পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

মঙ্গলবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৭

যাঁর গান প্রতিনিয়ত বুকের মধ্যে গুনগুন করে



সংগীতের ভুবনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কত কত গান। সুর, লয়, ধ্বনির সম্মিলনে গড়ে ওঠেছে এক মায়াবী জগত। যা ধরা যায় না। ছোঁয়া যায় না। নাগালও পাওয়া যায় না। কেবলই অনুভব করা যায়। তবে গানের আছে প্রকারভেদ। কত রকমের যে বিভাজন। বিভিন্ন রাগের। বিভিন্ন অনুরাগের। কোনোটা আনন্দের। কোনোটা বেদনার। আবেগ আছে। আছে ব্যাকুলতাও। কখন কোন গান যে হৃদয়তন্ত্রী ছুঁয়ে যাবে, অনুভবে বেজে ওঠবে কোন সুর, কেউ বলতে পারে না। মন-মানসিকতা, মেজাজ-মর্জি, পছন্দ-অপছন্দের ওপর নির্ভর করে ভালো লাগা, মন্দ লাগা। মানুষের মন তো বর্ষার আকাশের মতো। কখন কোন রূপ ধারণ করবে, নিজেও জানে না। প্রতিটি মুহুর্তেই বদলায়। বদলে যায়। এরসঙ্গে তাল মিলিয়ে গান লিখেছেন গীতিকাররা। সুর দিয়েছেন সুরকাররা। আর গেয়েছেন কণ্ঠশিল্পীরা। কোনো গান বা সুর যখন প্রচারিত হয়ে যায, সেটি হয়ে যায় সর্বজনীন। এটা যতটা না বাণিজ্যিকভাবে বিস্তৃতি লাভ করে, তার চেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়ে শ্রোতাদের কণ্ঠে ও অনুভবে। তবে সব গান তো আর একই রকম জনপ্রিয়তা পায় না। প্রচারিত গানটি কারো ভালো লাগতে পারে। নাও লাগতে পারে। এটা শ্রোতার রুচি ও কানের ওপর নির্ভর করে। তবে একই রকম কিংবা একই মেজাজের গান সাধারণত সব সময় ভালো লাগে না।
মানুষ তো বৈচিত্র্যপিয়াসী। কখনো সফট, কখনো হার্ড পছন্দ করে। ভোরবেলায় এক রকম, অপরাহ্নে হয়তো আরেক রকম আবার গোধুলিলগ্নে একদমই ভিন্ন মেজাজের গান ভালো লাগতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে গান শোনা বা গাওয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশ-পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ একটা ফ্যাক্টর। রোমান্টিক মুহুর্তে যে গানটি শুনতে মন চায় কিংবা গাইতে ইচ্ছে করে, যখন মন খারাপ থাকে, তখন নিশ্চয়ই সে ধরনের গান ভালো লাগবে না। আর সব গান একসঙ্গে শোনা ও গাওয়া তো সম্ভব নয়। এ যাবৎ সৃষ্টি করা হয়েছে অঢেল গান। তা থেকে কখনো কখনো কোনো কোনো গান বেজে ওঠে হৃদয়ের গহিনে। ছুঁয়ে যায় বুকের অতল। স্পর্শ করে মর্ম। গান তো আর সবাই গাইতে পারেন না। গানকে মূলত বাঁচিয়ে রাখেন শ্রোতারা। পেশাদার শিল্পীর সংখ্যা তো সীমিত। স্বাভাবিক কারণেই সৌখিন শিল্পী কিংবা বাথরুম সিঙ্গারদের সংখ্যাই বেশি। তাঁদের অধিকাংশই কখনো একাকী, কখনো আত্মমগ্ন হয়ে, কখনো কখনো প্রিয়জনের সান্নিধ্যে নিজের অনুভবটুকু সুরে সুরে মেলে ধরেন। সেটা হতে পারে সুরে কিংবা বেসুরেও। বেশিরভাগ সময় আনমনে কিংবা অবচেতনায় কণ্ঠে ওঠে আসে গান। আর গুনগুন করেন না, এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়। একান্ত নিজস্ব মুহূর্তে গান যেভাবে বন্ধু হতে পারে, তার কোনো বিকল্প হয় না।
গানের প্রতি মুগ্ধতা সেই শৈশব থেকে। এ জীবনে কম গান তো শোনা হলো না। বাংলাদেশ বেতারের সম্প্রচার থেকে শুরু করে হালের ইউটিউব পর্যন্ত কত গানই তো হৃদয় পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। সব গান তো আর স্মৃতির অ্যালবামে সাজানো নেই। কত গানই হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। প্রিয় শিল্পী, প্রিয় গানের সংখ্যাও নেহাত মন্দ নয়। কখনো কোথাও সেই গানগুলো বেজে ওঠলে বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সুখের আবেশ। আবার ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় কষ্টের অনুভূতিও। কখনো কখনো টলমল করে চোখ। আসলে গানের কাছে নিজেকে যেভাবে সঁপে দেওয়া যায়, নিজেকে নিবেদন করা যায়, গান যেভাবে আবিষ্ট করে, আপ্লুত করে, অন্য কোনোভাবে সেটা সম্ভব হয় না। আমি গানের একদমই বোদ্ধা নই। স্রেফ ভালোবাসা থেকে গান পছন্দ করি। গান গাইতে না পারাটা জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট হয়ে আছে। তারপরও একান্ত নিভৃতে বুকের ভিতরটা যখন গুনগুন করে ওঠে, তখন কিন্তু অল্প কিছুই গানই বার বার ফিরে ফিরে আসে। আমার মতো অ-সুরের পক্ষে সবার গান গাইতে পারা সম্ভব হয় না। তাছাড়া মনেও রাখতে পারি না। মস্তিস্কের মেমোরি কার্ডের পরিসর এতই সীমিত, চাইলেও বেশি কিছু জমিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। অল্প যে ক’জন শিল্পী তাতে স্থান করে নিয়েছেন, তাঁদের অন্যতম হলেন লাকী আখান্দ।

আমার সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায়, অনুভব-অনুভূতিতে লাকী আখান্দ হয়ে আছেন পরম প্রশান্তির এক নাম। তাঁর গাওয়া, তাঁর সুর করা, তাঁর লেখা একাধিক গানই আমাকে সঙ্গ দেয়। আমাকে আমোদিত করে। আমাকে উৎফুল্ল করে। অন্তর্মুখী মনোভাবের কারণে এগিয়ে গিয়ে কাউকে কোনো কিছু বলতে পারি না। কারো কাজেও আসতে পারি না। তবে দূর থেকে সহানুভূতি বোধ করি। অনুভূতির প্রকাশটা ঘটে ভিতরে ভিতরে। সে ক্ষেত্রেও লাকী আখান্দের মতো শিল্পীরা এগিয়ে আসেন। তাঁদের গানগুলোই বাড়িয়ে দেয় সহযোগিতার হাত। কোনো ‘নীলা’র মন খারাপ দেখলে বুকের মধ্যে বাজতে থাকে, ‘দিয়েছে কে তোমায় ও মনে ব্যথা/কাঁটা হয়ে হয়ে বিঁধেছে কি কারো কথা/কাছে এসো তুমি মেয়ে মুছে দেবো আঁখি পারা/চলে যাবে তখনই যত বেদনা’। যখন এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করি, তখন হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, ‘আমায় ডেকো না, ফেরানো যাবে না/ফেরারি পাখিরা কুলায় ফেরে না’। প্রিয় কাউকে নীল মণিহার দেওয়া না হলেও মুহূর্তটুকু কল্পনা করতে ভালোই লাগে, ‘এই নীল মণিহার, এই স্বর্ণালী দিনে/ তোমায় দিয়ে গেলাম/ শুধু মনে রেখো’। আবার কখনো সান্ত¡না খুঁিজ, ‘দ্বীপজ্বালা রাত জানি আসবে আবার/কেটে যাবে জীবনের সকল আঁধার’।
লাকী আখান্দের সুর করা গানগুলোও বুকের মধ্যে ভাবাবেগ সৃষ্টি করে। উদ্বেলিত করে। নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর গাওয়া ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে/মনে পড়লো তোমায়’ গানটি বৃষ্টির দিনে অকারণেই স্মৃতিকাতর করে দেয়। ফেরদৌস ওয়াহিদের ‘আগে যদি জানতাম তবে মন ফিরে চাইতাম/ এই জ্বালা আর প্রাণে সহে না’, কুমার বিশ্বজিৎ-এর ‘যেখানে সীমান্ত তোমার/ সেখানে বসন্ত আমার/ ভালোবাসা হৃদয় নিয়ে/আমি বার বার আসি ফিরে/ডাকি তোমায় কাছে’ কিংবা জেমসের ‘লিখতে পারি না কোনো গান আজ তুমি ছাড়া/ ভাবতে পারি না কোনো কিছু তুমি ছাড়া/কী যে যন্ত্রণা এই পথ চলা/বিরহ স্মৃতি তোমাকে ঘিরে তুমি জানো না’ ভিন্ন ভিন্ন আবেগ, অনুভূতি এনে দেয়। সামিনা চৌধুরীর ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে/রাতের নির্জনে/ জোনাকীর আলো নেভে আর জ্বলে/শাল মহুয়ার বনে’ গানটি সৃষ্টি করে রোমান্টিক এক আবহ। যেন এমন কোনো দৃশ্যপটের প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার অপেক্ষায় আমিও।  
হ্যাপী আখান্দের গাওয়া ‘চলো না ঘুরে আসি অজানাতে/যেখানে নদী এসে থেমে গেছে/আবার এলো যে সন্ধ্যা শুধু দু’জনে/ঝাউবনে হাওয়াগুলো খেলছে/সাঁওতালি মেয়েগুলো চলছে/লাল লাল শাড়িগুলো উড়ছে/তার সাথে মন মোর দুলছে/ওই দূর আকাশের প্রান্তে/সাতরঙা মেঘগুলো উড়ছে’ আমার প্রিয় গানের একটি। মনটা ফুরফুরে থাকলেই এ গানটি প্রাণখুলে গাইতে ইচ্ছে করে। এমনকি সাধ জাগে ‘ঘুড্ডি’ ছবির রাইসুল ইসলাম আসাদ হতে। সব সময় গানে বর্ণিত অনুভূতি বা মেজাজ নিয়ে একইভাবে গানগুলো গাওয়া বা শোনা হয় না। অকারণেও গানগুলো বুকের মধ্যে গুঞ্জন তোলে। ভরিয়ে দেয় বুকের শূন্যতা। এটাও লাকী আখান্দের গানের মহিমা। তাঁর গানগুলোর আবেদন ফুরিয়ে যাওয়ার নয়।  
২০ জানুয়ারি ঢাকা ক্লাবে কয়েকজন ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে সম্মানিত করে লস অ্যাঞ্জেলস প্রবাসীদের একটি সংগঠন। সে অনুষ্ঠানে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয় লাকী আখান্দকে। অসুস্থ শরীর নিয়েও তিনি এসেছিলেন। তাঁকে কেন্দ্র করে সেলফি তোলার হিড়িক পড়ে যায়। তাঁর পাশের টেবিলেই বসেছিলাম। খুবই ইচ্ছে হয়েছিল কাছে গিয়ে তাঁকে বলি, আপনার গান আমাকে মুগ্ধতায় ভরিয়ে রাখে। মুখচোরা স্বভাবের কারণে প্রিয় কাউকে মনের একান্ত কথা মুখ ফুটে বলতে পারি না। সেদিন তাঁকেও বলতে পারি নি। আর কখনো বলতেও পারবো না।    

