণ সব সম্ভার। তাতে ফিরে ফিরে আসে আবহমান বাঙলার চিরায়ত রূপ। ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ/খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে/চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে ব’সে আছে/ভোরের দোয়েল পাখি-চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ/জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের অশ্বত্থের ক’রে আছে চুপ;/ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে!/মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে/এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ/দেখেছিল’। বাংলার নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে কি অপরূপ ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করেছেন। প্রকৃতির এই উপকরণ কখনও বিলুপ্ত হয়ে গেলেও কবিতায় তার স্বাদ পাওয়া যাবে অন্ততকাল।
ভালোবাসার কত কত অমলিন নারী। অমিতা সেন, অরুণিমা সান্যাল, বনলতা সেন, শঙ্খমালা, শ্যামলী, সুজাতা, সুদর্শনা, সবিতা, সুচেতনা, সুরঞ্জনারা। হীরের নাকছাবির মতো যেন এক একজন উজ্জ্বলতা ছড়ান। মোহিনী এই নামগুলোতে কী যে মুগ্ধতার আবেশ জড়ানো। তাতে ছড়িয়ে আছে কী যে লাবণ্য। কী যে সৌন্দর্য। কী যে সুষমা। কত স্বপ্ন। কত কল্পনা। কত বিহ্বলতা।
এই নারীরা যেন হয়ে ওঠেছেন ভালোবাসার চিরকালীন প্রতীক। তাদের নিয়ে কত অভিব্যক্তি। কত অভিমান। কত অভিলাষ। ‘অমিতা সেনকে সুবল কি ভালোবাসে?/অমিতা নিজে কি তাকে?’। তাদের মতো কতজনকে নিয়েই তো এমন কৌতূহল হয়? অনেকের স্মৃতিতে চকিতে ভেসে ওঠে অরুণিমার মতো অনেকের মুখ। একান্ত কোনও মুহূর্তে ‘মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ’। শঙ্খমালাকে ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর’। শ্যামলী! ‘তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতন’। নিজের কাছেই নিজের প্রশ্ন, কোনও সুজাতাকে কি ভালোবাসতাম না? ‘সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি-/এখনো কি ভালোবাসি?’। কত সুদর্শনাকে নিয়ে আফসোস হয়। ‘এই পৃথিবীর ভালো পরিচিত রোদের মতন/তোমার শরীর; তুমি দান করোনি তো;/সময় তোমাকে সব দান করে মৃতদার বলে/সুদর্শনা, তুমি আজ মৃত।’ সবিতাকে অকপটে বলা যায়, ‘মানুষজন্ম আমরা পেয়েছি/মনে হয় কোনো এক বসন্তে রাতে’। সুচেতনা! ‘তুমি এক দূরতর দ্বীপ’।
আর সুরঞ্জনা? কী যে ছন্দিত নাম। হৃদয়ে ঢেউয়ের মতো দোলা দিয়ে যায়। এমন প্রিয়তমাকে কি কখনো ভুলতে পারা যায়? অনন্ত আক্ষেপ নিয়ে অনেকের জীবনেই আছেন এক একজন সুরঞ্জনা। তার অধিকার কোনও একনিষ্ঠ প্রেমিক কখনই ছাড়তে পারবে না। ‘ওই যুবকের’ সঙ্গে কথা বলা নিয়ে বুকের মধ্যে কী যে তীব্র তোলপাড় হয়? এটা কিছুতেই মানতে পারা যায় না। কেউ কি তা পারে? তার ফিরে আসার জন্য কী যে আকুতি? সে কথা কি সুরঞ্জনারা জানে? জানে না বলেই জীবনানন্দ দাশের এমন আকুলতা, ‘সুরঞ্জনা, ওইখানে যেও নাকো তুমি,/বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;/ফিরে এসো সুরঞ্জনা/নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;/ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;/ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;/দূর থেকে দূরে - আরো দূরে/যুবকের সাথে তুমি যেও নাকো আর।/কি কথা তাহার সাথে? তার সাথে!’
