পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

এখন সময় টি-টুয়েন্টি ভালোবাসার




ফাগুনের তখন এত ঘনঘটা ছিল না। নির্ধারিত দিনক্ষণ ছিল না ভালোবাসারও। তাতে কি ফাগুন অনুভব করা যেত না? ভালোবাসা কি ছিল না? রাস্তার পাশে কৃষ্ণচুড়া যখন রাঙিয়ে দিয়েছে চারপাশ আর ভেসে এসেছে কোকিলের মধুর কণ্ঠ, তখন বুঝতে পারা গেছে ‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে’। আনুষ্ঠানিকভাবে বসন্ত বরণ করা না হলেও দেহ-মনে ছুঁয়ে যেত বাসন্তী হাওয়া। তাতে বুকের মধ্যে যেন কেমন কেমন করতো। হিল্লোলিত হতো সুরেলা আমেজ। প্রাণে প্রাণে বয়ে যেত খুশির নহর। আর ঢাক-ঢোল পিটিয়ে না থাকলেও ভালোবাসা তো চিরকালই ছিল। আছে। থাকবে।

প্রাণের অস্তিত্ব থাকলে ভালোবাসা না থাকার কোনো কারণ নেই। যুগে যুগে ফুটেছে ভালোবাসার গোলাপ। আবার না ফোটাও থেকে গেছে কত কত। ঝরে গেছে কুঁড়ি হয়ে। ভালোবাসায় কেউ সফল। কেউ ব্যর্থ। তাতে ভালোবাসার কোনো হেরফের হয় নি। যে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছে, তার কাছে ভালোবাসার প্রাপ্তিটা একরকম। আর যে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে নি, তার কাছে ভালোবাসার অপ্রাপ্তিটা অন্যরকম। এই বিপরীতধর্মীতাই ভালোবাসার সৌন্দর্য। পাওয়াটাই সবটুকু নয়, না পাওয়ার মধ্যেও ছিল ভালোবাসার অন্য রকম মাধুর্য।
 
কিন্তু ভালোবাসার অনুভব, অনুভূতি, অনুরণন তো সব কালে, সব যুগে, সব সময়ে একই রকম ছিল। তবে ভিন্নতা প্রকাশের। ভিন্নতা আবেগের। ভিন্নতা দৃষ্টিভঙ্গির। ভালোবাসা তো আবেগেরই রূপান্তর। কতভাবেই না ছড়িয়েছে ভালোবাসার রং। কতভাবেই না ভালোবাসা ছুঁয়েছে একে অপরের হৃদয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের মতো ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে-।’ আমি যে সময়টার কথা বলছি, তখন ভালোবাসার গভীরতা, তীব্রতা ও স্পন্দন ছিল অন্য মাত্রার। আবেদন ছিল অন্য রকম।
অবশ্য নিজের সময়কে অনেকের কাছেই সেরা মনে হতেই পারে। তবে এটাও ঠিক, তাতে সব কিছুতেই অতীতের একটা ধারাবাহিকতা ছিল। যুগের পর যুগ এ ধারাটাই অনেকটাই বহমান ছিল। ভালোবাসায় আড়াল, গোপনীয়তা, সংশয়, দ্বিধা-দ্বন্ধ ও রহস্যময়তাই ছিল মুখ্য। এখন তো আগের সব কিছুই ভেঙেচুরে গেছে। তছনছ হয়ে গেছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আমূল বদলে গেছে জীবনধারা। অতীতের সঙ্গে এখন কিছুই মেলে না।

তখন তো এত সহজে ভালোবাসা গড়ে ওঠতো না। দু’টি হৃদয় একীভূত হতে অনেক সময় লাগতো। ভাঙতেও। খুব সামান্যতেই ভালোবাসা হয়ে ওঠতো অসামান্য। কখনো চুড়ির একটুখানি রিনঝিন শব্দ শুনতে পেয়ে, কখনো এক পলক দেখতে পেয়ে, কখনো আয়ত চক্ষুতে মুগ্ধ হয়ে, কখনো মুক্ত ঝরানো হাসিতে অভিভূত হয়ে, কখনো একটি চিরকুট পেয়ে, কখনো একটু কথা বিনিময় হলে বুকের মধ্যে জ্বলে ওঠতো ভালোবাসার দীপাবলি। ঝগড়াঝাটি বা তিক্ততা থেকেও সূত্রপাত ঘটেছে ভালোবাসার। আসলে কার সঙ্গে কীভাবে গড়ে ওঠেছে ভালোবাসা, সেটার রকমারিতা, বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যতা ছিল অন্তহীন। কে কীভাবে, কোথায়, কখন ভালোবাসার মায়াডোরে বাঁধা পড়েছে, তা একমাত্র জানতেন প্রেমের দেবতা কিউপিড। তবে যেভাবেই যোগাযোগ বা সম্পর্ক গড়ে ওঠুক না কেন, সেটা ভালোবাসায় পরিণত হতে ঢের ঢের সময় লেগে যেত। এজন্য কত সময়, কত অনুনয়-বিনয়, কত জট-জটিলতা, কত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আসতে হয়েছে। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে এক জীবন। তবুও অধরা হয়ে থেকেছে ভালোবাসা। দীর্ঘ দীর্ঘ প্রহর কেটেছে ব্যাকুলতা নিয়ে, মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলাও হয় নি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানের মতো, ‘আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি/আর মুগ্ধ হয়ে চোখে চেয়ে থেকেছি।’ এই দেখা, এই চেয়ে থাকা কিংবা মনে মনে ছবি এঁকে যাওয়াটাই ছিল ভালোবাসা।

অনেক অপেক্ষা, অনেক অস্থিরতা, অনেক দ্বিধা-দ্বন্ধ, অনেক যাতনা সয়ে বাইতে হতো ভালোবাসার তরি। সব সময় তরি তীরে ভিড়ানো সম্ভব হয়ে ওঠতো না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুয়ে দুয়ে চারও হতো না। দু’জনার দু’টি পথ দু’টি দিকে বেঁকেই যেত বেশি। তারপর কারো পথ হতো আলোয় ভরানো। আবার কারো পথ আঁধারে যেত ঢেকে। আঁধারে ঢেকে গেলেও ভালোবাসাটুকু একদমই উবে যেত না। না পাওয়ার সেই বেদনাটুকু বুকের মধ্যে থেকে যেত। মনের মধ্যে চিরকালীন একটা দাগ অন্তত কাটতো। পারতপক্ষে একজনকে হৃদয় দেওয়ার পর সেই হৃদয় অন্য কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করা সম্ভব হতো না।