মঙ্গলবার, ৭ মার্চ, ২০১৭

আমার বালক-বয়স বাড়ে না কেন?


সময় যে চলে যাচ্ছে, না বললেও চলে। এমনিতেই বুঝতে পারা যায়। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই আরো ভালোভাবে টের পাওয়া যায়। পাতলা চুল, ক্লান্ত চোখ আর বিষণœ মুখ যেন বয়ঃক্রমের মানচিত্র। স্বাভাবিক নিয়মেই হ্রাস পেয়েছে শারীরিক শক্তি, সামর্থ্য ও ক্ষিপ্রতা। লিভারে মেদ জমেছে। কিডনিতে খনিজ জমেছে। ক্লেদ জমেছে হৃদয়েও। সংগত করার জন্য আছে আনুষঙ্গিক আরো কিছু ব্যাধি। এ ধরনের কঠিন কঠিন সব ব্যাধিতে কখনও কখনও বিপন্ন হয়ে পড়ে জীবন। নিভে যেতে যেতে ফের যেন জ্বলে ওঠে জীবনসলতে। চলার পথে সম্বোধন তো অনেক আগেই বদলে গেছে। এ বদল যতই এড়িয়ে যেতে চাই না কেন, জীবন ও সময়কে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। সে তার হিসেব বুঝে নিতে একটুও কার্পণ্য করে না। এ ক্ষেত্রে তার একদমই ঢিলেমি নেই। যতই ভেষজ কিংবা উন্নতমানের চিকিৎসা করা হোক না কেন, খুব একটা কাজে আসে বলে মনে হয় না। ওপর ওপর ঝকমক করলেও ভেতরটা ঠিকই ক্ষয়ে যেতে থাকে। বিজ্ঞানীরা বয়সকে আটকে রাখার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত আশার আলো দেখাতে পারেন নি। শেষ অব্দি অপেক্ষায় থাকতে হয় মৃত্যুর। বুকের মধ্যে যতই কাঁপন ধরুক না কেন, নিয়তির এই বিধানকে মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। 

নিজেকে ফিটফাট রাখার ব্যাপারে আমার তেমন তৎপরতা নেই বললেই চলে। আড়ালে-আবডালে কেউ কেউ ল্যাবেনডিস হিসেবেও অভিহিত করেন। অনেক সময় চুলটাও ঠিকমতো আঁচড়ানো হয় না। প্রায়শই ভুল জায়গায় ভুল বোতাম লাগিয়েছি। কত দিন উল্টো জ্যাকেট পরে সারাদিন টইটই করে ঘুরেছি। যুগিয়েছি হাসির খোরাক। নিজেকে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখার ব্যাপারে কখনই মনোযোগ ছিল না। এমনিতেই সুদর্শন নই। হ্যান্ডসাম নই। নই স্মার্টও। কথাও ঠিকমতো গুছিয়ে বলতে পারি না। তার ওপর পোশাক-আশাকেও কেতাদুরস্ত নই। অগোছালো এমন মানুষকে তো সময়ের আগেই বুড়িয়ে যাওয়ার মতোই লাগে। ভাব-ভঙ্গিতে তেমনই প্রকাশ ঘটে। এরসঙ্গে তাল মিলিয়ে মনটা বুড়াটে হওয়ার কথা। চাল-চলনে পরিপাটিহীন ও বয়সী হয়েও মনটার বয়স কেন যে বাড়ে না?  

শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকে মনের সতেজতা ও সজীবতা। তাতে ছাপ পড়ে বয়সী ভাবনারও। সেটাই তো স্বাভাবিক। বয়সের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মনটাও অভিজ্ঞ ও পরিণত হয়ে ওঠে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ঢের ঢের পিছিয়ে আছি। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যটা এখনও কাটিয়ে ওঠতে পারি নি। সেই বয়স, সেই মন, সেই জীবনধারা এখনও আমার পিছ ছাড়ছে না। বয়স বাড়লেও মনটা আজও অপরিণত হয়ে আছে। যে কারণে সামাজিক দৃষ্টিতে এই বয়সে যেটা মানানসই নয়, সেটা করার জন্য মনটা কেমন যেন উসখুস করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো প্রলোভন এড়াতেও পারি না। আচরণ করি দুষ্টু বালকের মতো। কেন যে এ মনোভাব এড়াতে পারি না?


 আমাকে এই বয়সেও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো। স্কুলে পড়ার সময় কত না মার্বেল খেলেছি। মনের আনন্দে নীল আকাশে ওড়িয়েছি ঘুড়ি। এখনও ইচ্ছে করে মার্বেল নিয়ে নেমে পড়তে। ইচ্ছে করে ঘুড়ি দিয়ে আকাশের মেঘ স্পর্শ করতে। ইচ্ছে করলেও উপায় নেই। এখন আর এই শহরে কেউ মার্বেল খেলে না। আর ঘুড়ি ওড়ানোর মতো আকাশ কোথায়? চাইলেই কি এ বয়সে সেটা সম্ভব? যেটা সম্ভব, সেটাও তো পারি না। ব্যাডমিন্টন খেলতে এত ভালোবাসতাম, ফ্রোজেন শোল্ডারের কারণে খেলা হয় না। কোথাও খেলা হলে মনটা আঁক-বাঁকু করে। এই ইচ্ছে পূরণের সুযোগ না থাকলেও মনটাকে বুঝ দিতে পারি না।


এই জীবনে কত না ফুচকা, চটপটি, ঝালমুড়ি, আইসক্রিম, আচার, ঝুরিভাজা, হজমি হজম করেছি। আমার শরীরের বেশিরভাগ গড়ে ওঠেছে এ গুলোরই সমন্বয়ে। যেজন্য শারীরিক গড়নটা শক্তপোক্ত নয়। আর এখন বাস্তবিক কারণেই এগুলো থেকে দূরে থাকতে বলা হয়। বললেই কি মেনে নেওয়া যায়? পথের পাশে ধুলোমাখা চটকদার এই খাদ্যগুলো আমাকে এখনও চুম্বকের মতো টানে। যতই বিধি-নিষেধ থাকুক, এর প্রলোভন মোটেও এড়াতে পারি না। এটা কি সম্ভব? চটপটি-ফুচকাÑআইসক্রিম ছাড়া জীবনটা কেমন যেন আলুনি আলুনি লাগে। হাওয়াই মিঠাই দেখলে বালক বয়সের মতো চাতক চোখে চেয়ে থাকি। এই বয়সে যখন একাকী হাওয়াই মিঠাই দিয়ে ঠোঁট লাল করি, অনেকেই তির্যকভাবে তাকিয়ে থাকেন। অস্বস্তি লাগলেও কিছু করার থাকে না। বয়স বাড়লেও ছেলেমানুষিটা যেন আজও কাটিয়ে ওঠতে পারি নি। আজও ল্যাবেনচুসের জন্য মনটা আইঢাই করে।  
ইঞ্জেকশন বা টিকা দেওয়ার ভয়ে স্কুল থেকে কত না পালিয়ে গেছি। অথচ সুইয়ের খোঁচায় এ জীবনে কত না ক্ষত-বিক্ষত হয়েছি। এমনকি দু’হাতে সুই ফুটানোর জন্য শিরা না পেয়ে পায়েও দিতে হয়েছে। এত এত দিনে তো সুইয়ে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বালক বয়সের সেই ভীতি আজও আমায় ছেড়ে যায় নি। সুইয়ের ভয়ে আজও চোখ বন্ধ করে রাখি।
  