আর পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে তাকানো নাটোরের বনলতা সেন? তাকে নিয়ে তো রহস্যময়তার শেষ নেই। আমাদের কল্পনাকে তুমুলভাবে উসকে দেয়। তাকে পাওয়ার জন্য মনটা কি যে আকুলি-বিকুলি করে। কালজয়ী এই নারী যেন অলৌকিক এক মায়াবী জগৎ গড়ে তুলেছেন। সেই জগতে হয়তো খানিকটা শান্তিও বিলানো হয়। ‘আমারে দুদ- শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন’। একটুখানি শান্তি পাওয়ার আশায় কল্পনার এই নারীর জন্য ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষায় থাকাই যায়।
নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে মোটেও সংশয় কাটে না। তিনি কখনও গেয়েছেন জীবনের জয়গান। কখনও আরাধনা করেছেন মৃত্যুর। প্রকৃতির বন্দনায় মেতেছেন। তাঁর কবিতায় একাকার হয়ে যায় জীবন, জগত, সমাজ, সময়, সভ্যতা, প্রকৃতি। তাতে একীভূত হয়ে যায় ক্লান্তি, অবসাদ, দীর্ঘশ্বাস, বিষণ্নতা, ধূসরতা। তাড়িত করে নিঃসঙ্গতা, অসহায়ত্ব আর শূন্যতাবোধ। তাঁর কবিতায় শিশিরের ঘ্রাণ আছে। ঘুমের ঘ্রাণ আছে। এমন অসম্ভব ঘ্রাণ আর কেউ কি পেয়েছে? তীব্র হাহাকার আছে। না পাওয়ার বেদনা আছে। এত বৈচিত্র্য। এত বিচিত্রতা। এত বিচিন্তা। সবটাই যেন মন্থিত হয়ে কুয়াশার মতো ঢুকে যায় বুকের গভীরে। তাতে যে নেশা নেশা ঘোর তৈরি হয়, তার মোহাচ্ছন্নতা কাটিয়ে ওঠা যায় না। অথচ এই আবেশের নির্মাতা চিরকালই অধরা রয়ে যান।
তাঁর কবিতা বুঝতে পারা যায় না। তাঁর জীবন বুঝতে পারা যায় না। তাঁর মৃত্যুও বুঝতে পারা যায় না। জীবনানন্দ দাশ আমাদের কাছে যেন অচেনাই থেকে যান। তবে বুঝতে না পারলেও অচেনা থাকে না তাঁর জীবন। তাঁর জগৎ। তাঁর কবিতা। যে কারণে অন্ধকারের মধ্যে আশার আলো হয়ে থাকেন ‘মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’।
‘ভালোবাসি তোমায়.......’
কাকে দেখে বুকের মধ্যে প্রথম কুসুম কুসুম অনুভূতি হয়েছিল, এখন আর মনে পড়ে না। অনুধাবন করতে পারি, যে এলাকায় থাকতাম, কোনও চঞ্চলা কিশোরীকে দেখে হয়তো চঞ্চল হয়েছিল মন। কোনও একজনা নিশ্চয় নয়। তখন তো চড়ুই পাখির মতো অস্থির মন। বদলে যায় ক্ষণে ক্ষণে। কখনও এ ডালে। কখনও অন্য ডালে। সেই কিশোর কিশোর ভালোবাসা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিলিয়ে যেতে বেশি সময় লাগে নি। সেই বয়সে তো আর পরিপক্ক ছিলাম না। কবেইবা তা হতে পেরেছি?
