পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

মঙ্গলবার, ৭ মার্চ, ২০১৭

আমার বালক-বয়স বাড়ে না কেন?


সময় যে চলে যাচ্ছে, না বললেও চলে। এমনিতেই বুঝতে পারা যায়। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই আরো ভালোভাবে টের পাওয়া যায়। পাতলা চুল, ক্লান্ত চোখ আর বিষণœ মুখ যেন বয়ঃক্রমের মানচিত্র। স্বাভাবিক নিয়মেই হ্রাস পেয়েছে শারীরিক শক্তি, সামর্থ্য ও ক্ষিপ্রতা। লিভারে মেদ জমেছে। কিডনিতে খনিজ জমেছে। ক্লেদ জমেছে হৃদয়েও। সংগত করার জন্য আছে আনুষঙ্গিক আরো কিছু ব্যাধি। এ ধরনের কঠিন কঠিন সব ব্যাধিতে কখনও কখনও বিপন্ন হয়ে পড়ে জীবন। নিভে যেতে যেতে ফের যেন জ্বলে ওঠে জীবনসলতে। চলার পথে সম্বোধন তো অনেক আগেই বদলে গেছে। এ বদল যতই এড়িয়ে যেতে চাই না কেন, জীবন ও সময়কে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। সে তার হিসেব বুঝে নিতে একটুও কার্পণ্য করে না। এ ক্ষেত্রে তার একদমই ঢিলেমি নেই। যতই ভেষজ কিংবা উন্নতমানের চিকিৎসা করা হোক না কেন, খুব একটা কাজে আসে বলে মনে হয় না। ওপর ওপর ঝকমক করলেও ভেতরটা ঠিকই ক্ষয়ে যেতে থাকে। বিজ্ঞানীরা বয়সকে আটকে রাখার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত আশার আলো দেখাতে পারেন নি। শেষ অব্দি অপেক্ষায় থাকতে হয় মৃত্যুর। বুকের মধ্যে যতই কাঁপন ধরুক না কেন, নিয়তির এই বিধানকে মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। 

নিজেকে ফিটফাট রাখার ব্যাপারে আমার তেমন তৎপরতা নেই বললেই চলে। আড়ালে-আবডালে কেউ কেউ ল্যাবেনডিস হিসেবেও অভিহিত করেন। অনেক সময় চুলটাও ঠিকমতো আঁচড়ানো হয় না। প্রায়শই ভুল জায়গায় ভুল বোতাম লাগিয়েছি। কত দিন উল্টো জ্যাকেট পরে সারাদিন টইটই করে ঘুরেছি। যুগিয়েছি হাসির খোরাক। নিজেকে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখার ব্যাপারে কখনই মনোযোগ ছিল না। এমনিতেই সুদর্শন নই। হ্যান্ডসাম নই। নই স্মার্টও। কথাও ঠিকমতো গুছিয়ে বলতে পারি না। তার ওপর পোশাক-আশাকেও কেতাদুরস্ত নই। অগোছালো এমন মানুষকে তো সময়ের আগেই বুড়িয়ে যাওয়ার মতোই লাগে। ভাব-ভঙ্গিতে তেমনই প্রকাশ ঘটে। এরসঙ্গে তাল মিলিয়ে মনটা বুড়াটে হওয়ার কথা। চাল-চলনে পরিপাটিহীন ও বয়সী হয়েও মনটার বয়স কেন যে বাড়ে না?  

শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকে মনের সতেজতা ও সজীবতা। তাতে ছাপ পড়ে বয়সী ভাবনারও। সেটাই তো স্বাভাবিক। বয়সের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মনটাও অভিজ্ঞ ও পরিণত হয়ে ওঠে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ঢের ঢের পিছিয়ে আছি। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যটা এখনও কাটিয়ে ওঠতে পারি নি। সেই বয়স, সেই মন, সেই জীবনধারা এখনও আমার পিছ ছাড়ছে না। বয়স বাড়লেও মনটা আজও অপরিণত হয়ে আছে। যে কারণে সামাজিক দৃষ্টিতে এই বয়সে যেটা মানানসই নয়, সেটা করার জন্য মনটা কেমন যেন উসখুস করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো প্রলোভন এড়াতেও পারি না। আচরণ করি দুষ্টু বালকের মতো। কেন যে এ মনোভাব এড়াতে পারি না?