এখনও শুনতে ভালো লাগে রোমান্টিক গান। এ ব্যাপারে আমার কোনো ছুতমার্গ নেই। এ প্রজন্মের কোনো শিল্পীর মন ছুঁয়ে যাওয়া গানও আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এমনও হয়, একটি গান শুনলে সেটি যদি ভালো লেগে যায়, সেই গানটিই বার বার শুনি। সেই তরুণ বয়সে শোনা ‘একডালি ফুল/তোমার হাতে দিয়ে আমি/বলেছিলাম ভালোবাসি/ভালোবাসি সবচেয়ে বেশি/শুধু তোমাকে শুধু তোমাকে শুধু তোমাকে’-এমন হালকা মেজাজের গানও এ বয়সে শুনতে ইচ্ছে করে। এমনকি কাউকে শোনাতেও ইচ্ছে করে। অথচ এটা কি আমার জন্য মানানসই? অথচ বয়সটাতো এখন এমন, আনমনে বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যথা হয়ে বাজবে, ‘এখন আমার বেলা নাহি আর, বহিব একাকী বিরহের ভার’। কিন্তু মন কিছুতেই মানতে তা চায় না।


আর প্রেমের কবিতা ও ভালোবাসার উপন্যাস আমাকে গভীরভাবে আপ্লুত করে। বিভোর করে দেয়। একটি উপন্যাস হৃদয় ছুঁয়ে গেলে তা শেষ করার পর তাৎক্ষণিকভাবে তা আমাকে ভীষণ ঘোরের মধ্যে রাখে। তার হ্যাংওভার কিছুতেই কাটিয়ে ওঠতে পারি না। একজন বনলতা সেন (বনলতা সেন/জীবনানন্দ দাশ), একজন মৃম্ময়ী (সমাপ্তি/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) কিংবা নিদেনপক্ষে একজন ময়ূরাক্ষী (ময়ূরাক্ষী, তুমি দিলে/হর্ষ দত্ত) বুকের গভীরে যে সম্মোহন ছড়িয়ে দিয়েছে, সেই সম্মোহন আজও কাটিয়ে ওঠা গেল না, এ কারণে এমন চরিত্রের সঙ্গে মানানসই কাউকে দেখলে এখনও মনটা কেমন উচাটন উচাটন করে। কেউ জানলে কী ভাববে?


জোছনা রাতে বুকের মধ্যে তরুণ বয়সের মতো কেমন আকুলিবিকুলি করে। মনে হয়, নির্জন কোনো প্রান্তে দু’ হাত ভরে জোছনা মাখামাখি করি। লুটাপুটি করি। ইচ্ছে করে কারও হাত ধরে হেঁটে বেড়াই সবুজ ঘাসে। প্যান্টে লেগে যাক দুষ্টু চোরকাঁটা। কেউ একজন ঘনিষ্টভাবে পাশে বসে ভালোবেসে তুলে দিক এই চোরপুষ্পী। অকারণেই লজ্জাবতী গাছকে ছুঁইয়ে দিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে খুব ভোরে শিশিরে সিক্ত করতে পা। ধুম বৃষ্টিতে ভীষণ ভিজতে ইচ্ছে করে। উড়ে যাওয়া প্রজাপতির পিছে পিছে ছুটে যেতে যায় অভিলাষী মন। ইচ্ছে করে রিক্সায় এলোমেলো ঘোরাঘুরি করি অচেনা পথে। বাসনা জাগে, কোনো ক্যাফেতে বসে থাকি প্রিয় কারও মুখোমুখি। গরম কফিতে চুমক দিতে দিতে খুনসুটি করি। এমন ইচ্ছে কি এই বয়সে শোভা পায়? আর মন যা চায়, তা কি বাস্তবে করা যায়? কে বোঝাবে অবুঝ মনকে? 


সুন্দরের প্রতি মুগ্ধতা আজও কাটলো না। এখনও অপোজিট সেক্সের কারো প্রতি সাবলীলভাবে তাকাতে পারি না। তারপরও ভিজাবিড়ালের স্বভাবটা যায় নি। যখন হঠাৎ চোখে পড়ে যায় সুচিত্রা সেনের মতো কোনো মুখ, মোনালিসার মতো এক টুকরো হাসি কিংবা নজর কাড়ার মতো কোনো সৌন্দর্য, তা না দেখে কি মুখ ফিরিয়ে নেওয়া যায়? এতটা ভদ্রলোক আমি কখনই ছিলাম না। চোরা চোখে হলেও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হয়। বুকের মধ্যে তার রেশ দুলতে থাকে দুরন্ত ঢেউ হয়ে। অথচ বয়স তো এটা পারমিট করে না। এটাকে কি বলা যায় বুড়ো বয়সের ভীমরতি? 

এতগুলো বছর পেরিয়ে এলেও আজও চালাক-চতুর হতে পারলাম না। এটা তো বুঝতে পারি, যখন কেউ কেউ আমাকে বোকা ঠাওরায়। মনে করে, একে যা বলা হবে তাই বিশ্বাস করবে। সেটাই হয়ে আসছে। আজও কাউকে অবিশ্বাস করতে পারি না। বিশ্বাস করতে গিয়ে প্রতারিত হই। কতভাবেই না ধাক্কা খাই। তারপরও শিক্ষা নেওয়া হয় না। যে কারও কথায় সহজেই পটে যাই। যে কারও প্রতি সহজাতভাবে সহযোগিতার হাতটা বাড়িয়ে দিতে দ্বিধা করি না। প্রতিদানে সইতে হয় প্রত্যাখ্যান। হজম করতে হয় অপমান। এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট। অপমানটা একদমই মেনে নিতে পারি না। যা আমাকে রীতিমতো ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। বিমূঢ়, বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত করে দেয়। তারপরও বালকোচিত মনটাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি না। পারি না বলেই কাউকে কিছু বলতে পারি না। পারি না প্রতিবাদী হয়ে ওঠতে। অল্প বয়সী বালকের মতো বুকের মধ্যে বয়ে বেড়াই অভিমান আর কষ্ট।
  
হম্বিতম্বি করতে না পারলে কোথাও নিজের অবস্থান সংহত করা যায় না। দুর্বিনীত হতে না পারলে, দুর্ব্যবহার করতে না পারলে, অসৎ না হতে পারায় গুরুত্ব, মর্যাদা ও সম্মান পাওয়া যায় না। উদ্ধত, অশিষ্ট ও অবিনয়ী হতে না পারায় কারও কাছেই পাত্তা পাওয়া যায় না। প্রতিবাদ করবো না জেনে অনেকেই মিথ্যা কথার ফুলঝুরি ছোটায়। মিথ্যা আশ্বাস দেয়। তথাকথিত ভদ্রতার খাতিরে সেটাই মেনে নিতে হয়। সেই শৈশবেই ভদ্রতার যে সবক পেয়েছি, সেটিকেই মনে করে এসেছি সারা জীবনের শিক্ষা। সেই শিক্ষাটা আমাকে নানাভাবে ভুগালেও তা পরিত্যাগ পারি না।

মনটা এখনও যে পেকে ওঠে নি, এটা গর্ব করে বলার মতো কিছু না। বরং আমার কাছে মনে হয়েছে, এটা ব্যর্থ জীবনের হাহাকার। নিজেকে দিয়ে এটা আমি ভালোভাবেই বুঝতে পারি। জন্মের পর এই ঢাকা শহরের বেড়ে ওঠা। আমাকে ঢাকার সন্তান বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। অথচ এত দিন বসবাস করার পরও ঢাকায় নিজস্ব কোনো ঠিকানা নেই। নিজস্ব বাহন নেই। এখনও দৌঁড়ে দৌঁড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওঠতে হয় ভাঙা বাস কিংবা মেজাজী রিক্সায়। আরো অনেক কিছুই নেই। বৈষয়িক পাওয়া না পাওয়ার সঙ্গে মনের কী সম্পর্ক, এমন প্রশ্ন ওঠতেই পারে। সম্পর্ক অবশ্যই আছে। বয়স বাড়লে, মনটা পরিপক্ক হয়ে ওঠলে, স্বার্থগত অর্থাৎ বৈষয়িক বুদ্ধিও সমানতালে বেড়ে যায়। বাড়ে সহায়-সম্পত্তি। অথচ সেই বালক বয়স না বাড়ার কারণে এই ঢাকা শহরে আজও অনিকেত হয়ে আছি। নিজের বুঝ নাকি পাগলেও বোঝে। সেই বুঝটুকু না হওয়াতে কিছুই করা হলো না। আর হওয়ার কোনো লক্ষণও নেই।


এটা তো চোখের সামনে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, যার বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, কথার ফুলঝুরি আছে, ক্ষমতার দাপট আছে, তাদেরই সমাদার বেশি। আর সমাদার কে না চায়? কিন্তু চাইলেও হবে না। কেউ তো আর হাত বাড়িয়ে কিছু দেবে না? তেমন আগ্রহও নেই। যদিও রাশির প্রতি আমার কোনো বিশ্বাস নেই। তবে রাশির কিছু কিছু পর্যবেক্ষণ জীবনের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমার রাশি নিয়ে লেখায় দেখতে পাই, ‘নেপচুনশাসিত মানুষগুলোর মধ্যে পার্থিব আকাঙ্খা তেমন একটা নেই। তাদের অধিকাংশের মধ্যেই পদবী, ক্ষমতা, নেতৃত্ব বা ধন-সম্পদের প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ দেখতে পাবেন না। বিয়ের সূত্রে কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রে না পেলে মীনদের মধ্যে কাড়ি কাড়ি টাকাওয়ালা মানুষ তেমন একটা নেই।’ রাশি অনুযায়ী ভাগ্য তো আমাকে এমনিতেই প্রবঞ্চিত করে রেখেছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধান্দা বাড়ার কথা থাকলেও সেটাও হয়ে ওঠে নি। তাহলে কীভাবে পাবো বিলাস-ব্যসনের চাবিকাঠি?

