পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

বুধবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

প্রথম কবিতা

আশির দশকের শেষ দিক। সময়টা এমন, মনের কথা মুক্তভাবে বলার উপায় নেই। চারপাশে বিধি-নিষেধের একটা বেড়াজাল। এমন একটা পরিবেশে শাঁখারিবাজার থেকে প্রকাশিত হবে তাদের বাৎসরিক পূজা সংখ্যা। এই পূজা সংখ্যার সার্বিক তত্ত্বাবধানে আমাদের সুধীর দা। বিখ্যাত সুধীর কৈবর্ত দাস। মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক। আমি তখন দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় কর্মরত। খেলাধুলার সঙ্গেই যোগাযোগটা বেশি। স্ইে সুবাদে সুধীর দার সৌজন্যে প্রতি সংখ্যা পূজা সংখ্যায় আমাকে ক্রীড়া বিষয়ক একটি নিবন্ধ লিখতে হয়। সে বছর কী মনে করে সুধীর দাকে বললাম, এবার কবিতা লিখবো। সুধীর দার হাতে নতুন একজন কবির আবির্ভাব হবে, সেই বিবেচনায় তিনিও বোধকরি রাজী হয়ে গেলেন। কবিতার বাগানে আমার বিচরণ নেই। মনের আনন্দে টুকটাক লিখেছি। সেটা একান্তই নিজের জন্য। আমি ছাড়া আর কারো পড়ার সুযোগ হয়নি। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি কবিতা লিখে চোখ-কান বন্ধ করে তুলে দেই সুধীর দার হাতে। এই প্রথম কোনো কবিতা প্রকাশের জন্য দিলাম। কবিতা হয়েছিল কিনা জানি না। তবে তাতে বোধকরি সেই সময়ের একটা ঝাঁঝ ছিল। সেটা বিচক্ষণ সুধীর দা বুঝতে পেরেছিলেন। পূজা সংখ্যা হাতে নিয়ে দেখি, আমার কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছে। তবে সব কিছু বিবেচনা করে আধখানা কবিতা ছাপিয়েছেন সুধীর দা। সেই সময়ের বিবেচনায় এটা করা ছাড়া তার গত্যন্তর ছিল না। আমি তো তাতেই খুশি। জীবনের প্রথম প্রকাশিত কবিতা বলে কথা। খুশির রেশ ফুরিয়ে যেতে না যেতেই সুধীর দা হাতে তুলে দিলেন পঞ্চাশ টাকা। কীসের টাকা? সুধীর দা জানালেন, এটা কবিতার সন্মানী। আমি তো থ্ মেরে যাই। কবিতা ছাপা হয়েছে, সেটাই তো বেশি। তার ওপর আবার সন্মানী! প্রথম কবিতা প্রকাশ করে সন্মানী পাওয়াটা জীবনের একটা স্মরণীয় ঘটনা হয়ে আছে। এরপর আর কখনো কবিতা প্রকাশের জন্য কোথাও দেয়া হয়নি। সন্মানীও পাওয়া হয়নি।


কয়েক দিন আগে প্রণব দা, চ্যানেল আইয়ের সিনিয়র বার্তা সম্পাদক প্রণব সাহা, ফোন করে জানালেন, কবিতা পড়বা নাকি? কবিতা পড়বো! কোথায়? তিনি জানালেন, জাতীয় প্রেস ক্লাবে। ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ভাষা শহীদ দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্যদের স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। দৈনিক ইত্তেফাকের ফরিদা ইয়াসমীন সাংস্কৃতিক কমিটির আহ্বায়ক এবং প্রণব দা এই কমিটির সদস্য। তাদের আমন্ত্রণে আমি কি মনে করে সম্মতি জানাই। ক’দিন পরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের কবিতা পাঠের জন্য একটি আমন্ত্রণলিপি পাই। আমন্ত্রণলিপির খামে আমার পরিচয় দেয়া হয়েছে কবি দুলাল মাহমুদ হিসেবে। যদিও আমি কবি নই, তারপর এই খামটি আমাকে বেশ রোমাঞ্চিত করে। একবুক রোমাঞ্চ ও শিহরণ নিয়ে নির্ধারিত দিনে কবিতা পাঠ করতে যাই। মঞ্চে বসে আছেন দেশবরেণ্য কবি বেলাল চৌধুরী। সামনে দর্শক সারিতে কবি ও সাংবাদিকরা। কোনো রকমে নিজের লেখা একটি কবিতা পাঠ করি। মঞ্চ থেকে নামতেই হাতে একটি খাম ধরিয়ে দেন ফরিদা ইয়াসমীন। তাতে ছিল ৫০০ টাকার প্রাইজবন্ড। মঞ্চে জীবনে প্রথম কবিতা পাঠ করে সন্মানী পেলাম। নিজেকে বেশ কবি কবি মনে হতে থাকে।

শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

চিত্রকলা বোঝা কিংবা না বোঝা

প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো, আমি চিত্রকলা নিয়ে বলার মত কেউ নই। সেটা নই বলেই এই লেখা। তবে চিত্রকলার বিষয়ে কিছুটা উৎসাহী বলা চলে। চিত্রকলা আমাকে মুগ্ধ করে। করে বলেই যে কোনো চিত্রকলা থেকে সহসা চোখ ফেরাতে পারি না। সে রঙদার হোক কিংবা রঙহীন হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। চোখ ও মনকে আবিষ্ট করলেই তন্ময় হয়ে দেখি। ছবি আঁকিয়েদের আমার ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী মনে হয়। সাদা ক্যানভাসকে কি অপরূপ দক্ষতায় বর্ণময় করে তোলেন চিত্রশিল্পীরা।


এ কারণে পত্রিকার চিত্রকলা বিষয়ক সমালোচনাগুলোও আমাকে বেশ আকৃষ্ট করে। সেটা অবশ্য চিত্রসমালোচকদের লেখার নৈবদ্যে। ভাষার এমন প্রাসাদগুন যে না পড়ে থাকা যায় না। একইসঙ্গে সমালোচনা পড়ে চিত্রকলা একটু-আধটু হৃদয়ঙ্গম করতে চাই। কখনো-সখনো গ্যালারীতে গিয়ে ছবি দেখার সুযোগ হয়। একজন সাধারণ দর্শকের চোখে যতটা পারা যায় চিত্রকলার নান্দনিক সৌন্দর্যটুকু অনুধাবন করার চেষ্টা করি। কবুল করে নেওয়া ভালো, আধুনিক চিত্রকলা আমি তেমনভাবে আত্মস্থ করতে পারি নি। নিজের মত করে একটা ধারণা করে নেই। একটি চিত্রকলার চিত্রকলা হয়ে ওঠার গল্প অনুধাবন করার ক্ষমতা আমার অধরাই রয়ে যায়। মোদ্দা কথা, আধুনিক চিত্রকলার ভাষা উদ্ধার করতে সত্যি সত্যিই হিমসিম খেয়ে যাই। এটা শুধু আমার নয়, আমার মত অনেকেরই এমন অভিজ্ঞতা হয়। চিত্রকলার প্রতি ভালোবাসা আছে, কিন্তু সেটা মর্মোদ্ধার করতে না পারার ব্যর্থতাও আছে।
যদিও দেশে এখন শিল্পচর্চা অনেক বেড়েছে। বেড়েছে শিল্পী, শিল্পানুরাগী ও গ্যালারী। বেড়েছে শিল্পীদের কদরও। চিত্রকর্ম বেচাকেনা বোধকরি আগের চেয়ে অনেক ভালো। তারপরও কি বলা যাবে, শিল্পবোদ্ধা ও শিল্পানুরাগীর সংখ্যা পর্যাপ্ত?
এখন প্রশ্ন ওঠতে পারে, আমাকে কে বলেছে চিত্রকলা বুঝতে? সেটা বলাটা অবশ্য অপ্রাসঙ্গিক নয়। তারপরেও কিছু কথা রয়ে যায়। এই জগতের রূপ-রস-গন্ধকে বুঝতে চাইলে সৌন্দর্যের অন্যতম রূপকলা চিত্রকলাকে কি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে? আমরা যারা চিত্রকলা বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লেখাপড়া করিনি এবং এখন তো আর সেটা সেভাবে করা সম্ভব নয়, তারা যদি চিত্রকলা বুঝতে চাই, তাদের জন্য কি কোনো ব্যবস্থা করা যায় না? ব্যবস্থা বলতে আমি কর্মশালা বা হাতে-কলমে শিক্ষার কথা বলছি না। বিদ্যমান পদ্ধতিতে কি এটা করা সম্ভব নয়?
চিত্রকলা আঁকা হয় নানা মাধ্যমে। তেল, প্যাস্টেল, অ্যাক্রিলিক, ওয়াটার কালার, কালি, মোম, ফ্রেসকো, এনামেল, স্প্রে পেইন্ট, টেম্পেরা আরও কত কি। নামগুলো পড়ি, কিন্তু কোনটার কী কাজ, সেটা বুঝতে পারি না। কাগজ, ক্যানভাস, কাঠ, গ্লাস, রাসায়নিক ধাতু সহ নানা উপকরণ ব্যবহার করা হয়। এটা তো যাহোক তেমন একটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। চিত্রকলার ধরন-ধারণ তো একদম অন্যরকম। মর্ডানিজম, ইমপ্রেশনিজম, অ্যাবস্ট্্রাক স্ট্যাইল, এক্সপ্রেসনিজম, কিউবিজম, পপ আর্ট সহ কত রকম স্ট্যাইল। মূর্ত চিত্রকলা বুঝতে খুব একটা বেগও পেতে হয় না। এই ধারার শিল্পীদের অন্যতম জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, এস এস সুলতান, কাইয়ুম চৌধুরীর মত শিল্পীদের চিত্রকলা হৃদয়-মনকে অনায়াসে রাঙিয়ে দেয়। দেশ-বিদেশের যে কোনো মূর্ত চিত্রকলাই বুঝতে খুব একটা ঘাম ঝরাতে হয় না। কিন্তু বিমূর্ত চিত্রকলা রয়ে যায় বোধের অগম্য। আর এখন তো চিত্রকলার ভাষা আরো বদলে গেছে। সময়ের সঙ্গে সমান্তরালভাবে চলতে হলে বদলে যাওয়াটাই রীতি। এত এত কিছু তো একজন সাধারণ শিল্পানুরাগীর পক্ষে আত্মস্থ করা সম্ভব নয়। সে হয়ত মনের টানে চিত্রকলার প্রতি আকৃষ্ট হন। সময়-সুযোগ পেলে চিত্রকলা প্রদর্শনীতে যান কিংবা সমালোচনা পড়েন বা শোনেন। যে সময়টাতে তিনি এতে মনোযোগী হন, সে সময়টুকুতেই তিনি এটা বুঝতে চাইবেন। আর এটা নিয়েই এত কথা বলা।
চিত্রকলাকে সাধারণ্যে পরিচিত করার ক্ষেত্রে পত্রিকা ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। পত্রিকা ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় চিত্রকলা বিষয়ক যে লেখাগুলো প্রকাশিত ও যে শিল্পকর্ম নিয়ে আলোচনা হয়, তাতে যে শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে আলোচনা করা হয় ও দেখানো হয়, লেখার সঙ্গে সামজ্ঞস্য রেখে যদি সেই চিত্রকর্মগুলো ছাপানো ও আলোচনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তা দেখানো হয়, সব তো আর সম্ভব নয়, অন্তত উল্লেখযোগ্য কাজগুলো যদি দেওয়া হয়, তাহলে শিল্পকর্মগুলো বুঝতে কিছুটা সুবিধা হতে পারে। যে সব পত্রিকা চিত্রকলা বিষয়ে লেখা প্রকাশ করে থাকে কিংবা যে সব ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় চিত্রকলা নিয়ে আলোচনা করা হয়, তারা যদি এটা অনুসরণ করে, তাহলে চিত্রকলা অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য হয়ে থাকবে না। বিশ্ববিখ্যাত শিল্পকর্ম নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা করা হয়। সঙ্গে থাকে চিত্রকলার রিপ্রোডাকশন। যে কারণে আমরা কিছুটা হলেও লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসার রহস্যময় হাসির মাজেজা কিংবা এ জাতীয় জগতবিখ্যাত চিত্রকলার গুরুত্ব কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। তেমনিভাবে বাংলাদেশের শিল্পীদের সেরা সেরা চিত্রকর্মগুলো নিয়ে যদি স্বতন্ত্রভাবে আলোকপাত করা হয়, তাহলেও বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমনটি করা হয়ে থাকে জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, এস এস সুলতানের ক্ষেত্রে। এ তো গেল মিডিয়ার কথা।
 