 আমাকে এই বয়সেও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো। স্কুলে পড়ার সময় কত না মার্বেল খেলেছি। মনের আনন্দে নীল আকাশে ওড়িয়েছি ঘুড়ি। এখনও ইচ্ছে করে মার্বেল নিয়ে নেমে পড়তে। ইচ্ছে করে ঘুড়ি দিয়ে আকাশের মেঘ স্পর্শ করতে। ইচ্ছে করলেও উপায় নেই। এখন আর এই শহরে কেউ মার্বেল খেলে না। আর ঘুড়ি ওড়ানোর মতো আকাশ কোথায়? চাইলেই কি এ বয়সে সেটা সম্ভব? যেটা সম্ভব, সেটাও তো পারি না। ব্যাডমিন্টন খেলতে এত ভালোবাসতাম, ফ্রোজেন শোল্ডারের কারণে খেলা হয় না। কোথাও খেলা হলে মনটা আঁক-বাঁকু করে। এই ইচ্ছে পূরণের সুযোগ না থাকলেও মনটাকে বুঝ দিতে পারি না।


এই জীবনে কত না ফুচকা, চটপটি, ঝালমুড়ি, আইসক্রিম, আচার, ঝুরিভাজা, হজমি হজম করেছি। আমার শরীরের বেশিরভাগ গড়ে ওঠেছে এ গুলোরই সমন্বয়ে। যেজন্য শারীরিক গড়নটা শক্তপোক্ত নয়। আর এখন বাস্তবিক কারণেই এগুলো থেকে দূরে থাকতে বলা হয়। বললেই কি মেনে নেওয়া যায়? পথের পাশে ধুলোমাখা চটকদার এই খাদ্যগুলো আমাকে এখনও চুম্বকের মতো টানে। যতই বিধি-নিষেধ থাকুক, এর প্রলোভন মোটেও এড়াতে পারি না। এটা কি সম্ভব? চটপটি-ফুচকাÑআইসক্রিম ছাড়া জীবনটা কেমন যেন আলুনি আলুনি লাগে। হাওয়াই মিঠাই দেখলে বালক বয়সের মতো চাতক চোখে চেয়ে থাকি। এই বয়সে যখন একাকী হাওয়াই মিঠাই দিয়ে ঠোঁট লাল করি, অনেকেই তির্যকভাবে তাকিয়ে থাকেন। অস্বস্তি লাগলেও কিছু করার থাকে না। বয়স বাড়লেও ছেলেমানুষিটা যেন আজও কাটিয়ে ওঠতে পারি নি। আজও ল্যাবেনচুসের জন্য মনটা আইঢাই করে।  
ইঞ্জেকশন বা টিকা দেওয়ার ভয়ে স্কুল থেকে কত না পালিয়ে গেছি। অথচ সুইয়ের খোঁচায় এ জীবনে কত না ক্ষত-বিক্ষত হয়েছি। এমনকি দু’হাতে সুই ফুটানোর জন্য শিরা না পেয়ে পায়েও দিতে হয়েছে। এত এত দিনে তো সুইয়ে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বালক বয়সের সেই ভীতি আজও আমায় ছেড়ে যায় নি। সুইয়ের ভয়ে আজও চোখ বন্ধ করে রাখি।
  