কিছু কিছু ইচ্ছে আছে, যা কখনও পূরণ হয় না। এই বয়সে হওয়ার কথাও নয়। তারপরও সেই ইচ্ছের দাস হয়ে আছি। ইচ্ছে করে প্রিয় কাউকে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে চিঠি লিখতে। আকাশী-নীল কাগজে মনের একান্ত কথা লিখে সব চোখ ফাঁকি দিয়ে সেই চিঠি গোপনে পৌঁছে দিতে। পেতে ইচ্ছে করে প্রিয়জনের লিপস্টিক মাখানো গভীর-গোপন প্রণয়পত্র। সেটা কি আর সম্ভব? তা তো ঠাঁই নিয়েছে স্মৃতির পাতায়। স্মৃতিকে কি আর ফিরিয়ে আনা যায়? তবুও বোকা মন মানতে চায় না।


সাম্প্রতিককালের ফেসবুকে চ্যাটিং করে তো অন্তত দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো যায়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকেও স্মার্ট ভাবতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে গভীরভাবে কারও প্রেমে পড়তে। যেভাবে প্রেমে পড়েছে উইলিয়ামের শেকসপিয়রের রোমিও-জুলিয়েট, এরিখ সেগালের লেখা ‘লাভ স্টোরি’ অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রের রায়ান ও’নিল-অ্যালি ম্যাকগ্রা, ‘টাইটানিক’ ফিল্মের জ্যাক ডাওসন (লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও)-রোজ ডেউইট বুকাতার (কেইট উইন্সলেট) কিংবা বলিউডের ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’-এর রাজ মালহোত্রা (শাহরুখ খান)-সিমরান সিং (কাজল)। এভাবে কি আমার পক্ষে প্রেমে পড়া সম্ভব? তাছাড়া আমি তো আমার হৃদয়টাকে জানি। কাউকে ভালোবাসলে বা কারও প্রেমে পড়লে তার মোহাচ্ছন্নতা কখনও কাটিয়ে ওঠতে পারবো না। এমন দুর্বল মন নিয়ে কারও প্রতি ঝুঁকে পড়লে সেটা কি সামাল দিতে পারবো? মোটেও না। হাল আমলের একটি কবিতার মতো,
‘আমি একবার কারও প্রেমে পড়লে সারাজীবন আর/
উঠতেই পারি না। সকলে কী সুন্দর উঠে পড়ে জামাটামা/
বদলিয়ে একেবারে হাতটাত মুছে...আমি সেই পড়ে/
থাকি!’ (প্রেমিক/সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়)।

এমন মনোভাবাপন্ন হলে তো কষ্ট পেতেই হবে। তারপরও প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে। নিবিড়ভাবে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। আর শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যের মতো যা যা ইচ্ছে করে, তা তা করতে চাই। কোনো কিছুই বাদ দিতে চাই না। এটা কি বয়সী কোনো মানুষের কথা হতে পারে? এমন মনোভাবের কথা জানলে যে কেউ বাঁকা হাসি হাসবেন। খারাপ ভাববেন। বকাও হয়তো দেবেন। তারপরও আমি নিরুপায়। আসলে মনের বয়স না বাড়লে আমি কী করতে পারি? মনটাকে তো বেঁধে রাখা যায় না। ইচ্ছেটাকেও তো আগল দিয়েও রাখার উপায় নেই। কেন জানি না, বয়স বাড়লেও আজও সাবালক হতে পারি নি। এই না পারাটা এই বয়সের সঙ্গে একদমই মানানসই নয়। কিন্তু আমি কী করতে পারি? তাই আক্ষেপ নিয়ে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো বলতে পারি, ‘সবার বয়স হয় আমার বালক-বয়স বাড়ে না কেন?’
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭


  

‘সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে’



তাঁকে যাঁরা দূর থেকে অবলোকন করেন, এমনকি যাঁরা কাছাকাছিও হয়েছেন, তাঁদের কাছে মনে হতে পারে, রসকষহীন নিরেট একটি পাথর। যেন তাঁর কোনো লাবণ্য নেই। সুষমা নেই। সৌন্দর্য নেই। এমনটি মনে হওয়ার কারণ, তিনি সবার সঙ্গে খুব একটা মেলামেশা করেন না। যার-তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার প্রশ্নই আসে না। তাঁকে খুব একটা হাসতেও দেখা যায় না। বেশির ভাগ সময় চুপচাপ থাকেন। কাজ করেন আপন মনে। তাঁকে গম্ভীর প্রকৃতির বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। তিনি তাঁর চাবুকের মতো সুগঠিত দেহের মতো স্ট্রেইটকাট। কাউকে পরোয়া করেন না। আর আপোষ করার প্রশ্নই আসে না। নিজে যেটা বিশ্বাস করেন, সে বিষয়ে তাঁকে টলানো আর পাহাড় ধাক্কা দিয়ে নড়ানোর মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। আলোচনার টেবিলে তাঁকে দেখা যায় ভিন্ন মেজাজে। পাকা বিতার্কিকের মতো তাঁর মুখে যেন কথার খই ফোটে। রাজনৈতিক বিষয় হলেও তো কথা নেই। ইতিহাসের পাতা থেকে অবলীলায় একের পর এক উপস্থাপন করেন বিভিন্ন প্রসঙ্গ। তাঁর সামনে হকচকিয়ে যান ঝানু ঝানু আলোচকরাও। সে যে-ই হোক না কেন, তাঁর কথা শুনতে বাধ্য না হয়ে পারেন না। কণ্ঠের তীব্রতা, যুক্তির ধার আর ইস্পাতদৃঢ় মনোবল নিয়ে তিনি যখন আলোচনার ঝড় তোলেন, তখন দেখতে পাওয়া যায় টগবগিয়ে ফুটতে থাকা একজন বিপ্লবীকে। তাঁর উপস্থিতিতে সব সময় আলোচনা যে সুখকর হয়, তা বলা যাবে না। প্রায়শই তপ্ত হয়ে ওঠে আড্ডার মেজাজ। পাল্টা যুক্তি দিয়ে তাঁকে কাবু করার চেষ্টা করা হয়। তাতে তিনি দমে যাওয়ার পাত্র নন। এ কারণে মনোমালিন্যও হয়। অনেকে তাঁকে আগ্রাসী ও উগ্র মেজাজী হিসেবেও অভিহিত করেন। এ নিয়ে তাঁর খুব একটা ভাবান্তর হয় না। সোভিয়েত নেতা যোষেফ স্টালিনের অনুরক্ত হওয়ার কারণে তাঁকে ‘আইরনম্যান’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। সামনাসামনি এমনটি বলা হলেও তাঁর চিকন হাসিটি ঠিকই অনুভব করা যায়। আর তিনি হলেন এক ও অদ্বিতীয় সুধীর কৈবর্ত দাস।

ঘটনাবহুল এক জীবন পেরিয়ে এসেছেন তিনি। যে অবস্থান থেকে নিজেকে গড়ে তুলেছেন, তা মোটেও সহজ ছিল না। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সন্তান হলেও ১৯৫০ সাল থেকে তাঁর বেড়ে ওঠা ও প্রতিষ্ঠা মূলত ঢাকার শাঁখারিবাজারকে কেন্দ্র করে। সামাজিকভাবে একটু আড়ালে থাকা এ এলাকায় তিনি ছিলেন প্রতিবাদী এক বলিষ্ঠ কণ্ঠ। সেই ষাট দশকের রাজনৈতিক আন্দোলনেও সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। প্রকম্পিত রাজপথের মিছিলের তিনিও ছিলেন সাহসী এক মুখ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তদানীন্তন ছাত্রনেতা গয়েশ্বর রায়, স্বপন চৌধুরীর অনুপ্রেরণায় তিনি সক্রিয়ভাবে তাতে অংশ নেন। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধের টাটকা স্মৃতি নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতির পাশাপাশি পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতাকে। একটা পর্যায়ে হয়ে ওঠেন পুরোদস্তর পেশাদার সাংবাদিক। দীর্ঘ জীবনে অর্জন করেছেন বৈচিত্র্যময় ও বর্ণময় অভিজ্ঞতা।
আপাতদৃষ্টিতে বহিরঙ্গের সুধীর কৈবর্ত দাসকে কঠিন ও কর্কশ মনে হলেও খুব গভীরভাবে স্পর্শ করতে পারলে অনুভব করা যায় তাঁর ভিতরের ঐশ্বর্য ও  পেলবতাকে। অনেকটা তালশাঁসের মতো। তাঁর বুকের মধ্যে বয়ে চলে ভালোবাসার স্রোতস্বিনী নদী। সেটা কিন্তু বাইরে থেকে অনুধাবন করা যাবে না। তাঁকে যাঁরা অন্তরঙ্গভাবে চেনেন কিংবা জানেন, তাঁরা অন্তত সেটা অনুধাবন করতে পারেন। অনেকেই পেয়েছেন তাঁর আন্তরিকতা, স্নেহ ও ভালোবাসা। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে তিনি মোটেও দ্বিধা করেন না। এ কারণে নীরবে গড়ে ওঠেছে তাঁর একদল অনুসারীও।