সাধারণত এক জীবনে একাধিকবার ভালোবাসা জড়ানো হয়ে ওঠতো না। এটা ছিল আবেগগত ব্যাপার। কবি জসীমউদ্দীনের কলমে ফুটে ওঠেছে এই আবেগ, ‘মন সে তো নহে কুমড়ার ফালি/যাহারে তাহারে কাটিয়া বিলান যায়’। তখনকার সময়টাই ছিল এমন। হয়তো সামাজিক নিয়মে অন্য কারো সঙ্গে সংসার হয়েছে। জীবনও একরকম কেটে গেছে। কিন্তু প্রথম ভালোবাসার অনুভূতিটা হারিয়ে যায় নি। বিরহের রেশও থেকে গেছে। তা সযতনেই সাজানো থাকতো হৃদয়ের সিন্ধুকে। কখনো কখনো একান্তে নিভৃতে ভালোবাসার সেই অনুভূতি, সেই যাতনা হয়ে ওঠেছে যেন মধুময় ভিনটেজ। তাতে না পাওয়ার কষ্টটুকু যেমন থাকতো, তেমনিভাবে থাকতো ফেলে আসা সেই দিনগুলোর মৌতাত। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়, ‘প্রেম কি কখনও জীবনের পিছ ছাড়ে?’ নিখাদ ভালোবাসা আদপেই ছাড়তে পারে না। আবার এর রেশ কাটিয়ে ওঠতে না পেরে অনেকের জীবন হয়ে যেত এলোমেলো।
এখন তো বদলে গেছে ভালোবাসার ধরন। অবশ্য সময় তো সব কিছুই বদলে দেয়। ভালোবাসাইবা বদলাবে না কেন? এখন তো ভার্চুয়াল জগত। বিভিন্ন মাত্রিক এক দুনিয়া। ভালোবাসাও হয়ে ওঠেছে ভার্চুয়াল। কল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার সামান্য হেরফের হলেই সৃষ্টি হয় বিভ্রম। ভালোবাসা গড়ে ওঠতে খুব বেশি সময় নেয় না। চোখে চোখ রাখার প্রয়োজন পড়ে না। কথাও বলতে হয় না। জানা-শোনাও লাগে না। গভীর-গোপন অনুভূতি না থাকলেও চলে। সব কিছুই এখন ঝটপট হয়ে যায়। ইনস্ট্যান্ট নুডলসের মতো।

ভালোবাসার মাধ্যম হয়ে ওঠেছে মূলত কী বোর্ড। ফেসবুকের চটকদার ছবি দেখে কিংবা একটুখানি চ্যাটিং হলেই হয়ে যায় রিলেশনশিপ বা লভ। অন্যভাবেও প্রপোজ করা হয়। তবে প্যাটার্নটা একই। তারপর পিজ্জা, কোক আর সেলফি। তাতে ছয়লাপ হয়ে যায় ফেসবুক। তা দেখলে এক একটা যুগলের মনোভাব এমন মনে হবে, ‘মোরা আর জনমে হংস-মিথুন ছিলাম/ছিলাম নদীর চরে/যুগলরূপে এসেছি গো আবার মাটির ঘরে’। কী উচ্ছ্বাস! কী উল্লাস! কী উদযাপন! অথচ কিছু দিন যাওয়ার পরই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রিলেশন ব্রেকÑআপ হতে সময় লাগে না। এমনকি সরাসরি নির্দ্বধায় মেসেজ দেওয়া হয়, ‘আই থিঙ্ক উই নিড টু ব্রেক আপ.....’। তা নিয়ে সাধারণত কারো কোনো কষ্ট বা মনোবেদনাও খুব একটা থাকে না। আর একান্তই যদি কারো একটু মন খারাপ হয়, তাহলে ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়া হয়, ‘ফিলিং ব্যাড’। এটাই যেন খুবই স্বাভাবিক।

সময়টা এখন এমন, কেউ আর দেবদাস হন না। বরং অপেক্ষার তালিকায় থাকেন অন্য কোনো পার্বতী। আর মেয়েদের জন্য তো ফ্রেন্ড লিস্টের সার বেধে থাকা রোমিওরা আছেনই। রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসে ‘সিঙ্গেল’ সিলেক্ট করে দিলেই হলো। তারপর আঙুলের একটুখানি চাপাচাপিতে চোখের পলকেই গড়ে ওঠে সম্পর্ক। ক’দিন যাবার পর আবার সেই পুনরাবৃত্তি। ফেসবুক ভালোবাসা গড়ে ওঠতে যেমন খুব বেশি সময় লাগে না, তেমনিভাবে দূরে সরে যেতেও সময় নেয় না। এই রিলেশনশিপ বা ব্রেক-আপ যেন একটা মামুলি ব্যাপার। উপরন্তু কার হিসেবের খাতায় কতটা ‘রিলেশন’ বা ‘ক্রাশ’ যোগ হয়, সেটাই হয়ে ওঠে বড়াই করার মতো বিষয়। কেউ কেউ ভালোবাসার অন্তরঙ্গ ছবি বা ভিডিও চাউর করে দিতে একটুও দ্বিধা করেন না। তাতে যদি ‘লাইক’ বা কমেন্টস বেশি পাওয়া যায়, সেটাও বড় একটা অর্জন মনে করা হয়।
এখন তো টেস্ট ক্রিকেটের রোমান্টিকতার কদর নেই। এটা উপভোগ করার মতো সেই ধৈর্য নেই। সেই আবেগও নেই। ওয়ান ডে ক্রিকেটের উত্তেজনাও ক্রমশ যেন ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছে। সেই উত্তাপ নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। সেই উচ্ছ্বাসও থিতিয়ে এসেছে। সময়টা এখন টি-টুয়েন্টির। সময় কম। ব্যাপক বিনোদন। উত্তেজনাও বেশি। মূলত জীবনের সব ক্ষেত্রেই অনুসৃত হচ্ছে এই ধারা। ভালোবাসাইবা কেন ক্রিকেটের ক্ষুদ্র এই সংস্করণকে অনুসরণ করবে না? দ্রুতই যদি সব কিছু পাওয়া যায়, চট করে ঘটে যায় সমুদয়, কে আর অপেক্ষার প্রহর গোনে? টি-টুয়েন্টির মূলমন্ত্র, হয় ছক্কা না হয় অক্কা। এই মূলমন্ত্রকে অনুসরণ করা হচ্ছে হাল আমলের ভালোবাসায়। টইটুম্বুর ভালোবাসা মুহুর্তেই নেই হয়ে যেতে একদমই সময় লাগে না। অনেকটা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো।

এখন ফাগুন আসে বিপুলভাবে উদযাপনের উপলক্ষ নিয়ে। ভ্যালেনটাইন ডে আসে ভরপুর ভালোবাসা নিয়ে। তার সঙ্গে যুক্ত হয় ভার্চুয়াল লভ। সব মিলিয়ে বসন্তের টি-টুয়েন্টি জম্পেশ ককটেল। তাতে থাকে ফেনিল মদিরতা। থাকে উৎসবের আমেজ। থাকে আনন্দময় কোলাহল। রঙদার হয়ে ওঠে চারপাশ। উদ্বেলিত হয়ে ওঠে পরিপার্শ্ব। ঢেউ খেলে যায় রোমান্টিকতার। অতি সুলভে জীবনকে রাঙানোর এমন সুযোগকে কে আর হাতছাড়া করতে চায়? সঙ্গত কারণে তাতে প্রতিধ্বনিত হয় তারুণ্য আর যৌবনের উচ্ছ্বাস, উল্লাস, উদ্দাম। তবে আমরা যারা বুকের মধ্যে টেস্ট ক্রিকেটের ভালোবাসার রোমান্টিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠেছি, তাদের কাছে টি-টুয়েন্টি ভালোবাসার রোমাঞ্চকে ঈশপের গল্পের মতো আঙুর ফলকে টক মনে হতেই পারে।            
           

বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

আমার বইমেলা





বাংলা একাডেমির বইমেলার সঙ্গে বয়সোচিত কারণেই সহজাতভাবেই আমাদের প্রজন্মের একটা আত্মিক বন্ধন গড়ে উঠে। কলেজে উঠার পর পরই বইমেলা হয়ে উঠে তারুণ্যের প্রাণপ্রাচুর্যের বিচরণক্ষেত্র। সেই সময় নিজের মনে করে সবে ক্ষমতার দখল নেন সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ। সাইকেল চালিয়ে আর কবিতা লিখে তিনি যতই সর্বসাধারণের মন জয় করার চেষ্টা করুন না কেন, ছাত্র সমাজ তাঁকে একদমই মেনে নিতে পারেন নি। ছাত্রদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কলাভবন থেকে শিক্ষা ভবন অভিমুখে ছাত্রদের মিছিলে ট্রাক তুলে দেয় পুলিশ। জাফর, জয়নাল, দীপালিরা জীবন দিলে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভের আগুন। সেই আগুনের আঁচে এলোমেলো হয়ে যায় জমজমাট বইমেলা। সেদিনও ছিলাম বইমেলায়। আর বাংলা একাডেমির বইমেলা ছিল এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার।
রাজপথ উত্তাল হয়ে উঠার পাশাপাশি বইমেলা প্রাঙ্গণে তার উত্তাপ দারুণভাবে টের পাওয়া যেত। কবি মোহন রায়হানদের সাহসী তৎপরতা তো ছিল। কবি-লেখকদের কলমে ছিল তীব্র ঝাঁজ। আবৃত্তিকারদের কণ্ঠের নিনাদে প্রকম্পিত হয়েছে পুরো চত্বর। আর তখন তো লিটল ম্যাগাজিনের স্বর্ণযুগ। তাতেও থাকতো প্রতিবাদী সব লেখা ও কার্টুন। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ তো ছিলই। আমাদের তখন তরুণবেলা। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ আমাদের দারুণভাবে নাড়িয়ে দিত। বইমেলায় গেলে মনে হতো, আমিও বুঝি আন্দোলনের অংশীদার। এ কারণে বইমেলা আমাদের চুম্বকের মতো টানতো। তাছাড়া কত কত বইয়ের স্পর্শ ও সুঘ্রাণ মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতো। (অথচ কী এক অদ্ভুত কারণে ক্লাসের পাঠ্য বইয়ের স্পর্শ তো দূরে থাক, ঘ্রাণ নিতে একটুও ইচ্ছে করতো না।) তখন তো আর বইমেলায় খুব বেশি বই প্রকাশিত হতো না। মোটামুটিভাবে সব বই ও লেখকের খোঁজ-খবর রাখাটা মোটেও কঠিন ছিল না। সেটাও এক ধরনের আনন্দ ছিল বৈকি।
বইমেলা যখন সাবালক হয়ে উঠতে থাকে, তখন থেকেই তাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়। সঙ্গত কারণে আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে একুশের বইমেলা। সেই থেকে বইমেলার সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক কখনই শিথিল হয় নি। বরং বদলে গেছে ভূমিকা। শুরুর দিকে কেবলই দর্শক হিসেবে বইমেলায় গেলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পকর্টা গভীরতর হয়েছে।
বইমেলা উপলক্ষে কত কিছু যে আয়োজিত হতো। বিভিন্ন রকমের অনুষ্ঠান ও কর্মকাণ্ডে সরগরম থাকতো বাংলা একাডেমি এবং সংলগ্ন এলাকা। নাটকের একটি মঞ্চ গড়ে তোলার জন্য অভিনেতা শংকর সাঁজোয়ালের নেতৃত্বে ‘কারক’ নাট্যগোষ্ঠীর বিদ্রুপাত্নক পথনাটক দারুণ উপভোগ করেছি। এজন্য লাল সালুতে টাকা-পয়সা ভালোই জমতো। সেই মঞ্চ কি গড়ে উঠেছে? তাছাড়া মেলায় আগত শিল্প-সাহিত্য-নাটক-সংস্কৃতি-সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি জগতের দূরের মানুষদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়। কত খ্যাতিমান ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব যে আসতেন। লেখক ইমদাদুল হক মিলন, হুমায়ূন আহমেদ, তসলিমা নাসরিনদের তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তাও দেখেছি। মনে পড়ে, শাড়ি পরা তসলিমা নাসরিনকে প্রথম যেদিন মুগ্ধ হয়ে দেখি, তাঁকে কেন্দ্র করে স্বভাববিরুদ্ধভাবে একপাক ঘুরপাক খেয়েছিলাম। কবি নির্মলেন্দু গুণের হাত ধরে কন্যা মৃত্তিকা গুণ, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদারের সঙ্গে কন্যা ত্রপা মজুমদারকে অনেক দিন দেখেছি। এই কিশোরী কন্যারা এখন কত বড় হয়ে গেছেন! সে সময় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে দেখতে পাওয়া ছিল রোমাঞ্চকর একটি ব্যাপার। 
   

বইমেলা উপলক্ষে লিটল ম্যাগাজিনের ঢেউ আমার বুকেও দোলা দিয়ে যায়। কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই ১৯৮৩ সালে ‘আবাহন’ নামে একটি সাহিত্য সংকলন প্রকাশের উদ্যোগ নেই। সেই সুবাদে বাংলা একাডেমি চত্বরে যাতায়াত বেড়ে যায়। একে একে পরিচিত হতে থাকি নবীন-প্রবীণ লেখকদের সঙ্গে। বিশেষ করে কবি আবিদ আজাদ, ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন সহ প্রমুখের সঙ্গে সম্পর্কটা দীর্ঘস্থায়ী হয়। এছাড়াও বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়। সাহিত্য জগতের অনেক অভিসন্ধিও নজরে আসে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এক বছর পর সংকলনটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়। বইমেলায় সংকলনটি নিয়ে যাওয়ার পর নিজেকে সাহিত্য জগতের কেউকেটা মনে হতে থাকে। বইমেলার সঙ্গে অনেক বেশি নিবিড়তা অনুভব করতে থাকি। মনে হতে থাকে, এত দিনে বইমেলার একজন হতে পেরেছি।
১৯৯০ সালে সাবের হোসেন চৌধুরী সম্পাদিত (প্রধান সম্পাদক ছিলেন কবি শামসুর রাহমান) সাপ্তাহিক মূলধারা পত্রিকার রিপোর্টার হয়ে অনেক লেখক-সাহিত্যিক-প্রকাশকের খণ্ড খণ্ড সাক্ষাৎকার নিয়েছি। এরপর থেকে পেশাগত কাজে অসংখ্যবার বইমেলা চত্বরে যেতে হয়েছে।     
               

বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পর একুশে বইমেলা উপলক্ষে ক্রীড়া বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশ করার উদ্যোগ নেই। তারই অংশ হিসেবে ১৯৯৩ সালে ২৬ জন লেখকের লেখা নিয়ে ‘খেলার কথা কথার খেলা’ এবং পরবর্তীতে বাংলা ভাষায় সম্ভবত প্রথম ক্রীড়া বিষয়ক ছড়াগ্রন্থ কবি সানাউল হক খানের ‘ছন্দে ছন্দে খেলার আনন্দে’ প্রকাশ করা হয়। আর বই বিক্রির জন্য ১৯৯৩ সালে প্রথম সমিতির উদ্যোগে বইমেলায় স্টল নেওয়া হয়। তাতে শুধু সমিতির নয়, অন্যদের লেখা ক্রীড়া বিষয়ক বই নিয়ে সাজানো হয় সেই স্টল। সব দিক দিয়ে এটি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী একটি প্রয়াস। এছাড়া বই বিক্রি করার অভিনব একটি কৌশলও নেওয়া হয়। প্রতিদিন কোনো না কোনো ক্রীড়া তারকা ক্রীড়ালেখক সমিতির স্টলে উপস্থিত থাকতেন এবং বইয়ের ক্রেতাদের অটোগ্রাফ দিতেন।


তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ফুটবলার আশরাফউদ্দীন চুন্নু, সালাম মুর্শেদী, শেখ মোহাম্মদ আসলাম, কায়সার হামিদ, মোনেম মুন্না, রুমি রিজভী করিম, ইমতিয়াজ সুলতান জনি, রক্সি, ক্রিকেটার ওমর খালেদ রুমি, গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, ব্যাডমিন্টনের কামরুন্নাহার ডানা, টেবিল টেনিসের জোবেরা রহমান লিনু। এঁদের কেউ কেউ এসেছিলেন সপরিবারে। সবচেয়ে সাড়া জাগিয়েছিল সে সময়কার সুপারস্টার সদ্য বিবাহিত মোনেম মুন্না ও কায়সার হামিদের উপস্থিতি। এই দুই দম্পতির হাতের মেহেদির রং তখনও টাটকা ছিল। মুন্না সস্ত্রীক মেলায় যে দিন স্টলে বসেছিলেন, সেদিন আমাদের স্টলকে কেন্দ্র করে পুরো মেলা যেন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিতরা এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়। এ কারণে সম্ভবত মেলার আয়োজকরা আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিল।  
 

১৯৯৩ সালেই প্রকৃত প্রকাশক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করি। সে সময় বেশ সুখ্যাতিও অর্জন করি। এ কারণে বইমেলার সঙ্গে সম্পর্কটা আরো দৃঢ়তর হয়। আর প্রকাশক হওয়ার পেছনে অবদান রাখেন লেখক ও সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। ১৯৯২ সালে দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের জনক কে?’ শিরোনামে একটি লেখা। আলোচিত এ বিষয়টি নিয়ে তখন সর্বত্র তোলপাড় চলতে থাকে। সেই আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করে এ লেখাটি। হঠাৎ মাথায় এলো, এ লেখাটিকে বই আকারে প্রকাশ করলে কেমন হয়? বাংলার বাণীর সাংবাদিক সহকর্মী সুধীর কৈবর্ত দাস, প্রণব সাহা, নান্টু রায়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করলে তাঁরা সায় দেন। এরপর আর এগিয়ে যেতে সময় লাগে নি। চারজনের অর্থে গড়ে উঠে ‘অক্ষরবৃত্ত’ প্রকাশনী। এই প্রকাশনীর উদ্যোগে লেখকের অনুমোদন নিয়ে বইমেলা উপলক্ষে ‘আমরা বাংলাদেশী না বাঙালি?’ বইটি প্রকাশ করা হয়। যদিও আমাদের কোনো স্টল ছিল না। তারপরও মেলায় বইটি হটকেক হয়ে ওঠে। একাধিক সংস্করণও ছাপতে হয়। একটি প্রবন্ধের বই এতটা সাড়া জাগাবে, এটা আমাদের ধারণায় ছিল না।
তখন দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় বইমেলা কাভার করতেন জনপ্রিয় ছড়াকার ও লেখক লুৎফর রহমান রিটন। তিনি এ বইটিকে কেন্দ্র করে প্রকাশক হিসেবে আমার এক টুকরো সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। এ বইটি দিয়ে আমরা বেশ মুনাফা করতে সক্ষম হই। সেটা হয়ে যায় আমাদের ভালো একটা পুঁজি। প্রকাশনা ব্যবসায় আমরা বেশ উৎসাহী হয়ে ওঠি। পরের বছর থেকে আমরা বইমেলায় নিজেরাই স্টল নেওয়া শুরু করি। দৈনিক বাংলার বাণীতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর স্মৃতিচারণমূলক লেখা ‘ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা’ও আমরা প্রকাশ করার অনুমতি পাই। এ বইটিও পাঠকরা লুফে নেন। কিন্তু এরপর কোনো বিবেচনা ছাড়াই আমরা একের পর এক গ্রন্থ প্রকাশ করতে থাকি। যার তেমন কোনো পাঠক চাহিদা ছিল না। সব মিলিয়ে বোধকরি ১৮টি বই হবে। এ কারণে আমাদের মূলধন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। তাছাড়া প্রকাশক চার জন হলেও সব চাপ গিয়ে পড়ে বাংলা বাজার এলাকায় সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব সুধীর কৈবর্ত দাসের কাঁধে। প্রকৃতঅর্থেই ‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ’ তাঁকেই করতে হয়। আর আমরা বাকি তিন প্রকাশক অনেকটা মেহমান হিসেবে মাঝে-মধ্যে স্টলে চেহারা দেখাতে যেতাম। খোঁজ-খবর খুব একটা নিতাম না। যদিও বইয়ের ব্যবসার প্রসার বাড়তে থাকে। কিন্তু একার পক্ষে এ ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া সুধীর দা’র পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। ব্যবসায় লালবাতি জ্বলতে সময় লাগে নি। এ কারণে প্রকাশক হিসেবে বইমেলার সঙ্গে ২০০০ সালের পর আর সম্পর্ক থাকে নি।
 