এখনও শুনতে ভালো লাগে রোমান্টিক গান। এ ব্যাপারে আমার কোনো ছুতমার্গ নেই। এ প্রজন্মের কোনো শিল্পীর মন ছুঁয়ে যাওয়া গানও আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এমনও হয়, একটি গান শুনলে সেটি যদি ভালো লেগে যায়, সেই গানটিই বার বার শুনি। সেই তরুণ বয়সে শোনা ‘একডালি ফুল/তোমার হাতে দিয়ে আমি/বলেছিলাম ভালোবাসি/ভালোবাসি সবচেয়ে বেশি/শুধু তোমাকে শুধু তোমাকে শুধু তোমাকে’-এমন হালকা মেজাজের গানও এ বয়সে শুনতে ইচ্ছে করে। এমনকি কাউকে শোনাতেও ইচ্ছে করে। অথচ এটা কি আমার জন্য মানানসই? অথচ বয়সটাতো এখন এমন, আনমনে বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যথা হয়ে বাজবে, ‘এখন আমার বেলা নাহি আর, বহিব একাকী বিরহের ভার’। কিন্তু মন কিছুতেই মানতে তা চায় না।


আর প্রেমের কবিতা ও ভালোবাসার উপন্যাস আমাকে গভীরভাবে আপ্লুত করে। বিভোর করে দেয়। একটি উপন্যাস হৃদয় ছুঁয়ে গেলে তা শেষ করার পর তাৎক্ষণিকভাবে তা আমাকে ভীষণ ঘোরের মধ্যে রাখে। তার হ্যাংওভার কিছুতেই কাটিয়ে ওঠতে পারি না। একজন বনলতা সেন (বনলতা সেন/জীবনানন্দ দাশ), একজন মৃম্ময়ী (সমাপ্তি/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) কিংবা নিদেনপক্ষে একজন ময়ূরাক্ষী (ময়ূরাক্ষী, তুমি দিলে/হর্ষ দত্ত) বুকের গভীরে যে সম্মোহন ছড়িয়ে দিয়েছে, সেই সম্মোহন আজও কাটিয়ে ওঠা গেল না, এ কারণে এমন চরিত্রের সঙ্গে মানানসই কাউকে দেখলে এখনও মনটা কেমন উচাটন উচাটন করে। কেউ জানলে কী ভাববে?


জোছনা রাতে বুকের মধ্যে তরুণ বয়সের মতো কেমন আকুলিবিকুলি করে। মনে হয়, নির্জন কোনো প্রান্তে দু’ হাত ভরে জোছনা মাখামাখি করি। লুটাপুটি করি। ইচ্ছে করে কারও হাত ধরে হেঁটে বেড়াই সবুজ ঘাসে। প্যান্টে লেগে যাক দুষ্টু চোরকাঁটা। কেউ একজন ঘনিষ্টভাবে পাশে বসে ভালোবেসে তুলে দিক এই চোরপুষ্পী। অকারণেই লজ্জাবতী গাছকে ছুঁইয়ে দিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে খুব ভোরে শিশিরে সিক্ত করতে পা। ধুম বৃষ্টিতে ভীষণ ভিজতে ইচ্ছে করে। উড়ে যাওয়া প্রজাপতির পিছে পিছে ছুটে যেতে যায় অভিলাষী মন। ইচ্ছে করে রিক্সায় এলোমেলো ঘোরাঘুরি করি অচেনা পথে। বাসনা জাগে, কোনো ক্যাফেতে বসে থাকি প্রিয় কারও মুখোমুখি। গরম কফিতে চুমক দিতে দিতে খুনসুটি করি। এমন ইচ্ছে কি এই বয়সে শোভা পায়? আর মন যা চায়, তা কি বাস্তবে করা যায়? কে বোঝাবে অবুঝ মনকে? 


সুন্দরের প্রতি মুগ্ধতা আজও কাটলো না। এখনও অপোজিট সেক্সের কারো প্রতি সাবলীলভাবে তাকাতে পারি না। তারপরও ভিজাবিড়ালের স্বভাবটা যায় নি। যখন হঠাৎ চোখে পড়ে যায় সুচিত্রা সেনের মতো কোনো মুখ, মোনালিসার মতো এক টুকরো হাসি কিংবা নজর কাড়ার মতো কোনো সৌন্দর্য, তা না দেখে কি মুখ ফিরিয়ে নেওয়া যায়? এতটা ভদ্রলোক আমি কখনই ছিলাম না। চোরা চোখে হলেও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হয়। বুকের মধ্যে তার রেশ দুলতে থাকে দুরন্ত ঢেউ হয়ে। অথচ বয়স তো এটা পারমিট করে না। এটাকে কি বলা যায় বুড়ো বয়সের ভীমরতি? 