এবারের বইমেলায় নতুনভাবে উদ্ভাসিত হয়েছেন সুধীর কৈবর্ত দাস। বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বিবরে বিভূতি’ এবং গল্পগ্রন্থ ‘সৌপ্তিক’। তাঁর বুকের মধ্যে যে লুকিয়ে আছে একজন সৃজনশীল লেখক, সেটা এবার যেন পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করা যায়। তাঁর গ্রল্পগন্থে স্থান পেয়েছে সাতটি গল্প। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে লেখা গল্পগুলো ছাপা হয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। গল্পের বিষয়বস্তু ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের সমস্যা-সংকট, মানসিক দ্বিধা-দ্বন্ধ, নিম্নবিত্তের কঠিন জীবন সংগ্রাম, নগরজীবনের আর্থ-সামাজিক টানাপড়েন, মানবিক মূল্যবোধ, শরণার্থী জীবনের দুঃসহতা। তাঁর লেখায় একইসঙ্গে বাঙময় হয়েছে শহর ও গ্রামীণ জীবনের দৃশ্যপট। আঞ্চলিক ভাষায়ও তিনি তাঁর মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন।    
আবেগ, উচ্ছ্বাস, ভালোবাসা যে সুধীর কৈবর্ত দাসকে দারুণভাবে আপ্লুত করে, সেটা অনুধাবন করা যায় তাঁর কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করলে। তাঁর কবিতায় প্রেম-প্রীতি, পরিবেশ-প্রকৃতি, দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা, শ্রম-ঘাম, চাওয়া-পাওয়া, বঞ্চনা-লাঞ্ছনা, আক্ষেপ, হাহাকার মূর্ত হয়ে ওঠেছে। একইসঙ্গে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের লড়াই-সংগ্রাম-মুক্তিযুদ্ধও স্থান করে নিয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রেমিক, বিপ্লবী, সামাজিক, রাজনৈতিক ও মানবিক সত্তা। গদ্য ও পদ্যে তিনি যে সমান দক্ষ, সেটাও বুঝতে পারা যায়।

সুধীর কৈবর্ত দাসের হৃদয়ে সাহিত্যের বীজ রোপিত হয় তরুণ বয়সে। ১৯৬৭ সালের মে মাসে শিশু-কিশোর সাহিত্যপত্র মাসিক ‘মুকুল’-এ ছাপা হয় তাঁর প্রথম লেখা ‘আগন্তুক’। রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাগত কারণে লেখালেখিতে তিনি নিয়মিত ছিলেন না। তবে সাহিত্যিক পরিম-লে বরাবরই তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ। ১৯৭৮ সালে নিজের উদ্যোগে প্রকাশ করেন সাহিত্য পত্রিকা ‘তমসুক’। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। আশির দশকে অনিয়মিতভাবে গল্প লেখা শুরু করেন। গল্পকার হিসেবে তাঁর মধ্যে সম্ভাবনা থাকলেও তিনি তাতে গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন নি। সেই সময় থেকে দেশের প্রধান বইয়ের বাজার বাংলাবাজারের সঙ্গে নানাভাবে তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে নর্থগ্রুপ হলের সর্বজনীন পূজা কমিটির পূজা সংখ্যা ‘শঙ্করী’ এবং সংঘমিত্র পূজা কমিটির পূজা সংখ্যা ‘অকালবোধন’ পত্রিকার সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। দীর্ঘ দিন তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৩ সাল থেকে প্রকাশনা সংস্থা ‘অক্ষরবৃত্ত’-এর তিনি ছিলেন অন্যতম কাণ্ডারি। এ প্রতিষ্ঠান থেকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সহ দেশবরেণ্য অনেক লেখকের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। নানা কারণে সম্ভাবনাময় এই প্রকাশনা সংস্থাটি দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। বছর পাঁচেক আগে জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে প্রকাশিত ‘কবিতাপত্র’ পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠলে তিনি নতুন করে নিমগ্ন হন কবিতার ভুবনে। আর এখন তো লেখালেখিটা হয়ে ওঠেছে তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী। জাতীয় প্রেস ক্লাবের মিডিয়া সেন্টারে গেলে দেখা যায়, কম্পিউটারের মনিটরের সামনে ধ্যানস্থ হয়ে আছেন তিনি। হয় লিখছেন নতুন কোনো কবিতার পংক্তি কিংবা বাবুই পাখির মতো বুনে চলছেন গল্পের নকশা। কখনো কখনো সুরেলা কণ্ঠে গুন গুন করে চলেছেন মান্না দে কিংবা পুরানো দিনের কোনো জনপ্রিয় গানের কলি। তখন তাঁকে একদমই অচেনা মনে হয়।          
আবুল হাসানের কবিতা ‘আবুল হাসান’-এর অমর সেই পংক্তি ‘সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জলতা ধরে আর্দ্র’ অনেকটাই যেন খাপ খেয়ে যায় সুধীর কৈবর্ত দাসের সঙ্গে। তাঁকে ‘পাথরমানব’ মনে হলেও বুকের মধ্যে যে লালিত্য, যে মাধুর্য, যে সৌন্দর্য তিনি বয়ে বেড়ান, তার নাগাল সবার পক্ষে পাওয়া সম্ভব হয় না। তবে তাঁর গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশিত হচ্ছেন একজন আশেক, একজন অনুভূতিশীল, একজন হৃদয়বান সুধীর ‘কুমার’ দাস। সরি, সুধীর কৈবর্ত দাস।     

       

সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

এখন সময় টি-টুয়েন্টি ভালোবাসার




ফাগুনের তখন এত ঘনঘটা ছিল না। নির্ধারিত দিনক্ষণ ছিল না ভালোবাসারও। তাতে কি ফাগুন অনুভব করা যেত না? ভালোবাসা কি ছিল না? রাস্তার পাশে কৃষ্ণচুড়া যখন রাঙিয়ে দিয়েছে চারপাশ আর ভেসে এসেছে কোকিলের মধুর কণ্ঠ, তখন বুঝতে পারা গেছে ‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে’। আনুষ্ঠানিকভাবে বসন্ত বরণ করা না হলেও দেহ-মনে ছুঁয়ে যেত বাসন্তী হাওয়া। তাতে বুকের মধ্যে যেন কেমন কেমন করতো। হিল্লোলিত হতো সুরেলা আমেজ। প্রাণে প্রাণে বয়ে যেত খুশির নহর। আর ঢাক-ঢোল পিটিয়ে না থাকলেও ভালোবাসা তো চিরকালই ছিল। আছে। থাকবে।

প্রাণের অস্তিত্ব থাকলে ভালোবাসা না থাকার কোনো কারণ নেই। যুগে যুগে ফুটেছে ভালোবাসার গোলাপ। আবার না ফোটাও থেকে গেছে কত কত। ঝরে গেছে কুঁড়ি হয়ে। ভালোবাসায় কেউ সফল। কেউ ব্যর্থ। তাতে ভালোবাসার কোনো হেরফের হয় নি। যে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছে, তার কাছে ভালোবাসার প্রাপ্তিটা একরকম। আর যে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে নি, তার কাছে ভালোবাসার অপ্রাপ্তিটা অন্যরকম। এই বিপরীতধর্মীতাই ভালোবাসার সৌন্দর্য। পাওয়াটাই সবটুকু নয়, না পাওয়ার মধ্যেও ছিল ভালোবাসার অন্য রকম মাধুর্য।
 
কিন্তু ভালোবাসার অনুভব, অনুভূতি, অনুরণন তো সব কালে, সব যুগে, সব সময়ে একই রকম ছিল। তবে ভিন্নতা প্রকাশের। ভিন্নতা আবেগের। ভিন্নতা দৃষ্টিভঙ্গির। ভালোবাসা তো আবেগেরই রূপান্তর। কতভাবেই না ছড়িয়েছে ভালোবাসার রং। কতভাবেই না ভালোবাসা ছুঁয়েছে একে অপরের হৃদয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের মতো ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে-।’ আমি যে সময়টার কথা বলছি, তখন ভালোবাসার গভীরতা, তীব্রতা ও স্পন্দন ছিল অন্য মাত্রার। আবেদন ছিল অন্য রকম।
অবশ্য নিজের সময়কে অনেকের কাছেই সেরা মনে হতেই পারে। তবে এটাও ঠিক, তাতে সব কিছুতেই অতীতের একটা ধারাবাহিকতা ছিল। যুগের পর যুগ এ ধারাটাই অনেকটাই বহমান ছিল। ভালোবাসায় আড়াল, গোপনীয়তা, সংশয়, দ্বিধা-দ্বন্ধ ও রহস্যময়তাই ছিল মুখ্য। এখন তো আগের সব কিছুই ভেঙেচুরে গেছে। তছনছ হয়ে গেছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আমূল বদলে গেছে জীবনধারা। অতীতের সঙ্গে এখন কিছুই মেলে না।