চকিত চাহনির বেশি কিছু হওয়ার সুযোগও তো ছিল না। তাই যে হয়েছে, সেটাইবা বলি কী করে? বিপরীত লিঙ্গের অপরিচিতা কারো দিকে তাকানোর মতো আত্মবিশ্বাসও তো ছিল না। সামান্য টোকাতেই তো গুটিয়ে যেতাম লাজুক লতার মতো। দূর থেকে রঙধনুর মতো দীপ্তি নিয়ে কাউকে হেঁটে যেতে দেখে কিংবা টুনটুনি পাখির মতো সুরেলা কোনও কণ্ঠ শুনে বুকের মধ্যে বোধকরি জমেছিল ভালোবাসার শিশিরবিন্দু। ব্দ্বুুদের মতো উন্মূলিত সেই জলকণা দিয়ে হয়তো কল্পনার মেঘ সাজিয়েছি।
আর যা কিছুর ঘাটতি থাকুক না কেন, কল্পনার কোনও কমতি কোনও সময়ই ছিল না। কল্পনা দিয়েই কত কিছু গড়ে তুলি। কল্পনার রঙ-তুলি দিয়ে আঁকি কত না ছবি। আবার মুছেও ফেলি। কল্পনায় কতজনের সঙ্গে আবেগময় কথপোকথন হয়েছে। মেঘের মতো ভেসে ভেসে কত দূরে দূরে চলে গেছি। কবি জয় গোস্বামী তো প্রশ্রয় দিয়েছেন এভাবে, ‘স্বপ্নে বসি ট্যাক্সিতে তোর পাশে/স্বপ্নে আমি তোর হাত থেকে বাদাম ভাজা খাই/কাঁধ থেকে তোর ওড়না লুটোয় ঘাষে/তুলতে গেলি-কনুই ছুঁলো হাত/তুলতে গেলি-কাঁধে লাগলো কাঁধ/সরে বসব? আকাশভরা ছাতে/মেঘের পাশে সরে বসল চাঁদ’। এমনটি ভাবতেই তো পুলকিত হয়েছে অন্তঃকরণ।
কত কল্পনাবিলাসী স্বপ্ন দেখেছি। তাতে অবশ্য স্বপ্ন ভঙের কষ্ট থাকে না। তবে সেই বয়সে বুকের গভীরে স্থান করে নেওয়া একজন ‘মৃম্ময়ী’ চিরকালের আরাধ্য নারী হয়ে আছে। যদিও তাকে কখনও বাস্তবে খুঁজে পাই নি। তারপরও না পাওয়া সেই নারীকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অনন্ত প্রেম’ উদ্ভাসিত হয়ে আছে হৃদয়ে, ‘তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার/জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।/চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার-/কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার/জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার’। এখনও কি তাকে খুঁজে ফিরি না? জীবনানন্দ দাশের মতো করে বলতে পারি, ‘আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি;/জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে/কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে’।
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে আসার পর দেহ ও মনে উড়তে থাকে রঙিন প্রজাপতি। তার পাখনায় ভর দিয়ে মনের ভিতর কত যে রোমান্টিকতার আনাগোনা হয়। যদিও এত এত রোমান্টিকতা নিয়েও কারও হৃদয়ে আঁচড় কাটা সম্ভব হয় নি। এরজন্য যে উদ্যম ও হিম্মত থাকার প্রয়োজন, সেটা তো কখনই ছিল না। তাতে কি আর ভবী ভোলে?