১৯৯৮ সাল থেকে বইমেলার সঙ্গে গড়ে ওঠে নতুন এক সম্পর্ক। সে বছর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয় আমার প্রথম গ্রন্থ ‘দেখা হলো লংকায়’। ভ্রমণবিষয়ক এ গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংযোজন না হলেও বাংলা একডেমির বইমেলায় অভিষেক হয় একজন লেখকের। তবে এটা তো ঠিক, অভিষেক হওয়ার আনন্দ অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা চলে না। যদিও অভিষিক্ত ক্রিকেটারদের মতো মাথায় কেউ ক্যাপ পরিয়ে না দিলেও অদৃশ্য এক ক্যাপ নিজেকে নিজেই পরিয়ে দেই। লেখক হিসেবে বইমেলার সঙ্গে সেই যে হার্দিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সেটা আর কাটিয়ে ওঠা যায় নি। এখন তো আর আগের সেই দিন নেই। বইয়ের প্রচার-প্রচারণায় লেখক নিজে সক্রিয় না হলে বইয়ের নাকি কাটতি হয় না। কিন্তু এই দক্ষতা আজও অর্জন করতে পারলাম না।


তবে ২০০৫ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয় আমার দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘স্টেডিয়ামের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমির বটতলায় বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাতে উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, কবি হালিম আজাদ সহ অন্যরা।
সম্ভবত ২০০৮ সালে বাংলা একাডেমি চত্বর দিয়ে একদিন হাঁটাহাঁটির সময় পরিচিত ছড়াকার ও লেখক আমিরুল ইসলাম ঠেলেঠুলে লুৎফর রহমান রিটন ভাইয়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন। ২০০৪ সাল থেকে চ্যানেল আই বাংলা একাডেমি চত্বর থেকে সরাসরি বইমেলা সম্প্রচার করা শুরু করে। এ অনুষ্ঠানের প্রযোজক আমিরুল ইসলাম। আর দীর্ঘ এক দশক এর উপস্থাপক রিটন ভাই। বিস্মিত, বিস্রস্ত ও বিভ্রান্ত আমি সেদিন নিজের বই সম্ভবত ‘আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও’ এবং ক্রীড়া বিষয়ক প্রকাশনা নিয়ে কী বলেছিলাম, সেটা আজ আর স্মরণ নেই। বইমেলায় প্রিন্ট ও ইলেকট্রোনিক মিডিয়ায় যে দু’বার সাক্ষাৎকার দেই, ঘটনাক্রমে দু’বারই সাক্ষাৎকার নেন আমার একজন অত্যন্ত প্রিয় মানুষ রিটন ভাই। তবে এরপর আর নিজের বই নিয়ে বইমেলায় কখনও কোথাও কিছু বলতে হয় নি।
তারপর থেকে মাঝে-মধ্যে নিজের বই প্রকাশিত হওয়ায় বইমেলার সঙ্গে আবেগগত ও ভালোবাসার একটা বন্ধন গড়ে উঠেছে। তাছাড়া মনের মধ্যে একটা লেখক লেখক ভাবও বোধকরি এসে গেছে! বইমেলা এলে কাছের জনরা জানতে চান, এবার কী বই বের হচ্ছে? এটাও কি কম আনন্দের? বিভিন্ন সময়ে বদলেছে বইমেলার নামকরণ। সাম্প্রতিক সময়ে বইমেলার ব্যাপ্তি বেড়েছে। বিশালত্ব বেড়েছে। বইয়ের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু সৃজনশীল বইয়ের পাঠক কি বেড়েছে? তবে বইমেলা এলে এখনও বুকের মধ্যে উড়তে থাকে রঙিন প্রজাপতি। যতই কাজে ব্যস্ত থাকি না কেন, নতুন প্রেমে পড়া কিশোরের মতো বইমেলায় ঢু মারার জন্য মনটা সারাক্ষণ উচাটন হয়ে থাকে। আর প্রেমিকা যখন অপেক্ষায় থাকে, তখন যত কাজই থাকুক না কেন, ছুটে না গিয়ে কি পারা যায়?
  