তখন তো এত সহজে ভালোবাসা গড়ে ওঠতো না। দু’টি হৃদয় একীভূত হতে অনেক সময় লাগতো। ভাঙতেও। খুব সামান্যতেই ভালোবাসা হয়ে ওঠতো অসামান্য। কখনো চুড়ির একটুখানি রিনঝিন শব্দ শুনতে পেয়ে, কখনো এক পলক দেখতে পেয়ে, কখনো আয়ত চক্ষুতে মুগ্ধ হয়ে, কখনো মুক্ত ঝরানো হাসিতে অভিভূত হয়ে, কখনো একটি চিরকুট পেয়ে, কখনো একটু কথা বিনিময় হলে বুকের মধ্যে জ্বলে ওঠতো ভালোবাসার দীপাবলি। ঝগড়াঝাটি বা তিক্ততা থেকেও সূত্রপাত ঘটেছে ভালোবাসার। আসলে কার সঙ্গে কীভাবে গড়ে ওঠেছে ভালোবাসা, সেটার রকমারিতা, বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যতা ছিল অন্তহীন। কে কীভাবে, কোথায়, কখন ভালোবাসার মায়াডোরে বাঁধা পড়েছে, তা একমাত্র জানতেন প্রেমের দেবতা কিউপিড। তবে যেভাবেই যোগাযোগ বা সম্পর্ক গড়ে ওঠুক না কেন, সেটা ভালোবাসায় পরিণত হতে ঢের ঢের সময় লেগে যেত। এজন্য কত সময়, কত অনুনয়-বিনয়, কত জট-জটিলতা, কত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আসতে হয়েছে। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে এক জীবন। তবুও অধরা হয়ে থেকেছে ভালোবাসা। দীর্ঘ দীর্ঘ প্রহর কেটেছে ব্যাকুলতা নিয়ে, মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলাও হয় নি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানের মতো, ‘আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি/আর মুগ্ধ হয়ে চোখে চেয়ে থেকেছি।’ এই দেখা, এই চেয়ে থাকা কিংবা মনে মনে ছবি এঁকে যাওয়াটাই ছিল ভালোবাসা।

অনেক অপেক্ষা, অনেক অস্থিরতা, অনেক দ্বিধা-দ্বন্ধ, অনেক যাতনা সয়ে বাইতে হতো ভালোবাসার তরি। সব সময় তরি তীরে ভিড়ানো সম্ভব হয়ে ওঠতো না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুয়ে দুয়ে চারও হতো না। দু’জনার দু’টি পথ দু’টি দিকে বেঁকেই যেত বেশি। তারপর কারো পথ হতো আলোয় ভরানো। আবার কারো পথ আঁধারে যেত ঢেকে। আঁধারে ঢেকে গেলেও ভালোবাসাটুকু একদমই উবে যেত না। না পাওয়ার সেই বেদনাটুকু বুকের মধ্যে থেকে যেত। মনের মধ্যে চিরকালীন একটা দাগ অন্তত কাটতো। পারতপক্ষে একজনকে হৃদয় দেওয়ার পর সেই হৃদয় অন্য কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করা সম্ভব হতো না।

সাধারণত এক জীবনে একাধিকবার ভালোবাসা জড়ানো হয়ে ওঠতো না। এটা ছিল আবেগগত ব্যাপার। কবি জসীমউদ্দীনের কলমে ফুটে ওঠেছে এই আবেগ, ‘মন সে তো নহে কুমড়ার ফালি/যাহারে তাহারে কাটিয়া বিলান যায়’। তখনকার সময়টাই ছিল এমন। হয়তো সামাজিক নিয়মে অন্য কারো সঙ্গে সংসার হয়েছে। জীবনও একরকম কেটে গেছে। কিন্তু প্রথম ভালোবাসার অনুভূতিটা হারিয়ে যায় নি। বিরহের রেশও থেকে গেছে। তা সযতনেই সাজানো থাকতো হৃদয়ের সিন্ধুকে। কখনো কখনো একান্তে নিভৃতে ভালোবাসার সেই অনুভূতি, সেই যাতনা হয়ে ওঠেছে যেন মধুময় ভিনটেজ। তাতে না পাওয়ার কষ্টটুকু যেমন থাকতো, তেমনিভাবে থাকতো ফেলে আসা সেই দিনগুলোর মৌতাত। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়, ‘প্রেম কি কখনও জীবনের পিছ ছাড়ে?’ নিখাদ ভালোবাসা আদপেই ছাড়তে পারে না। আবার এর রেশ কাটিয়ে ওঠতে না পেরে অনেকের জীবন হয়ে যেত এলোমেলো।
এখন তো বদলে গেছে ভালোবাসার ধরন। অবশ্য সময় তো সব কিছুই বদলে দেয়। ভালোবাসাইবা বদলাবে না কেন? এখন তো ভার্চুয়াল জগত। বিভিন্ন মাত্রিক এক দুনিয়া। ভালোবাসাও হয়ে ওঠেছে ভার্চুয়াল। কল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার সামান্য হেরফের হলেই সৃষ্টি হয় বিভ্রম। ভালোবাসা গড়ে ওঠতে খুব বেশি সময় নেয় না। চোখে চোখ রাখার প্রয়োজন পড়ে না। কথাও বলতে হয় না। জানা-শোনাও লাগে না। গভীর-গোপন অনুভূতি না থাকলেও চলে। সব কিছুই এখন ঝটপট হয়ে যায়। ইনস্ট্যান্ট নুডলসের মতো।

ভালোবাসার মাধ্যম হয়ে ওঠেছে মূলত কী বোর্ড। ফেসবুকের চটকদার ছবি দেখে কিংবা একটুখানি চ্যাটিং হলেই হয়ে যায় রিলেশনশিপ বা লভ। অন্যভাবেও প্রপোজ করা হয়। তবে প্যাটার্নটা একই। তারপর পিজ্জা, কোক আর সেলফি। তাতে ছয়লাপ হয়ে যায় ফেসবুক। তা দেখলে এক একটা যুগলের মনোভাব এমন মনে হবে, ‘মোরা আর জনমে হংস-মিথুন ছিলাম/ছিলাম নদীর চরে/যুগলরূপে এসেছি গো আবার মাটির ঘরে’। কী উচ্ছ্বাস! কী উল্লাস! কী উদযাপন! অথচ কিছু দিন যাওয়ার পরই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রিলেশন ব্রেকÑআপ হতে সময় লাগে না। এমনকি সরাসরি নির্দ্বধায় মেসেজ দেওয়া হয়, ‘আই থিঙ্ক উই নিড টু ব্রেক আপ.....’। তা নিয়ে সাধারণত কারো কোনো কষ্ট বা মনোবেদনাও খুব একটা থাকে না। আর একান্তই যদি কারো একটু মন খারাপ হয়, তাহলে ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়া হয়, ‘ফিলিং ব্যাড’। এটাই যেন খুবই স্বাভাবিক।

সময়টা এখন এমন, কেউ আর দেবদাস হন না। বরং অপেক্ষার তালিকায় থাকেন অন্য কোনো পার্বতী। আর মেয়েদের জন্য তো ফ্রেন্ড লিস্টের সার বেধে থাকা রোমিওরা আছেনই। রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসে ‘সিঙ্গেল’ সিলেক্ট করে দিলেই হলো। তারপর আঙুলের একটুখানি চাপাচাপিতে চোখের পলকেই গড়ে ওঠে সম্পর্ক। ক’দিন যাবার পর আবার সেই পুনরাবৃত্তি। ফেসবুক ভালোবাসা গড়ে ওঠতে যেমন খুব বেশি সময় লাগে না, তেমনিভাবে দূরে সরে যেতেও সময় নেয় না। এই রিলেশনশিপ বা ব্রেক-আপ যেন একটা মামুলি ব্যাপার। উপরন্তু কার হিসেবের খাতায় কতটা ‘রিলেশন’ বা ‘ক্রাশ’ যোগ হয়, সেটাই হয়ে ওঠে বড়াই করার মতো বিষয়। কেউ কেউ ভালোবাসার অন্তরঙ্গ ছবি বা ভিডিও চাউর করে দিতে একটুও দ্বিধা করেন না। তাতে যদি ‘লাইক’ বা কমেন্টস বেশি পাওয়া যায়, সেটাও বড় একটা অর্জন মনে করা হয়।
এখন তো টেস্ট ক্রিকেটের রোমান্টিকতার কদর নেই। এটা উপভোগ করার মতো সেই ধৈর্য নেই। সেই আবেগও নেই। ওয়ান ডে ক্রিকেটের উত্তেজনাও ক্রমশ যেন ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছে। সেই উত্তাপ নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। সেই উচ্ছ্বাসও থিতিয়ে এসেছে। সময়টা এখন টি-টুয়েন্টির। সময় কম। ব্যাপক বিনোদন। উত্তেজনাও বেশি। মূলত জীবনের সব ক্ষেত্রেই অনুসৃত হচ্ছে এই ধারা। ভালোবাসাইবা কেন ক্রিকেটের ক্ষুদ্র এই সংস্করণকে অনুসরণ করবে না? দ্রুতই যদি সব কিছু পাওয়া যায়, চট করে ঘটে যায় সমুদয়, কে আর অপেক্ষার প্রহর গোনে? টি-টুয়েন্টির মূলমন্ত্র, হয় ছক্কা না হয় অক্কা। এই মূলমন্ত্রকে অনুসরণ করা হচ্ছে হাল আমলের ভালোবাসায়। টইটুম্বুর ভালোবাসা মুহুর্তেই নেই হয়ে যেতে একদমই সময় লাগে না। অনেকটা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো।