কারও সান্নিধ্য না পেলেও ভালোবাসার উষ্ণতায় প্লাবিত তো হওয়াই যায়। কল্পনায় কাউকে কাছে পেতে তো আর বাধা নেই। তখন তো ‘ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো’ লাগারই বয়স। কারও এক টুকরো হাসি, কারও একটুখানি দুষ্টুমি, কারও ফ্যাশনবেল সাজ, কারও অপরূপ ভঙ্গিমার মোহনীয়তা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় হৃদয়। তাদের কেউ হয়ে যেতেন স্মিতা পাতিল। কেউ শ্রীদেবী। কেউবা মাধুরী দীক্ষিত। তখন তো বলিউডের নায়িকারাই চোখে এঁকে দিতেন স্বপ্নের মায়াঞ্জন।
তবে অনেকের ভিড়ে কোনও একজনকে হয়তো আলাদাভাবে জুম-ইন করে হৃদয়ে বিশেষ স্থান দিতাম। তাতে তো আর কারও মাইন্ড করার সুযোগ থাকতো না। কল্পনার এই প্রেমিকাদের নিয়েই জীবন হয়ে ওঠতো রঙদার। আর ঘটনাক্রমে কারও সঙ্গে একটু বেশি দেখন-হাসি হলেই নিজেকে মনে হতো ‘নাইনটিনফোট্টিটু লাভ স্টোরি’র উদ্বেলিত অনীল কাপুর। খুশিতে বাক-বাকম হয়ে বুকের মধ্যে বাজতে থাকতো ‘এক লাড়কি কো দেখা তো অ্যাইসা লাগা’। উড়– উড়– আহ্লাদিত এই আবেগটাই ছিল। ছিল না কোনও মনীশা কৈরালা।
অথচ কত গভীরভাবেই না ভালোবাসতে চেয়েছি। নিজেকে নিংড়ে দিয়ে বলতে চেয়েছি, ‘মেরা দিল ভি কিতনা পাগল হ্যায়, ইয়ে পিয়ার তো তুম সে করতা হ্যায়’। হায়! কাউকে এমনভাবে হৃদয়ের কথা বলা হয় নি। শুধু কল্পনায় চেয়েছি, ‘ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো- তোমার মনের মন্দিরে’। কেউ মনের মন্দিরে নামটি লিখেছিল কিনা জানতে পারি নি। আসলে তখন সময়টাই ছিল এমন, যতটা না ভালোবাসা হতো, তারচেয়ে বেশি থাকতো কল্পনার আল্পনা।
তবে দুঃসাহসিক প্রেমিকদের জন্য সব কালই সমান। তারা রোমিও হয়ে যুগে যুগে জুলিয়েটদের মন হরণ করে নিতে পেরেছেন। আর আমাদের সময়ে ‘রঙচটা জিন্সের প্যান্ট পরা/জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে ধরা/লাল শার্ট গায়ে তার বুক খোলা/সানগ্লাস কপালে আছে তোলা’ যুবকদের কদর ছিল বেশি। যে কারণে ডলি সায়ন্তনীরা কোনও রাখ-ঢাক না রেখেই বলতে পারতেন, ‘দৃষ্টিতে যেন সে রাজপুতিন/খুন হয়ে যাই আমি প্রতিদিন/নামধাম জানি না তার কিছু/তবুও নিলাম আমি তার পিছু’।
আমি তো আর সেই ক্যাটাগরিতে পড়তাম না। তারপরও তো কোনও একজনের জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে কত কত দুপুর দাঁড়িয়ে থেকেছি। ক্ষেপণ করেছি কত না সময়। কলেজের ক্লাস অবলীলায় ফাঁকি দিয়েছি। গুরুত্বপূর্ণ কাজ উপেক্ষা করেছি। সব পিছুটানকে নাকচ করে দিয়ে প্রতিদিন নির্র্দিষ্ট একটি সময়ে হাজিরা দিয়েছি। সেকেন্ডের কাটা এদিক থেকে ওদিক হওয়ার সময় পায় নি। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় কিছুই দমিয়ে রাখতে পারে নি। শুধু একটুখানি দেখা আর কালেভদ্রে এক টুকরো মোনালিসা হাসির প্রলোভনে ছুটে গিয়েছি। পারস্যের কবি হাফিজ প্রিয়ার গালের একটি তিলের জন্য বোখারা আর সমরখন্দ বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমার তো সেই সামর্থ্য বা ক্ষমতা ছিল না। আমি কেবল প্রেয়সীকে আমার হৃদয়ের সুপ্ত আকুতিটুকুই দিতে চেয়েছি। কিন্তু ‘যে ছিল আমার স্বপনচারিণী/তারে বুঝিতে (বোঝাতে) পারি নি’।