ক্রীড়া সাংবাদিকতার রূপান্তর





ইংরেজ লেখক-দার্শনিক স্যার ফ্রান্সিস বেকন ১৫৯৭ সালে বলেছিলেন, ‘নলেজ ইজ পাওয়ার’। তাঁর কথাটাকে একটু বদলে এখন বলা হয়, ‘ইনফরমেশন ইজ পাওয়ার’। এটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না, আজকের পৃথিবীতে তথ্যের অমিত শক্তি। চারপাশেই তা অনুভব করা যায়। বিশ্বায়নের খোলা জানালা দিয়ে আমরা যে ‘বিশ্বগ্রাম’-এর বাসিন্দা হয়ে ওঠেছি, সে তো তথ্যের শক্তির ওপর ভিক্তি করে। প্রিন্ট, ইলেকট্রোনিক মিডিয়ার পাশাপাশি অনলাইনের মাধ্যমে তথ্যের অনেক বেশি বিকাশ ঘটছে। একই ধারায় ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নেওয়া ও জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রেও মিডিয়া রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে যে কোনো খেলা হোক না কেন, মিডিয়ার কল্যাণে তার সর্বশেষ তথ্য নিমিষেই সবার কাছে অনায়াসেই পৌঁছে যায়। এ ম্যাজিকটা সম্ভব করেছেন ক্রীড়া সাংবাদিকরা।
মেঘে মেঘে বেলা তো আর কম হলো না। ব্রিটিশ ভারতে সূচনা ঘটে ক্রীড়া সাংবাদিকতার। একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় ১৮৫৪ সালের এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে একটি ফুটবল ম্যাচের খবর প্রকাশ হয়। এ দিয়ে শুরু এ অঞ্চলে ক্রীড়া সাংবাদিকতা। ছোট্ট পরিসরের খেলার এ খবর প্রকাশ করাটা ছিল বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত। তারপর তো কলকাতা ফুটবলের তীর্থকেন্দ্র হয়ে ওঠলে সংবাদপত্রেও তার প্রতিফলন ঘটে। শুরুতে ফুটবলকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয় বাংলা ক্রীড়া সাংবাদিকতা। অবশ্য ফুটবলের পাশাপাশি অন্য খেলাগুলোও স্থান করে নেয়। সে সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতো অসংখ্য পত্র-পত্রিকা। তাতে ক্রীড়াঙ্গনও গুরুত্ব পেতে থাকে। ব্রিটিশদের সঙ্গে ভারতীয়দের ফুটবল ম্যাচ হয়ে ওঠে ক্রীড়া সাংবাদিকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। ম্যাচ রিপোর্টের পাশাপাশি ছাপা হয় সাদা-কালো ছবি। তবে সব কিছুই কলকাতাকেন্দ্রিক হওয়ায় তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় সংবাদপত্রের প্রসার খুব একটা ছিল না।
সে সময় ঢাকায় পত্র-পত্রিকার বিস্তার ছিল খুবই কম। হাতেগোনা যে কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়, তার সঙ্গে খেলাধুলার খুব একটা সম্পৃত্ততা ছিল না। ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘ঢাকা নিউজ’ ১৮৫৬, ‘বেঙ্গল টাইমস’ ১৮৬০ সালে ও ১৮৬০ সালে প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক ‘কবিতাকুসুমালী’ প্রকাশিত হয়। ১৮৬১ সালে বের হয় ‘ঢাকা প্রকাশ’। খেলাধুলার সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে দীর্ঘায়ুর এ পত্রিকাই ছিল সবেধন নীলমণি। ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম দৈনিক ‘দ্য হেরাল্ড’, বাজারজাত হয় ১৯১৬ সালে। এ ধরনের পত্রিকায় কদাচিৎ খেলার খবর হয়তো থাকতো। তবে তার কোনো হদিস এখন মেলে না। যে কারণে ব্রিটিশ ভারতে ঢাকায় ফুটবল লিগ আয়োজিত হলেও সে সংক্রান্ত তথ্য নেই বললেই চলে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় ঢাকার ক্রীড়াঙ্গনের খবর মাঝে-মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। তা খুব বেশি উল্লেখ করার মতো নয়। ১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর প্রকাশিত দৈনিক আজাদ-এর ঢাকাস্থ প্রতিনিধির পাঠানো খেলার খবর কালেভদ্রে ছাপা হতো। আজাদ-এর পাশাপাশি দৈনিক ইত্তেহাদ, ডেইলি মর্নিং নিউজ ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার পর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সওগাত’ পত্রিকা ক্রীড়া সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভালোই ভূমিকা রাখে। কলকাতা মোহামেডান ক্লাবকে কাভারেজ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ পত্রিকাটির অবদান বেশি। খেলোয়াড়দের ছবি ও প্রোফাইল প্রকাশ করে সাড়া জাগায়।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের ক্রীড়াঙ্গনের পালে লাগে নতুন হাওয়া। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে ক্রীড়া সাংবাদিকতার অবয়ব। তখন তো সংবাদপত্রের সংখ্যা ছিল খুবই সীমিত। উল্লেখযোগ্য হলো সৈনিক, জিন্দেগী, ডেইলি অবজারভার, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক। তবে আজাদ, মর্নিং নিউজ, অবজারভার, সংবাদ, ইত্তেফাক-এর মতো দীর্ঘস্থায়ী পত্রিকাগুলো সমাজমানসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মূলত এ পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে বিকশিত হয় ক্রীড়া সাংবাদিকতার ধারা। সে সময় থেকে প্রথমে খ-কালীন, পরবর্তীতে সার্বক্ষণিক ক্রীড়া সাংবাদিক নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রথম ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে মনে করা হয় দৈনিক আজাদ-এর সৈয়দ জাফর আলীকে। তিনি এ পত্রিকার চিফ রিপোর্টারের পাশাপাশি স্পোর্টস রিপোর্টিং করতেন। বাংলা পত্রিকায় খেলাধুলার খবর খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হতো না। এক কলামের বেশি নিউজ প্রকাশ হওয়াটা ছিল অনেক বড় ব্যাপার। অধিকাংশ দিন কোনো নিউজই থাকতো না। তবে ইংরেজি পত্রিকায় খেলার খবর যথেষ্ট গুরুত্ব পেত। ১৯৪৯ সালের ১৯ মার্চ প্রকাশিত অবজারভার প্রথম খ-কালীন স্পোর্টস রিপোর্টার নিয়োগ দেওয়া হয় কানু কবির (নুরুল কবির)কে। ১৯৫৪ সালে সার্বক্ষণিক স্পোটস রিপোর্টার হিসেবে কুতুবউদ্দীনকে নিয়োগ দেয় মর্নিং নিউজ। এরপর থেকে স্পোর্টস রিপোর্টার নিয়োগের ধারাও গড়ে ওঠে। ভারতের মাটিতে নিজেদের দ্বিতীয় টেস্টেই প্রথম এবং স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাকিস্তানের জয় আর ফজল মাহমুদ, নজর মোহাম্মদ, মাহমুদ হুসাইনের বিস্ময়কর পারফরম্যান্স দারুণভাবে সে সময় সাড়া জাগায়। সংবাদপত্র জগতও নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়। পত্রিকার সীমিত পরিসরের বড় একটি অংশ স্থান করে নেয়। এমনকি প্রথম পৃষ্ঠায় ব্যানার হেডিংও হয়। ১৯৫৫ সালে ভারত, নিউজিল্যান্ড, ১৯৫৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, ১৯৬২ সালে ইংল্যান্ড, ১৯৬৯ সালে ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে পাকিস্তানের টেস্ট ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ায় ক্রিকেটের রূপ-রস-গন্ধে পল্লবিত হয় ক্রীড়া সাংবাদিকতা।
পর্যায়ক্রমে ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগও গুরুত্ব পেতে থাকে। তদানীন্তন পাকিস্তানের ফুটবলের তীর্থকেন্দ্র ছিল ঢাকা। অর্থের প্রলোভনে ঢাকা লিগে খেলার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছুটে আসতেন ফুটবলাররা। জমজমাট হয়ে ওঠে ঘরোয়া ফুটবল। পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানিদের খেলা হলে তা উত্তেজনার বারুদ ছড়াতো। পাঠকদের আগ্রহের কারণে সংবাদপত্রে খেলাধুলার স্পেস বাড়তে থাকে। পঞ্চাশ দশকের শেষদিকে মর্নিং নিউজ আর অবজারভার-এ খেলার জন্য এক পৃষ্ঠা বরাদ্দ করলে ক্রীড়া সাংবাদিককতার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হয়। সে সময় স্পোর্টস এডিটরও নিয়োগ দেওয়া হয়। সবার আগে সাপ্তাহিক খেলার পাতা চালু করে মর্নিং নিউজ। ষাটের দশকের শুরুতে বাংলা পত্রিকার মধ্যে প্রথম এ ধারা অনুসরণ করে দৈনিক আজাদ। ১৯৫৪ সালে ঢাকা স্টেডিয়াম গড়ে উঠলে ক্রীড়াঙ্গনে উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। স্টেডিয়াম এলাকায় ক্রীড়া সাংবাদিকদের আনাগোনা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। তার প্রতিফলন দেখা যায় সংবাদপত্রের পাতায়। ঢাকা লিগ ছাড়াও রোনাল্ডশে শিল্ড, ১৯৫২, ’৫৭, ’৬২ সালে পাকিস্তান ন্যাশনাল ফুটবল, ১৯৫৫ সালে ৪ জাতির কোয়াড্রাঙ্গুলার, ১৯৫৮ সাল থেকে শুরু আগা খান গোল্ড কাপ, ১৯৬৭ সালে আরসিডি টুর্নামেন্টকে কেন্দ্র করে ঢাকার ফুটবলে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ঢাকার মাঠে খেলতে আসে ভিন দেশি শক্তিশালী বিভিন্ন ফুটবল দল। ফুটবল হয়ে ওঠে সংবাদপত্রের প্রধান আকর্ষণ।
১৯৫৫, ’৬০, ’৬৪, ’৬৮ সালে পাকিস্তান ন্যাশনাল গেমস, ১৯৫৫ সালে ঢাকায় অ্যাথলেট জিনাত আহমেদ ও ১৯৫৬ সালে লাহোরে লুৎফুন্নেছা হক বকুলের স্বর্ণ জয়, ১৯৫৮ সাল থেকে ’৬১ সাল পর্যন্ত সাঁতারু ব্রজেন দাসের ৬বার ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে সাড়া জাগান। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাথলেটিকস, সাঁতার সহ বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ক্রীড়া সাংবাদিকদের আকৃষ্ট করে। প্রতিটি ইভেন্টই ক্রীড়া সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। তবে বিদেশি খেলার খবর টাটকা প্রকাশের সুযোগ ছিল না। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার মাধ্যমে নিউজ পাকিস্তানের করাচি হয়ে আসতো। পঞ্চাশের দশকে থেকে পত্র-পত্রিকায় খেলার ছবিও প্রকাশিত হয়। যদিও সার্বক্ষণিক কোনো ক্রীড়া বিষয়ক আলোকচিত্রী ছিল না। পত্রিকায় ১/২জন যে আলোকচিত্রী থাকতেন, তাঁরাই হতেন সকলের কাজের কাজী। ষাট দশকের মাঝামাঝি দৈনিক পাকিস্তান প্রকাশের পর বাংলা পত্রিকায় অনেক বেশি গুরুত্ব পেতে থাকে খেলাধুলা। সেই সঙ্গে দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক জনপদ এগিয়ে আসে।