এখন ফাগুন আসে বিপুলভাবে উদযাপনের উপলক্ষ নিয়ে। ভ্যালেনটাইন ডে আসে ভরপুর ভালোবাসা নিয়ে। তার সঙ্গে যুক্ত হয় ভার্চুয়াল লভ। সব মিলিয়ে বসন্তের টি-টুয়েন্টি জম্পেশ ককটেল। তাতে থাকে ফেনিল মদিরতা। থাকে উৎসবের আমেজ। থাকে আনন্দময় কোলাহল। রঙদার হয়ে ওঠে চারপাশ। উদ্বেলিত হয়ে ওঠে পরিপার্শ্ব। ঢেউ খেলে যায় রোমান্টিকতার। অতি সুলভে জীবনকে রাঙানোর এমন সুযোগকে কে আর হাতছাড়া করতে চায়? সঙ্গত কারণে তাতে প্রতিধ্বনিত হয় তারুণ্য আর যৌবনের উচ্ছ্বাস, উল্লাস, উদ্দাম। তবে আমরা যারা বুকের মধ্যে টেস্ট ক্রিকেটের ভালোবাসার রোমান্টিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠেছি, তাদের কাছে টি-টুয়েন্টি ভালোবাসার রোমাঞ্চকে ঈশপের গল্পের মতো আঙুর ফলকে টক মনে হতেই পারে।            
           

বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

আমার বইমেলা





বাংলা একাডেমির বইমেলার সঙ্গে বয়সোচিত কারণেই সহজাতভাবেই আমাদের প্রজন্মের একটা আত্মিক বন্ধন গড়ে উঠে। কলেজে উঠার পর পরই বইমেলা হয়ে উঠে তারুণ্যের প্রাণপ্রাচুর্যের বিচরণক্ষেত্র। সেই সময় নিজের মনে করে সবে ক্ষমতার দখল নেন সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ। সাইকেল চালিয়ে আর কবিতা লিখে তিনি যতই সর্বসাধারণের মন জয় করার চেষ্টা করুন না কেন, ছাত্র সমাজ তাঁকে একদমই মেনে নিতে পারেন নি। ছাত্রদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কলাভবন থেকে শিক্ষা ভবন অভিমুখে ছাত্রদের মিছিলে ট্রাক তুলে দেয় পুলিশ। জাফর, জয়নাল, দীপালিরা জীবন দিলে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভের আগুন। সেই আগুনের আঁচে এলোমেলো হয়ে যায় জমজমাট বইমেলা। সেদিনও ছিলাম বইমেলায়। আর বাংলা একাডেমির বইমেলা ছিল এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার।
রাজপথ উত্তাল হয়ে উঠার পাশাপাশি বইমেলা প্রাঙ্গণে তার উত্তাপ দারুণভাবে টের পাওয়া যেত। কবি মোহন রায়হানদের সাহসী তৎপরতা তো ছিল। কবি-লেখকদের কলমে ছিল তীব্র ঝাঁজ। আবৃত্তিকারদের কণ্ঠের নিনাদে প্রকম্পিত হয়েছে পুরো চত্বর। আর তখন তো লিটল ম্যাগাজিনের স্বর্ণযুগ। তাতেও থাকতো প্রতিবাদী সব লেখা ও কার্টুন। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ তো ছিলই। আমাদের তখন তরুণবেলা। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ আমাদের দারুণভাবে নাড়িয়ে দিত। বইমেলায় গেলে মনে হতো, আমিও বুঝি আন্দোলনের অংশীদার। এ কারণে বইমেলা আমাদের চুম্বকের মতো টানতো। তাছাড়া কত কত বইয়ের স্পর্শ ও সুঘ্রাণ মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতো। (অথচ কী এক অদ্ভুত কারণে ক্লাসের পাঠ্য বইয়ের স্পর্শ তো দূরে থাক, ঘ্রাণ নিতে একটুও ইচ্ছে করতো না।) তখন তো আর বইমেলায় খুব বেশি বই প্রকাশিত হতো না। মোটামুটিভাবে সব বই ও লেখকের খোঁজ-খবর রাখাটা মোটেও কঠিন ছিল না। সেটাও এক ধরনের আনন্দ ছিল বৈকি।
বইমেলা যখন সাবালক হয়ে উঠতে থাকে, তখন থেকেই তাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়। সঙ্গত কারণে আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে একুশের বইমেলা। সেই থেকে বইমেলার সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক কখনই শিথিল হয় নি। বরং বদলে গেছে ভূমিকা। শুরুর দিকে কেবলই দর্শক হিসেবে বইমেলায় গেলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পকর্টা গভীরতর হয়েছে।
বইমেলা উপলক্ষে কত কিছু যে আয়োজিত হতো। বিভিন্ন রকমের অনুষ্ঠান ও কর্মকাণ্ডে সরগরম থাকতো বাংলা একাডেমি এবং সংলগ্ন এলাকা। নাটকের একটি মঞ্চ গড়ে তোলার জন্য অভিনেতা শংকর সাঁজোয়ালের নেতৃত্বে ‘কারক’ নাট্যগোষ্ঠীর বিদ্রুপাত্নক পথনাটক দারুণ উপভোগ করেছি। এজন্য লাল সালুতে টাকা-পয়সা ভালোই জমতো। সেই মঞ্চ কি গড়ে উঠেছে? তাছাড়া মেলায় আগত শিল্প-সাহিত্য-নাটক-সংস্কৃতি-সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি জগতের দূরের মানুষদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়। কত খ্যাতিমান ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব যে আসতেন। লেখক ইমদাদুল হক মিলন, হুমায়ূন আহমেদ, তসলিমা নাসরিনদের তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তাও দেখেছি। মনে পড়ে, শাড়ি পরা তসলিমা নাসরিনকে প্রথম যেদিন মুগ্ধ হয়ে দেখি, তাঁকে কেন্দ্র করে স্বভাববিরুদ্ধভাবে একপাক ঘুরপাক খেয়েছিলাম। কবি নির্মলেন্দু গুণের হাত ধরে কন্যা মৃত্তিকা গুণ, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদারের সঙ্গে কন্যা ত্রপা মজুমদারকে অনেক দিন দেখেছি। এই কিশোরী কন্যারা এখন কত বড় হয়ে গেছেন! সে সময় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে দেখতে পাওয়া ছিল রোমাঞ্চকর একটি ব্যাপার। 
   

বইমেলা উপলক্ষে লিটল ম্যাগাজিনের ঢেউ আমার বুকেও দোলা দিয়ে যায়। কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই ১৯৮৩ সালে ‘আবাহন’ নামে একটি সাহিত্য সংকলন প্রকাশের উদ্যোগ নেই। সেই সুবাদে বাংলা একাডেমি চত্বরে যাতায়াত বেড়ে যায়। একে একে পরিচিত হতে থাকি নবীন-প্রবীণ লেখকদের সঙ্গে। বিশেষ করে কবি আবিদ আজাদ, ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন সহ প্রমুখের সঙ্গে সম্পর্কটা দীর্ঘস্থায়ী হয়। এছাড়াও বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়। সাহিত্য জগতের অনেক অভিসন্ধিও নজরে আসে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এক বছর পর সংকলনটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়। বইমেলায় সংকলনটি নিয়ে যাওয়ার পর নিজেকে সাহিত্য জগতের কেউকেটা মনে হতে থাকে। বইমেলার সঙ্গে অনেক বেশি নিবিড়তা অনুভব করতে থাকি। মনে হতে থাকে, এত দিনে বইমেলার একজন হতে পেরেছি।
১৯৯০ সালে সাবের হোসেন চৌধুরী সম্পাদিত (প্রধান সম্পাদক ছিলেন কবি শামসুর রাহমান) সাপ্তাহিক মূলধারা পত্রিকার রিপোর্টার হয়ে অনেক লেখক-সাহিত্যিক-প্রকাশকের খণ্ড খণ্ড সাক্ষাৎকার নিয়েছি। এরপর থেকে পেশাগত কাজে অসংখ্যবার বইমেলা চত্বরে যেতে হয়েছে।     
               

বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পর একুশে বইমেলা উপলক্ষে ক্রীড়া বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশ করার উদ্যোগ নেই। তারই অংশ হিসেবে ১৯৯৩ সালে ২৬ জন লেখকের লেখা নিয়ে ‘খেলার কথা কথার খেলা’ এবং পরবর্তীতে বাংলা ভাষায় সম্ভবত প্রথম ক্রীড়া বিষয়ক ছড়াগ্রন্থ কবি সানাউল হক খানের ‘ছন্দে ছন্দে খেলার আনন্দে’ প্রকাশ করা হয়। আর বই বিক্রির জন্য ১৯৯৩ সালে প্রথম সমিতির উদ্যোগে বইমেলায় স্টল নেওয়া হয়। তাতে শুধু সমিতির নয়, অন্যদের লেখা ক্রীড়া বিষয়ক বই নিয়ে সাজানো হয় সেই স্টল। সব দিক দিয়ে এটি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী একটি প্রয়াস। এছাড়া বই বিক্রি করার অভিনব একটি কৌশলও নেওয়া হয়। প্রতিদিন কোনো না কোনো ক্রীড়া তারকা ক্রীড়ালেখক সমিতির স্টলে উপস্থিত থাকতেন এবং বইয়ের ক্রেতাদের অটোগ্রাফ দিতেন।


তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ফুটবলার আশরাফউদ্দীন চুন্নু, সালাম মুর্শেদী, শেখ মোহাম্মদ আসলাম, কায়সার হামিদ, মোনেম মুন্না, রুমি রিজভী করিম, ইমতিয়াজ সুলতান জনি, রক্সি, ক্রিকেটার ওমর খালেদ রুমি, গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, ব্যাডমিন্টনের কামরুন্নাহার ডানা, টেবিল টেনিসের জোবেরা রহমান লিনু। এঁদের কেউ কেউ এসেছিলেন সপরিবারে। সবচেয়ে সাড়া জাগিয়েছিল সে সময়কার সুপারস্টার সদ্য বিবাহিত মোনেম মুন্না ও কায়সার হামিদের উপস্থিতি। এই দুই দম্পতির হাতের মেহেদির রং তখনও টাটকা ছিল। মুন্না সস্ত্রীক মেলায় যে দিন স্টলে বসেছিলেন, সেদিন আমাদের স্টলকে কেন্দ্র করে পুরো মেলা যেন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিতরা এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়। এ কারণে সম্ভবত মেলার আয়োজকরা আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিল।  
 

১৯৯৩ সালেই প্রকৃত প্রকাশক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করি। সে সময় বেশ সুখ্যাতিও অর্জন করি। এ কারণে বইমেলার সঙ্গে সম্পর্কটা আরো দৃঢ়তর হয়। আর প্রকাশক হওয়ার পেছনে অবদান রাখেন লেখক ও সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। ১৯৯২ সালে দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের জনক কে?’ শিরোনামে একটি লেখা। আলোচিত এ বিষয়টি নিয়ে তখন সর্বত্র তোলপাড় চলতে থাকে। সেই আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করে এ লেখাটি। হঠাৎ মাথায় এলো, এ লেখাটিকে বই আকারে প্রকাশ করলে কেমন হয়? বাংলার বাণীর সাংবাদিক সহকর্মী সুধীর কৈবর্ত দাস, প্রণব সাহা, নান্টু রায়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করলে তাঁরা সায় দেন। এরপর আর এগিয়ে যেতে সময় লাগে নি। চারজনের অর্থে গড়ে উঠে ‘অক্ষরবৃত্ত’ প্রকাশনী। এই প্রকাশনীর উদ্যোগে লেখকের অনুমোদন নিয়ে বইমেলা উপলক্ষে ‘আমরা বাংলাদেশী না বাঙালি?’ বইটি প্রকাশ করা হয়। যদিও আমাদের কোনো স্টল ছিল না। তারপরও মেলায় বইটি হটকেক হয়ে ওঠে। একাধিক সংস্করণও ছাপতে হয়। একটি প্রবন্ধের বই এতটা সাড়া জাগাবে, এটা আমাদের ধারণায় ছিল না।
তখন দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় বইমেলা কাভার করতেন জনপ্রিয় ছড়াকার ও লেখক লুৎফর রহমান রিটন। তিনি এ বইটিকে কেন্দ্র করে প্রকাশক হিসেবে আমার এক টুকরো সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। এ বইটি দিয়ে আমরা বেশ মুনাফা করতে সক্ষম হই। সেটা হয়ে যায় আমাদের ভালো একটা পুঁজি। প্রকাশনা ব্যবসায় আমরা বেশ উৎসাহী হয়ে ওঠি। পরের বছর থেকে আমরা বইমেলায় নিজেরাই স্টল নেওয়া শুরু করি। দৈনিক বাংলার বাণীতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর স্মৃতিচারণমূলক লেখা ‘ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা’ও আমরা প্রকাশ করার অনুমতি পাই। এ বইটিও পাঠকরা লুফে নেন। কিন্তু এরপর কোনো বিবেচনা ছাড়াই আমরা একের পর এক গ্রন্থ প্রকাশ করতে থাকি। যার তেমন কোনো পাঠক চাহিদা ছিল না। সব মিলিয়ে বোধকরি ১৮টি বই হবে। এ কারণে আমাদের মূলধন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। তাছাড়া প্রকাশক চার জন হলেও সব চাপ গিয়ে পড়ে বাংলা বাজার এলাকায় সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব সুধীর কৈবর্ত দাসের কাঁধে। প্রকৃতঅর্থেই ‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ’ তাঁকেই করতে হয়। আর আমরা বাকি তিন প্রকাশক অনেকটা মেহমান হিসেবে মাঝে-মধ্যে স্টলে চেহারা দেখাতে যেতাম। খোঁজ-খবর খুব একটা নিতাম না। যদিও বইয়ের ব্যবসার প্রসার বাড়তে থাকে। কিন্তু একার পক্ষে এ ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া সুধীর দা’র পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। ব্যবসায় লালবাতি জ্বলতে সময় লাগে নি। এ কারণে প্রকাশক হিসেবে বইমেলার সঙ্গে ২০০০ সালের পর আর সম্পর্ক থাকে নি।
 

১৯৯৮ সাল থেকে বইমেলার সঙ্গে গড়ে ওঠে নতুন এক সম্পর্ক। সে বছর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয় আমার প্রথম গ্রন্থ ‘দেখা হলো লংকায়’। ভ্রমণবিষয়ক এ গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংযোজন না হলেও বাংলা একডেমির বইমেলায় অভিষেক হয় একজন লেখকের। তবে এটা তো ঠিক, অভিষেক হওয়ার আনন্দ অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা চলে না। যদিও অভিষিক্ত ক্রিকেটারদের মতো মাথায় কেউ ক্যাপ পরিয়ে না দিলেও অদৃশ্য এক ক্যাপ নিজেকে নিজেই পরিয়ে দেই। লেখক হিসেবে বইমেলার সঙ্গে সেই যে হার্দিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সেটা আর কাটিয়ে ওঠা যায় নি। এখন তো আর আগের সেই দিন নেই। বইয়ের প্রচার-প্রচারণায় লেখক নিজে সক্রিয় না হলে বইয়ের নাকি কাটতি হয় না। কিন্তু এই দক্ষতা আজও অর্জন করতে পারলাম না।


তবে ২০০৫ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয় আমার দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘স্টেডিয়ামের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমির বটতলায় বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাতে উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, কবি হালিম আজাদ সহ অন্যরা।
সম্ভবত ২০০৮ সালে বাংলা একাডেমি চত্বর দিয়ে একদিন হাঁটাহাঁটির সময় পরিচিত ছড়াকার ও লেখক আমিরুল ইসলাম ঠেলেঠুলে লুৎফর রহমান রিটন ভাইয়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন। ২০০৪ সাল থেকে চ্যানেল আই বাংলা একাডেমি চত্বর থেকে সরাসরি বইমেলা সম্প্রচার করা শুরু করে। এ অনুষ্ঠানের প্রযোজক আমিরুল ইসলাম। আর দীর্ঘ এক দশক এর উপস্থাপক রিটন ভাই। বিস্মিত, বিস্রস্ত ও বিভ্রান্ত আমি সেদিন নিজের বই সম্ভবত ‘আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও’ এবং ক্রীড়া বিষয়ক প্রকাশনা নিয়ে কী বলেছিলাম, সেটা আজ আর স্মরণ নেই। বইমেলায় প্রিন্ট ও ইলেকট্রোনিক মিডিয়ায় যে দু’বার সাক্ষাৎকার দেই, ঘটনাক্রমে দু’বারই সাক্ষাৎকার নেন আমার একজন অত্যন্ত প্রিয় মানুষ রিটন ভাই। তবে এরপর আর নিজের বই নিয়ে বইমেলায় কখনও কোথাও কিছু বলতে হয় নি।
তারপর থেকে মাঝে-মধ্যে নিজের বই প্রকাশিত হওয়ায় বইমেলার সঙ্গে আবেগগত ও ভালোবাসার একটা বন্ধন গড়ে উঠেছে। তাছাড়া মনের মধ্যে একটা লেখক লেখক ভাবও বোধকরি এসে গেছে! বইমেলা এলে কাছের জনরা জানতে চান, এবার কী বই বের হচ্ছে? এটাও কি কম আনন্দের? বিভিন্ন সময়ে বদলেছে বইমেলার নামকরণ। সাম্প্রতিক সময়ে বইমেলার ব্যাপ্তি বেড়েছে। বিশালত্ব বেড়েছে। বইয়ের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু সৃজনশীল বইয়ের পাঠক কি বেড়েছে? তবে বইমেলা এলে এখনও বুকের মধ্যে উড়তে থাকে রঙিন প্রজাপতি। যতই কাজে ব্যস্ত থাকি না কেন, নতুন প্রেমে পড়া কিশোরের মতো বইমেলায় ঢু মারার জন্য মনটা সারাক্ষণ উচাটন হয়ে থাকে। আর প্রেমিকা যখন অপেক্ষায় থাকে, তখন যত কাজই থাকুক না কেন, ছুটে না গিয়ে কি পারা যায়?