বিভিন্ন গ্যালারীতে আয়োজন করা হয় চিত্রকলা প্রদর্শনী। প্রদর্শনীশালায় ছবিগুলো সুন্দরভাবে টানিয়ে রাখা হয়। দর্শক নিজের অনুভব ও অনুভূতি দিয়ে ছবিগুলো বোঝার চেষ্টা করেন। গ্যালারীতে যদি বোদ্ধা কেউ একজন থাকেন, তিনি আগ্রহী দর্শককে দর্শনীর বিনিময়ে ছবিগুলো বুঝিয়ে দিতে পারেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদিও বিষয়টি সহজ নয়, তারপরও আরো কীভাবে সহজ বা সুলভ পদ্ধতিতে এটা করা যেতে পারে, সেটা ভেবে দেখা যায়। তাছাড়া ব্যক্তিগত যে প্রদর্শনীগুলো হয়, তাতে খুব একটা ক্যাটালগ বের করতে দেখা যায় না। যদিও বের করা হয়, তাতে সবগুলো চিত্রকর্ম থাকে না। সেক্ষেত্রে ক্যাটালগে প্রতিটি ছবির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া থাকলে চিত্রকলার সমঝদার বাড়তে পারে। ক্যাটালগগুলো স্পনসরের মাধমে কিংবা সুলভ মূল্যে বিক্রি করা যেতে পারে। একজন শিল্পীর চিত্রপ্রদর্শনী তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সে কারণে প্রদর্শনীটি গুরুত্বসহকারেই হওয়া উচিত। এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে যাতে অনেক দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগটা ভালোভাবে হয়ে যায়।
চিত্রকলাকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে এমনটি ভেবে দেখা যেতে পারে। যদিও হুট করে সেটা সম্ভব নয়, অন্তত উদ্যোগ তো শুরু করা যেতে পারে।