স্বাধীনতার পর ক্রীড়া সাংবাদিকতায় মৌলিক একটা পরিবর্তন আসে। যদিও নিদিষ্ট সংখ্যক পত্রিকায় অল্প কয়েক জন ক্রীড়া সাংবাদিক দীর্ঘ দিন সংশ্লিষ্ট ছিলেন। যে কারণে খুব একটা বৈচিত্র্য ছিল না। তবে ব্যক্তিগতভাবে কারো কারো উদ্যোগ ও উৎসাহ নজর কাড়তে সক্ষম হয়। পাশাপাশি সাপ্তাহিক, পাক্ষিক পত্রিকাগুলোও ক্রীড়াঙ্গনকে গুরুত্ব দিয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে ক্রীড়া বিষয়ক পত্রিকা। তবে আশির দশক থেকে লেখালেখির ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।        
ক্রীড়া সাংবাদিকতায় দুটি ধারা বরাবরই ছিল। কেউ কেউ এটাকে নিয়েছিলেন পেশা হিসেবে। আবার কারো কারো কাছে এটি ছিল নিছক শখ। অন্য পেশার পাশাপাশি সন্ধ্যার পর ঢাকা স্টেডিয়ামে কিছু সময়ের জন্য ঢু মারতেন। আবার বিনা পয়সায় খেলা দেখতে পারবেন, সেই প্রলোভনেও নাম লেখাতেন ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে। নব্বই দশকেও দেখতে হয়েছে প্রেস রিলিজ সাংবাদিকতা। কোনো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হলে সেই ফেডারেশনের প্রেস রিলিজের জন্য অন্তহীন অপেক্ষা। কোনো কারণে প্রেস রিলিজ না পেলে কিংবা প্রেস রিলিজের সংখ্যা কম হলে অনেকেই হাপিত্যেশ করতেন। কীভাবে পৃষ্ঠা ভর্তি করা যাবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যেতেন। এখনও সে ধারা একেবারেই বিলীন হয়ে যায় নি। অনেক মিডিয়ায় কম টাকায় সাংবাদিক নিয়োগ দেওয়া হয়। ইদানিং ক্রীড়া সাংবাদিকতায় যোগ দিচ্ছেন মেধাবারী। ক্রীড়ালেখনির একটি শক্তিশালী ধারাও রয়েছে। যাঁরা খেলাকে সাহিত্য রসে সিঞ্চিত করে পাঠকদের মুগ্ধ করে যাচ্ছেন।
১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর একটা পালাবদল ঘটে। সংবাদপত্র প্রকাশের কঠিন যে বিধি-নিষেধ ছিল তা শিথিল হয়। এরফলে নিত্য-নতুন যে সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, তাতেও পরিবর্তন আসে। দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে নতুনত্বের একটা ছোঁয়া লাগে। লিটার‌্যালি জার্নালিজমের যে ধারাটা অনুসরণ করা হয়, কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার, আজকাল পত্রিকা আগেই তা প্রচলন করে। প্রতিবেশী রাজ্যের পত্রিকায় রিপোর্টে যতটা না তথ্য থাকে, তারচেয়ে বেশি থাকে গল্প। সে দিক থেকে ব্যতিক্রম আজকের কাগজ এবং পরবর্তীকালে এ ধারার পত্রিকাগুলো। সাহিত্য রস থাকলেও তাতে তথ্যও থাকে। নতুন ধারার এ ক্রীড়া সাংবাদিকতা পাঠকরাও লুফে নেন।
তবে এক একটি পত্রিকাকে কেন্দ্র করেও আবর্তিত হয়েছে ক্রীড়া সাংবাদিকতা। তৈরি হয়েছে নিজস্ব ঘরানা। সময়ের পরিক্রমায় সংবাদপত্রে খেলার পৃষ্ঠা বেড়েছে। কোনো কোনো পত্রিকায় তো রয়েছে চার পৃষ্ঠাও। আগে সংবাদপত্রে ক্রীড়া সাংবাদিকদের খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হতো না। হারাধনের দশটি ছেলের অনাদৃত একটি ছেলে হয়ে থাকতো হতো। কেউ খোঁজ নিতে চাইতো না। এখন ক্রীড়া সাংবাদিকদের সম্মান বেড়েছে। বেড়েছে বিত্ত-বৈভব। প্রথম পার্ট টাইম স্পোর্টস রিপোর্টার যেখানে ৫০ রূপি পেতেন, এখন কোনো কোনো ক্রীড়া সাংবাদিক যে সুযোগ-সুবিধা পান, তা রীতিমতো ঈর্ষাণীয়। ক্রীড়া সাংবাদিক ছাড়া কোনো মিডিয়া এখন ভাবাই যায় না। আগে যেখানে এক-আধজন ক্রীড়া সাংবাদিক দিয়ে কাজ চালানো হতো, এখন দৈনিক প্রথম আলোতে ১৩ ও একাত্তর টিভিতে ১৪ জন কর্মরত আছেন। আশঙ্কাজনক হলো, সংবাদপত্রের সংখ্যা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট টিভির ব্যাপক প্রসার ঘটায় প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য তা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সার্বিকভাবে সংবাদপত্রের এখন আগের মতো কদর নেই। নতুন প্রজন্মের কাছে এটি অনেকটাই উপেক্ষিত। বিশ্বব্যাপী চলছে প্রিন্ট মিডিয়ার মন্দা। অনেক বনেদি পত্রিকা হয় বন্ধ নতুবা ইন্টারনেট সংস্করণ বের হচ্ছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। ওয়েবসাইট, ব্লগ, ফেসবুক, টুইটারের সঙ্গে পাল্লা দিতে হচ্ছে সংবাদপত্রকে। ক্রমশ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। পাঠক কমছে। বাধ্য হয়ে সংবাদপত্রগুলোও অনলাইনে ঝুঁকছে।
প্রিন্ট ও টেলিভিশনের পাশাপাশি বেতার সাংবাদিকতাও ক্রীড়া ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় বেতার সম্প্রচার শুরু হয়। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বেতারে কোনো কোনো খেলা সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। দীর্ঘ দিন যাবৎ বেতার ক্রীড়াঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। হাল আমলে নতুন মেজাজের বেতারে ক্রীড়া সাংবাদিকতা আলাদা একটি স্থান করে নিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ক্রীড়া সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে টেলিভিশন। মার্কিন এক গবেষণায় জানা যায়, মানুষ যা পড়ে তার ১০ শতাংশ মনে রাখে আর যা দেখে তার ৩০ শতাংশ মনে থাকে। এ থেকে টিভির গুরুত্ব সহজেই অনুধাবন করা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, সংবাদপত্র পড়তে হলে শিক্ষিত হতে হয়। টিভি দেখতে হলে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই। টিভি এমন একটি মাধ্যম, যা সহজেই দর্শকদের আকৃষ্ট করতে পারে। বাইরের পৃথিবীকে দেখার জন্য টিভি খোলা জানালার মতো। এ জানালা দিয়ে কোথায় কী ঘটছে, তা আমরা জানতে পারি। দেখতে পারি। এর মাধ্যমে ক্রীড়া সাংবাদিকরা ক্রীড়াঙ্গনকে এনে দিচ্ছেন হাতের মুঠোয়।
বাংলাদেশে স্যাটেলাইট টিভি শক্তিশালী অবস্থান গড়ে নিতে পেরেছে। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় ‘পাকিস্তান টেলিভিশন’-এর সম্প্রচার শুরু হয়। ১৯৮০ সালে শুরু হয় বিটিভির রঙিন সম্প্রচার। একক টিভি হিসেবে দীর্ঘ দিন আধিপত্য বিস্তার করেছে বিটিভি। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইভেন্ট সম্প্রচারের কৃতিত্ব বিটিভির। বেতবুনিয়ার ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে বাংলাদেশের দর্শকরা প্রত্যক্ষ করেছেন আন্তর্জাতিক ফুটবল, বক্সার মুহাম্মদ আলীর প্রজাপতি নৃত্য ইত্যাদি। দেশীয় ফুটবলের অনেক ম্যাচও সম্প্রচার করেছে। যদিও এ ক্ষেত্রে ক্রীড়া সাংবাদিকতার সরাসরি ভূমিকা ছিল না। তবে অবদান রেখেছেন ক্রীড়া ধারাভাষ্যকাররা। তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন ক্রীড়া সাংবাদিক।
নব্বই দশকের মাঝমাঝি নতুন যুগের সূচনা হয় স্যাটেলাইট টিভির। প্রথম প্রতিষ্ঠিত স্যাটেলাইট টিভি হিসেবে ১৯৯৭ সালের ১৫ জুলাই যাত্রা শুরু করে ‘এটিএন বাংলা’। ১৯৯৯ সালে এটি অ্যানালগ থেকে ডিজিটালে রূপান্তর হয়। বিটিভির পর ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল প্রাইভেট টেরিষ্টিয়াল চ্যানেল হিসেবে সম্প্রচার শুরু করে একুশে টেলিভিশন অর্থাৎ ইটিভি। দেশে বর্তমানে স্যাটেলাইট টিভিগুলো যে ধারায় সংবাদ পরিবেশন করে, তার পথিকৃৎ একুশে টিভি। আর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। ক্রীড়া সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও প্রচলিত ধারাও বদলে দেয় একুশে টিভি। এরপর তো চ্যানেলের ঢল নেমেছে। প্রতিনিয়ত নিত্য-নতুন চ্যানেল আত্মপ্রকাশ করছে।
স্পোর্টস আর স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল যেন একে অপরের পরিপূরক। শুরু থেকে ক্রীড়াঙ্গনকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে চ্যানেলগুলো। এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আজ যে জমজমাট অবস্থা, তার পেছনে রয়েছে চ্যানেলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অতীতে খেলাধুলা আটকে ছিল একটা নির্দিষ্ট বৃত্তে। সেটাকে বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে এসেছে চ্যানেলগুলো। খেলাধুলা এমন একটি বিনোদন, যা মানুষের মনকে প্রসারিত করতে পারে। দেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ খেলাকে ভালোবাসেন। খেলাধুলার খোঁজ-খবর রাখেন। চ্যানেলগুলো ক্রীড়াপ্রেমী এই দর্শকদের কাছে খেলাধুলাকে সহজেই পৌঁছে দিচ্ছে। তাদের মাধ্যমে পাওয়া যায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনের সর্বশেষ খবর। প্রায় সব রকম খেলার খবর দিচ্ছে কিংবা সরাসরি সম্প্রচার করছে। সেটি বিশ্বের যে কোনো প্রান্তেই হোক না কেন। একজন ক্রীড়াবিদ যত না দেশে খেলতে যান, তার চেয়ে বেশি দেশে কাভার করতে যান অনেক ক্রীড়া সাংবাদিক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বাগতিক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সাংবাদিকদের উপস্থিতি থাকে বেশি। এমনকি যে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অংশ গ্রহণ থাকে না, সেখানেও ক্রীড়া সাংবাদিকরা পৌঁছে যান।  