এতগুলো বছর পেরিয়ে এলেও আজও চালাক-চতুর হতে পারলাম না। এটা তো বুঝতে পারি, যখন কেউ কেউ আমাকে বোকা ঠাওরায়। মনে করে, একে যা বলা হবে তাই বিশ্বাস করবে। সেটাই হয়ে আসছে। আজও কাউকে অবিশ্বাস করতে পারি না। বিশ্বাস করতে গিয়ে প্রতারিত হই। কতভাবেই না ধাক্কা খাই। তারপরও শিক্ষা নেওয়া হয় না। যে কারও কথায় সহজেই পটে যাই। যে কারও প্রতি সহজাতভাবে সহযোগিতার হাতটা বাড়িয়ে দিতে দ্বিধা করি না। প্রতিদানে সইতে হয় প্রত্যাখ্যান। হজম করতে হয় অপমান। এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট। অপমানটা একদমই মেনে নিতে পারি না। যা আমাকে রীতিমতো ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। বিমূঢ়, বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত করে দেয়। তারপরও বালকোচিত মনটাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি না। পারি না বলেই কাউকে কিছু বলতে পারি না। পারি না প্রতিবাদী হয়ে ওঠতে। অল্প বয়সী বালকের মতো বুকের মধ্যে বয়ে বেড়াই অভিমান আর কষ্ট।
  
হম্বিতম্বি করতে না পারলে কোথাও নিজের অবস্থান সংহত করা যায় না। দুর্বিনীত হতে না পারলে, দুর্ব্যবহার করতে না পারলে, অসৎ না হতে পারায় গুরুত্ব, মর্যাদা ও সম্মান পাওয়া যায় না। উদ্ধত, অশিষ্ট ও অবিনয়ী হতে না পারায় কারও কাছেই পাত্তা পাওয়া যায় না। প্রতিবাদ করবো না জেনে অনেকেই মিথ্যা কথার ফুলঝুরি ছোটায়। মিথ্যা আশ্বাস দেয়। তথাকথিত ভদ্রতার খাতিরে সেটাই মেনে নিতে হয়। সেই শৈশবেই ভদ্রতার যে সবক পেয়েছি, সেটিকেই মনে করে এসেছি সারা জীবনের শিক্ষা। সেই শিক্ষাটা আমাকে নানাভাবে ভুগালেও তা পরিত্যাগ পারি না।

মনটা এখনও যে পেকে ওঠে নি, এটা গর্ব করে বলার মতো কিছু না। বরং আমার কাছে মনে হয়েছে, এটা ব্যর্থ জীবনের হাহাকার। নিজেকে দিয়ে এটা আমি ভালোভাবেই বুঝতে পারি। জন্মের পর এই ঢাকা শহরের বেড়ে ওঠা। আমাকে ঢাকার সন্তান বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। অথচ এত দিন বসবাস করার পরও ঢাকায় নিজস্ব কোনো ঠিকানা নেই। নিজস্ব বাহন নেই। এখনও দৌঁড়ে দৌঁড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওঠতে হয় ভাঙা বাস কিংবা মেজাজী রিক্সায়। আরো অনেক কিছুই নেই। বৈষয়িক পাওয়া না পাওয়ার সঙ্গে মনের কী সম্পর্ক, এমন প্রশ্ন ওঠতেই পারে। সম্পর্ক অবশ্যই আছে। বয়স বাড়লে, মনটা পরিপক্ক হয়ে ওঠলে, স্বার্থগত অর্থাৎ বৈষয়িক বুদ্ধিও সমানতালে বেড়ে যায়। বাড়ে সহায়-সম্পত্তি। অথচ সেই বালক বয়স না বাড়ার কারণে এই ঢাকা শহরে আজও অনিকেত হয়ে আছি। নিজের বুঝ নাকি পাগলেও বোঝে। সেই বুঝটুকু না হওয়াতে কিছুই করা হলো না। আর হওয়ার কোনো লক্ষণও নেই।