বয়স বেড়েছে। পরিপক্কতা না এলেও অভিজ্ঞতা তো হয়েছে। বদলে গেছে সময়। কিন্তু ভালোবাসার বাসনা আমাকে কখনই ছেড়ে যায় নি। এখনও কল্পনার তুলিতে কারও মুখ আঁকার জন্য উম্মুখ হয়ে থাকি। কবি নির্মলেন্দু গুণ হয়ে ওঠেন পরম আশ্রয়, ‘হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে/মন বাড়িয়ে ছুঁই,/দুইকে আমি এক করি না/এক কে করি দুই’। এর বেশি তো সাহসে কুলায় না। আমি তো আর প্রেমিক পুরুষ হেলাল হাফিজ নই যে কোনও দ্বিধা না করেই সরাসরি বলবো, ‘দেখবো দেখাবো পরস্পরকে খুলে/যতো সুখ আর দুঃখের সব দাগ,/আয় না পাষাণী একবার পথ ভুলে/পরীক্ষা হোক কার কতো অনুরাগ’।
এখন তো ভালোবাসার খোলা হাওয়ায় কাউকে আর বেধে রাখা যায় না। কত সহজে, কত সুলভে, কত সাবলীলভাবেই ভালোবাসা হয়ে যায়। মাধ্যম হিসেবে আছে ফেসবুক, টুইটার, ইয়াহু, গুগল, স্মার্ট ফোনের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। ভালোবাসার জন্য আছে একটি নির্ধারিত দিন ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’। আর এখন তো বসন্ত আসে ঘোষণা দিয়ে, ‘আকাশে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা/কারা যে ডাকিল পিছে! বসন্ত এসে গেছে’।
হলুদ বা লাল শাড়ি, ফুলেল খোঁপা, ঝুমকো কানের দুল, টিপ, বাহারি চুড়ি, কাজল আর লিপিস্টিকের মাধুর্য ছড়িয়ে ঘুরে বেড়ায় ভালোবাসা। আছে হৃদয় বিনিময়ের হরেক উপকরণ। ফুল, কার্ড, চকলেটসহ কত কি! এমনকি বইগুলো হয়ে গেছে ভালোবাসার। পরিবেশ এতটাই রোমান্টিক হয়ে গেছে, ভালোবাসার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় না। চাইতেও হয় না-‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’। অথচ ভালোবাসার জন্য কাঙাল এই হৃদয় কত না তৃষ্ণার্ত হয়ে থেকেছে। হায়! কেউ একজন মল্লিকা সেনগুপ্ত’র মতো করে বলে নি, ‘তবুও তোমার ঘাম গন্ধ/সস্তা তামাক স্বপ্নের চোখ/আমাকে টানত অবুঝ মায়ায়’।
কিংবা তসলিমা নাসরীনের মতো এমন অনুভব যদি কারও থাকতো, ‘জানি না কেন হঠাৎ কোনও কারণ নেই, কিছু নেই, কারও কারও জন্য খুব/অন্য রকম লাগে/ অন্য রকম লাগে,/কোনও কারণ নেই, তারপরও বুকের মধ্যে চিনচিনে কষ্ট হতে থাকে,/কারুকে খুব দেখতে ইচ্ছে হয়, পেতে ইচ্ছে হয়,/কারুর সঙ্গে খুব ঘনিষ্ট হয়ে/বসতে ইচ্ছে হয়,/সারাজীবন ধরে সারাজীবনের গল্প করতে ইচ্ছে হয়,/ইচ্ছে হওয়ার কোনও কারণ নেই, তারপরও ইচ্ছে হয়।’ এমন ইচ্ছের কথা আমাকে কেউ কোনো দিন বলে নি। আর আমিও তো গুটানো স্বভাবের কারণে কখনই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারি নি ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি তোমায়.......’। এই না পারার কারণে অপ্রকাশের বেদনাই বোধকরি বুকের মধ্যে জ্বালিয়ে রেখেছে ভালোবাসার রওশন। সেটা নিয়েই কেটে যাচ্ছে এ জীবন।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)