অনলাইন সাংবাদিকতা যেভাবে দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে, আগামীর মিডিয়া মূলত নিয়ন্ত্রণ করবে এই মাধ্যমটি। ক্রীড়া সাংবাদিকদের জন্য এটি এসেছে চ্যালেঞ্জ হিসেবে। আগে কাগজ আর একটি কলম ছিল ক্রীড়া সাংবাদিকদের সম্বল। প্রযুক্তির এ যুগে কাগজ-কলম অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে। কী বোর্ডের সঙ্গে আঙুলের খেলা তো আছেই, সেইসঙ্গে নতুন অনেক কিছু রপ্ত করতে হচ্ছে। আর ইলেকট্রোনিক মিডিয়ার সাংবাদিক হলে তাকে রীতিমতো প্রকৌশলী হয়ে ওঠতে হয়। প্রিন্ট মিডিয়া যেভাবে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে, ইলেকট্রোনিক মিডিয়াকেও নিরাপদ ভাবার সুযোগ নেই। প্রযুক্তি যেভাবে হাতের মুঠোয় সব কিছু এনে দিচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতের ইলেকট্রোনিক মিডিয়াও বড় ধরনের পরিবর্তন আসার লক্ষণ ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। প্রযুক্তি যতই অত্যাধুনিক হয়ে ওঠছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষতা প্রদর্শন করে চলেছেন ক্রীড়া সাংবাদিকরা। আর এভাবেই এগিয়ে চলেছে ক্রীড়া সাংবাদিকতার বর্ণিল ধারা। আর তাতে সমৃদ্ধ হচ্ছে ক্রীড়াঙ্গন।          

    

স্মৃতির নেপথেলিন