এটা তো চোখের সামনে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, যার বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, কথার ফুলঝুরি আছে, ক্ষমতার দাপট আছে, তাদেরই সমাদার বেশি। আর সমাদার কে না চায়? কিন্তু চাইলেও হবে না। কেউ তো আর হাত বাড়িয়ে কিছু দেবে না? তেমন আগ্রহও নেই। যদিও রাশির প্রতি আমার কোনো বিশ্বাস নেই। তবে রাশির কিছু কিছু পর্যবেক্ষণ জীবনের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমার রাশি নিয়ে লেখায় দেখতে পাই, ‘নেপচুনশাসিত মানুষগুলোর মধ্যে পার্থিব আকাঙ্খা তেমন একটা নেই। তাদের অধিকাংশের মধ্যেই পদবী, ক্ষমতা, নেতৃত্ব বা ধন-সম্পদের প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ দেখতে পাবেন না। বিয়ের সূত্রে কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রে না পেলে মীনদের মধ্যে কাড়ি কাড়ি টাকাওয়ালা মানুষ তেমন একটা নেই।’ রাশি অনুযায়ী ভাগ্য তো আমাকে এমনিতেই প্রবঞ্চিত করে রেখেছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধান্দা বাড়ার কথা থাকলেও সেটাও হয়ে ওঠে নি। তাহলে কীভাবে পাবো বিলাস-ব্যসনের চাবিকাঠি?

কিছু কিছু ইচ্ছে আছে, যা কখনও পূরণ হয় না। এই বয়সে হওয়ার কথাও নয়। তারপরও সেই ইচ্ছের দাস হয়ে আছি। ইচ্ছে করে প্রিয় কাউকে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে চিঠি লিখতে। আকাশী-নীল কাগজে মনের একান্ত কথা লিখে সব চোখ ফাঁকি দিয়ে সেই চিঠি গোপনে পৌঁছে দিতে। পেতে ইচ্ছে করে প্রিয়জনের লিপস্টিক মাখানো গভীর-গোপন প্রণয়পত্র। সেটা কি আর সম্ভব? তা তো ঠাঁই নিয়েছে স্মৃতির পাতায়। স্মৃতিকে কি আর ফিরিয়ে আনা যায়? তবুও বোকা মন মানতে চায় না।


সাম্প্রতিককালের ফেসবুকে চ্যাটিং করে তো অন্তত দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো যায়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকেও স্মার্ট ভাবতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে গভীরভাবে কারও প্রেমে পড়তে। যেভাবে প্রেমে পড়েছে উইলিয়ামের শেকসপিয়রের রোমিও-জুলিয়েট, এরিখ সেগালের লেখা ‘লাভ স্টোরি’ অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রের রায়ান ও’নিল-অ্যালি ম্যাকগ্রা, ‘টাইটানিক’ ফিল্মের জ্যাক ডাওসন (লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও)-রোজ ডেউইট বুকাতার (কেইট উইন্সলেট) কিংবা বলিউডের ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’-এর রাজ মালহোত্রা (শাহরুখ খান)-সিমরান সিং (কাজল)। এভাবে কি আমার পক্ষে প্রেমে পড়া সম্ভব? তাছাড়া আমি তো আমার হৃদয়টাকে জানি। কাউকে ভালোবাসলে বা কারও প্রেমে পড়লে তার মোহাচ্ছন্নতা কখনও কাটিয়ে ওঠতে পারবো না। এমন দুর্বল মন নিয়ে কারও প্রতি ঝুঁকে পড়লে সেটা কি সামাল দিতে পারবো? মোটেও না। হাল আমলের একটি কবিতার মতো,
‘আমি একবার কারও প্রেমে পড়লে সারাজীবন আর/
উঠতেই পারি না। সকলে কী সুন্দর উঠে পড়ে জামাটামা/
বদলিয়ে একেবারে হাতটাত মুছে...আমি সেই পড়ে/
থাকি!’ (প্রেমিক/সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়)।

এমন মনোভাবাপন্ন হলে তো কষ্ট পেতেই হবে। তারপরও প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে। নিবিড়ভাবে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। আর শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যের মতো যা যা ইচ্ছে করে, তা তা করতে চাই। কোনো কিছুই বাদ দিতে চাই না। এটা কি বয়সী কোনো মানুষের কথা হতে পারে? এমন মনোভাবের কথা জানলে যে কেউ বাঁকা হাসি হাসবেন। খারাপ ভাববেন। বকাও হয়তো দেবেন। তারপরও আমি নিরুপায়। আসলে মনের বয়স না বাড়লে আমি কী করতে পারি? মনটাকে তো বেঁধে রাখা যায় না। ইচ্ছেটাকেও তো আগল দিয়েও রাখার উপায় নেই। কেন জানি না, বয়স বাড়লেও আজও সাবালক হতে পারি নি। এই না পারাটা এই বয়সের সঙ্গে একদমই মানানসই নয়। কিন্তু আমি কী করতে পারি? তাই আক্ষেপ নিয়ে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো বলতে পারি, ‘সবার বয়স হয় আমার বালক-বয়স বাড়ে না কেন?’
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭


  

‘সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে’



তাঁকে যাঁরা দূর থেকে অবলোকন করেন, এমনকি যাঁরা কাছাকাছিও হয়েছেন, তাঁদের কাছে মনে হতে পারে, রসকষহীন নিরেট একটি পাথর। যেন তাঁর কোনো লাবণ্য নেই। সুষমা নেই। সৌন্দর্য নেই। এমনটি মনে হওয়ার কারণ, তিনি সবার সঙ্গে খুব একটা মেলামেশা করেন না। যার-তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার প্রশ্নই আসে না। তাঁকে খুব একটা হাসতেও দেখা যায় না। বেশির ভাগ সময় চুপচাপ থাকেন। কাজ করেন আপন মনে। তাঁকে গম্ভীর প্রকৃতির বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। তিনি তাঁর চাবুকের মতো সুগঠিত দেহের মতো স্ট্রেইটকাট। কাউকে পরোয়া করেন না। আর আপোষ করার প্রশ্নই আসে না। নিজে যেটা বিশ্বাস করেন, সে বিষয়ে তাঁকে টলানো আর পাহাড় ধাক্কা দিয়ে নড়ানোর মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। আলোচনার টেবিলে তাঁকে দেখা যায় ভিন্ন মেজাজে। পাকা বিতার্কিকের মতো তাঁর মুখে যেন কথার খই ফোটে। রাজনৈতিক বিষয় হলেও তো কথা নেই। ইতিহাসের পাতা থেকে অবলীলায় একের পর এক উপস্থাপন করেন বিভিন্ন প্রসঙ্গ। তাঁর সামনে হকচকিয়ে যান ঝানু ঝানু আলোচকরাও। সে যে-ই হোক না কেন, তাঁর কথা শুনতে বাধ্য না হয়ে পারেন না। কণ্ঠের তীব্রতা, যুক্তির ধার আর ইস্পাতদৃঢ় মনোবল নিয়ে তিনি যখন আলোচনার ঝড় তোলেন, তখন দেখতে পাওয়া যায় টগবগিয়ে ফুটতে থাকা একজন বিপ্লবীকে। তাঁর উপস্থিতিতে সব সময় আলোচনা যে সুখকর হয়, তা বলা যাবে না। প্রায়শই তপ্ত হয়ে ওঠে আড্ডার মেজাজ। পাল্টা যুক্তি দিয়ে তাঁকে কাবু করার চেষ্টা করা হয়। তাতে তিনি দমে যাওয়ার পাত্র নন। এ কারণে মনোমালিন্যও হয়। অনেকে তাঁকে আগ্রাসী ও উগ্র মেজাজী হিসেবেও অভিহিত করেন। এ নিয়ে তাঁর খুব একটা ভাবান্তর হয় না। সোভিয়েত নেতা যোষেফ স্টালিনের অনুরক্ত হওয়ার কারণে তাঁকে ‘আইরনম্যান’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। সামনাসামনি এমনটি বলা হলেও তাঁর চিকন হাসিটি ঠিকই অনুভব করা যায়। আর তিনি হলেন এক ও অদ্বিতীয় সুধীর কৈবর্ত দাস।

ঘটনাবহুল এক জীবন পেরিয়ে এসেছেন তিনি। যে অবস্থান থেকে নিজেকে গড়ে তুলেছেন, তা মোটেও সহজ ছিল না। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সন্তান হলেও ১৯৫০ সাল থেকে তাঁর বেড়ে ওঠা ও প্রতিষ্ঠা মূলত ঢাকার শাঁখারিবাজারকে কেন্দ্র করে। সামাজিকভাবে একটু আড়ালে থাকা এ এলাকায় তিনি ছিলেন প্রতিবাদী এক বলিষ্ঠ কণ্ঠ। সেই ষাট দশকের রাজনৈতিক আন্দোলনেও সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। প্রকম্পিত রাজপথের মিছিলের তিনিও ছিলেন সাহসী এক মুখ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তদানীন্তন ছাত্রনেতা গয়েশ্বর রায়, স্বপন চৌধুরীর অনুপ্রেরণায় তিনি সক্রিয়ভাবে তাতে অংশ নেন। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধের টাটকা স্মৃতি নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতির পাশাপাশি পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতাকে। একটা পর্যায়ে হয়ে ওঠেন পুরোদস্তর পেশাদার সাংবাদিক। দীর্ঘ জীবনে অর্জন করেছেন বৈচিত্র্যময় ও বর্ণময় অভিজ্ঞতা।
আপাতদৃষ্টিতে বহিরঙ্গের সুধীর কৈবর্ত দাসকে কঠিন ও কর্কশ মনে হলেও খুব গভীরভাবে স্পর্শ করতে পারলে অনুভব করা যায় তাঁর ভিতরের ঐশ্বর্য ও  পেলবতাকে। অনেকটা তালশাঁসের মতো। তাঁর বুকের মধ্যে বয়ে চলে ভালোবাসার স্রোতস্বিনী নদী। সেটা কিন্তু বাইরে থেকে অনুধাবন করা যাবে না। তাঁকে যাঁরা অন্তরঙ্গভাবে চেনেন কিংবা জানেন, তাঁরা অন্তত সেটা অনুধাবন করতে পারেন। অনেকেই পেয়েছেন তাঁর আন্তরিকতা, স্নেহ ও ভালোবাসা। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে তিনি মোটেও দ্বিধা করেন না। এ কারণে নীরবে গড়ে ওঠেছে তাঁর একদল অনুসারীও।

এবারের বইমেলায় নতুনভাবে উদ্ভাসিত হয়েছেন সুধীর কৈবর্ত দাস। বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বিবরে বিভূতি’ এবং গল্পগ্রন্থ ‘সৌপ্তিক’। তাঁর বুকের মধ্যে যে লুকিয়ে আছে একজন সৃজনশীল লেখক, সেটা এবার যেন পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করা যায়। তাঁর গ্রল্পগন্থে স্থান পেয়েছে সাতটি গল্প। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে লেখা গল্পগুলো ছাপা হয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। গল্পের বিষয়বস্তু ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের সমস্যা-সংকট, মানসিক দ্বিধা-দ্বন্ধ, নিম্নবিত্তের কঠিন জীবন সংগ্রাম, নগরজীবনের আর্থ-সামাজিক টানাপড়েন, মানবিক মূল্যবোধ, শরণার্থী জীবনের দুঃসহতা। তাঁর লেখায় একইসঙ্গে বাঙময় হয়েছে শহর ও গ্রামীণ জীবনের দৃশ্যপট। আঞ্চলিক ভাষায়ও তিনি তাঁর মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন।    
আবেগ, উচ্ছ্বাস, ভালোবাসা যে সুধীর কৈবর্ত দাসকে দারুণভাবে আপ্লুত করে, সেটা অনুধাবন করা যায় তাঁর কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করলে। তাঁর কবিতায় প্রেম-প্রীতি, পরিবেশ-প্রকৃতি, দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা, শ্রম-ঘাম, চাওয়া-পাওয়া, বঞ্চনা-লাঞ্ছনা, আক্ষেপ, হাহাকার মূর্ত হয়ে ওঠেছে। একইসঙ্গে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের লড়াই-সংগ্রাম-মুক্তিযুদ্ধও স্থান করে নিয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রেমিক, বিপ্লবী, সামাজিক, রাজনৈতিক ও মানবিক সত্তা। গদ্য ও পদ্যে তিনি যে সমান দক্ষ, সেটাও বুঝতে পারা যায়।

সুধীর কৈবর্ত দাসের হৃদয়ে সাহিত্যের বীজ রোপিত হয় তরুণ বয়সে। ১৯৬৭ সালের মে মাসে শিশু-কিশোর সাহিত্যপত্র মাসিক ‘মুকুল’-এ ছাপা হয় তাঁর প্রথম লেখা ‘আগন্তুক’। রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাগত কারণে লেখালেখিতে তিনি নিয়মিত ছিলেন না। তবে সাহিত্যিক পরিম-লে বরাবরই তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ। ১৯৭৮ সালে নিজের উদ্যোগে প্রকাশ করেন সাহিত্য পত্রিকা ‘তমসুক’। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। আশির দশকে অনিয়মিতভাবে গল্প লেখা শুরু করেন। গল্পকার হিসেবে তাঁর মধ্যে সম্ভাবনা থাকলেও তিনি তাতে গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন নি। সেই সময় থেকে দেশের প্রধান বইয়ের বাজার বাংলাবাজারের সঙ্গে নানাভাবে তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে নর্থগ্রুপ হলের সর্বজনীন পূজা কমিটির পূজা সংখ্যা ‘শঙ্করী’ এবং সংঘমিত্র পূজা কমিটির পূজা সংখ্যা ‘অকালবোধন’ পত্রিকার সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। দীর্ঘ দিন তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৩ সাল থেকে প্রকাশনা সংস্থা ‘অক্ষরবৃত্ত’-এর তিনি ছিলেন অন্যতম কাণ্ডারি। এ প্রতিষ্ঠান থেকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সহ দেশবরেণ্য অনেক লেখকের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। নানা কারণে সম্ভাবনাময় এই প্রকাশনা সংস্থাটি দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। বছর পাঁচেক আগে জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে প্রকাশিত ‘কবিতাপত্র’ পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠলে তিনি নতুন করে নিমগ্ন হন কবিতার ভুবনে। আর এখন তো লেখালেখিটা হয়ে ওঠেছে তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী। জাতীয় প্রেস ক্লাবের মিডিয়া সেন্টারে গেলে দেখা যায়, কম্পিউটারের মনিটরের সামনে ধ্যানস্থ হয়ে আছেন তিনি। হয় লিখছেন নতুন কোনো কবিতার পংক্তি কিংবা বাবুই পাখির মতো বুনে চলছেন গল্পের নকশা। কখনো কখনো সুরেলা কণ্ঠে গুন গুন করে চলেছেন মান্না দে কিংবা পুরানো দিনের কোনো জনপ্রিয় গানের কলি। তখন তাঁকে একদমই অচেনা মনে হয়।          
আবুল হাসানের কবিতা ‘আবুল হাসান’-এর অমর সেই পংক্তি ‘সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জলতা ধরে আর্দ্র’ অনেকটাই যেন খাপ খেয়ে যায় সুধীর কৈবর্ত দাসের সঙ্গে। তাঁকে ‘পাথরমানব’ মনে হলেও বুকের মধ্যে যে লালিত্য, যে মাধুর্য, যে সৌন্দর্য তিনি বয়ে বেড়ান, তার নাগাল সবার পক্ষে পাওয়া সম্ভব হয় না। তবে তাঁর গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশিত হচ্ছেন একজন আশেক, একজন অনুভূতিশীল, একজন হৃদয়বান সুধীর ‘কুমার’ দাস। সরি, সুধীর কৈবর্ত দাস।